লালকমল নীলকমল পড়েছেন?
হ্যাঁ, ছোটবেলায়। তখন সব ছবি আঁকা বই পাওয়া যেত না! সেখান থেকে...
সেই থেকেই কি আপনাদের দুই ভাইয়ের ডাক নাম লাল (সুমন মুখোপাধ্যায়, নাট্যজন ও চলচ্চিত্র পরিচালক) আর নীল?
হ্যাঁ। দিদিমার দেওয়া। লালের পরে আমি নীল। মেয়ে হলে কমলা দিতেন কিনা জানি না! (হাহাহাহা) ভাল নাম দু’টো বাবা (নাট্যব্যক্তিত্ব অরুণ মুখোপাধ্যায়) দিয়েছে।
আপনার মামার বাড়ি কোথায়?
আদি বাড়ি হরিপালে। পরে শ্যামবাজারে চলে আসেন ওঁরা। দাদু খুব বড় ডাক্তার। নাম, নিতাই চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। এ দিকে বাবার বাবা ছিলেন বড় উকিল। ঠাকুরদা মানে, বাবার বাবা হাওড়ার বিখ্যাত মানুষ দীনবন্ধু মুখোপাধ্যায়। যাঁর নামে দীনবন্ধু কলেজ, দীনবন্ধু স্কুল ইত্যাদি।
আপনাদের তো কোনও বোন নেই। ভাইফোঁটায়...
এখন আর ভাইফোঁটাটা নেওয়া হয় না। কিন্তু এক সময় আমার আর দাদার কাছে এটা অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল। কারণ আমরা তিন-চার জায়গায় যেতাম। ছাঁদা বেঁধে বাড়িতে খাবারও নিয়ে আসতাম। তার সঙ্গে ‘গিফট’! আমি ছোট বলে আমাকে কিছু দিতে হত না (হাহাহাহা)! তো, এ সব হত আমার এক পাড়াতুতো দিদি, মাসতুতো দিদি আর খুড়তুতো দিদির কারণে। হাওড়া, সল্টলেক, লেক গার্ডেন্স— এই তিনটে অঞ্চলে ঢুঁ মারতাম আমি আর দাদা। সকাল ৮টা থেকে বেরিয়ে যেতাম দু’জনে।
ছবি: সুজন মুখোপাধ্যায়ের সমাজ মাধ্যম থেকে সংগৃহীত
আপনার মা পেশায় কী ছিলেন?
প্রথম দিকে একদমই ঘরণী। তার পর চাকরি, হাওড়া শিবপুরের একটা স্কুলে। মা প্রধান শিক্ষক ছিলেন। আমি ওখানে ফোর অবধি পড়েছি। তার পর তো, আমি বিধাননগর স্কুলে। তখন আমরা হেস্টিংসে। সরকারি আবাসনে চলে এসেছি।
দাদার সঙ্গে সম্পর্ক কেমন ছিল? ঈর্ষার?
ঈর্ষা? মনে পড়ে না। বরং দাদার উপরে বেশ কিছুটা ‘ডিপেডেন্স’ ছিল আমার। সে মোহনবাগানের খেলা দেখতে যাওয়া থেকে অনেক কিছুতেই। সিনেমা দাদার সঙ্গে এক বারই গিয়েছিলাম দেখতে, অনেক ছোট তখন! অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা বোধহয়। তবে ওর সঙ্গে এক বার আমার তুমুল লেগেছিল! সেটা এ দেশে নয়। আমেরিকায়। তখন আমরা বেশ বড়। সে মারপিট একেবারে।
আমেরিকাতে গিয়েছিলেন কেন?
শো করতে। ৯১ সালে। মারপিট। হোয়াইট হাউসের সামনে। ঠিক কী জন্য এমন হয়েছিল, মনে পড়ে না। তবে আমাদের একটা পেলে-মারাদোনা নিয়ে ঝগড়া ছিল। ও খুব মারাদোনার ভক্ত। আমি পেলের।
আর গাওস্কর-বিশ্বনাথ নিয়ে তক্কাতক্কি?
ওটা মিলে গিয়েছিল। দু’জনেই গাওস্কর ভক্ত। আর মিলেছিল অমিতাভ বচ্চন নিয়ে। দু’জনেই অমিতাভ বচ্চনের পাঁড় ভক্ত!
শাহরুখ আসার পরও?
যদি সুপার স্টারের জায়গা থেকে বলেন, শাহরুখকে অবশ্যই আমার ভাল লাগে। তবে অভিনেতা হিসেবে অনেকের নাম আসবে। নাসিরুদ্দিন তো অবশ্যই।
দাদা?
প্রথম থেকেই আমির খান। পরে অবশ্য তেমন বলতে শুনিনি। বাবা কিন্তু প্রথম প্রথম হিন্দি ছবি একবারে পছন্দ করত না। তবে শোলে-র আবার দারুণ ভক্ত ছিল বাবা। আমাদের বাড়িতে প্রচুর এলপি রেকর্ড ছিল। ওখান থেকেই আমার গানের নেশা। একটা ঘটনা বলি, তখন ‘সরাবি’ খুব হিট। দাদা আর আমি লুকিয়ে ‘সরাবি’র গান শুনতাম। সে সব বাবা যখন থাকত না। তার পর অমিতাভের ‘মহান’ বলে একটা সিনেমা এল। আমি তখন সিক্স-সেভেন। ‘পেয়ার নে মুঝকো...’ বলে সেই গানটা। ওই রেকর্ডটা আমার যেখানে পড়ার বই থাকত, সেখানে লুকিয়ে রেখেছিলাম। এক রাতে বাবার ওটা চোখে পড়ে গেল। হাঁটু দিয়ে ভেঙে দিল রেকর্ডটা। আমি দাদার ঘাড়ে দোষ চাপাতে গিয়ে দু’জনেই কেস খেলাম। পরে বাবার অনেক পরিবর্তন হল। নিজেই অমিতাভ বচ্চনের ছবি দেখত। টিভিতে। এখন তো বাবাকে ট্যাবও কিনে দিয়েছি। তবে বাবা খুব উত্তমকুমারের ভক্ত।
আচ্ছা! এ বার বলুন, আপনি টিভিতে ‘লক্ষ্ণীছানা’ বলে একটা অনুষ্ঠান করতেন! নিজে কতটা লক্ষ্ণীছানা ছিলেন?
অনেকটাই। একটু হাতে পায়ে দুষ্টু ছিলাম। অনেক মাথা ফেটেছে, পা কেটেছে। খুবই দৌড়দৌড়ি করতাম। কিন্তু মারাত্মক কিছু হয়নি।
লক্ষ্মীছানা নিয়ে তো প্রচুর গল্প!
ওরে বাবা! মারাত্মক মারাত্মক গল্প সব। ওটা আমার জীবনে বড় ‘ব্রেক’। অনুষ্ঠানটা যে এত মানুষ নেবে, ভাবতেও পারিনি। আমার তখন যাত্রার পোস্টারে কী লেখা থাকত জানেন?
কী?
‘লক্ষ্মীছানা খ্যাত’ (দুই তরফেই প্রবল হাসি)!
গল্প দুয়েকটা শুনি...
ওরে বাবা! সেন্সর্ড গল্প সব। ওই একটা দু’টোই বলি। একটা বাচ্চা একবার বেশ সেজেগুজে এসেছে। ক্যামেরা চলছে। বললাম, ‘‘তুমি এত সুন্দর সেজেছ, একদম বলিউডের মতো জমা কাপড় পরেছো তো! জানো, বলিউড কোথায়? বলল, ‘‘হ্যাঁ, বম্বে।’’ বললাম, ‘‘টলিউড জানো?’’ বলল, ‘‘হ্যাঁ, টালিগঞ্জ।’’ তারপর বললাম, ‘‘হলিউড?’’ বলল, ‘‘হলদিয়া।’’
হাহাহাহা!
(হাহাহাহা) আরেকটা গল্প হল, একটা বাচ্চা ফ্লোরে ঢুকে থেকে প্রচন্ড আমাকে মারছে, ধরছে। ভীষণ রগচটা। তার পর বলল, ‘‘তোমার না, বিয়ে হবে না, বুঝলে!’’ বললাম, ‘‘মানে?’’ বলল, ‘‘তুমি যে লাইনের ছেলে, বিয়ে হবে না।’’ আমি তখন হালকা করে বললাম, ‘‘বিয়ে ছাড়া আমার জীবন অসম্পূর্ণ তো!’’ তখন বলল, ‘‘তুমি যদি এতই বিয়ে করতে চাও, তো বলি, আমার একটা পিসি আছে। চণ্ডীগড় থাকে। ও যখন রান্নাঘরে রুটি করবে, তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে পা টিপে টিপে যাবে। পিছন থেকে জাপটে ধরে বলবে, আই লাভ ইউ।’’ আমি তখন বললাম, ‘‘পিসেমশাই তো মারবে।’’ বলল, ‘‘একটু নয় মার খাবে। কিন্তু বিয়েটা হয়ে য়াবে।’’
হাহাহাহা! গ্রেট!
আরে, এ তো কিছু না। কয়েকটা আছে বললে, আপনি লিখতে পারবেন না।
বুঝলাম। এ বার বলি, আপনার স্ত্রী নিবেদিতা আর আপনি। দু'জনেই অসম্ভব ব্যক্তিত্বপূর্ণ মানুষ। বাড়িতে তো ভিসুভিয়াস বিরাজ করার কথা!
প্রথম কথা হল, দু’জন আলাদা মানুষ, দু’জনেই সৃষ্টিশীল। অনেক সময়ই এই সমস্যাটা হয়। সংঘাত লাগে।
তখন ছেলে কী করে?
ও যখন ছোট ছিল, ওর কিছু করার ছিল না। এখন আবার যেমন দায়াদের (ছেলে) সঙ্গে নিবুর (স্ত্রী নিবেদিতা) একটা কনফ্লিক্ট হয়। দায়াদ বাড়িতে অসম্ভব পড়াশুনা করে। সেটা কাফকা, কাম্যু, মার্কসিজম থেকে স্পিরিচুয়ালিজম, অনেক কিছুই...
তর্কটা কী নিয়ে?
ধরুন, ভগবানের অস্তিত্ব নিয়ে, শিল্পীর প্রস্তুতি নিয়ে। তর্কের কোনও মা বাপ নেই। টাটা-আম্বানি নিয়েও হতে পারে। আবার কোটিপতি হওয়া নিয়েও হতে পারে।
আপনার ডিপিতে এখন উত্তমকুমারের ছবি। যদি বলি, আপনি উত্তমকুমারের কোন ফিল্মটা করতে চান?
রিমেকে করেছি। দু’টো। ‘পৃথিবী আমারে চায়’, ‘খোকা বাবুর প্রত্যাবর্তন’। খুব বেশি পরিমাণে ‘নায়ক’ বা ‘যদুবংশ’ বা ‘অগ্নীশ্বর’ করতে চাই! সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ছবিগুলি যদি বলেন তো, ‘সপ্তপদী’। আমার বাবাও কিন্তু ভীষণ উত্তম ভক্ত, জানেন তো! উত্তমকুমারের সংলাপ বলার ‘টাইমিং’, ‘সেন্স অফ হিউমার’ সবটার...
তাই! আচ্ছা, একটা কথা। আপনি কবীর সুমনের ভক্ত, অনেকের মতো। কিন্তু ওঁর সাম্প্রতিক কিছু প্রতিক্রিয়া আপনাকে আহত করে না?
প্রচণ্ডই ভালবাসি ওঁর সৃষ্টিকে। এ নিয়ে বহু গল্প বলা যায়! কিন্তু সত্যিই ওঁর কিছু আচরণ আমার ভাল লাগে না। মনে হয়, এটা তো সুমনদার করার দরকার ছিল না। তবে এও ভাবি, উনি ‘মানুষ’ আর আমি ‘মানুষটা’ তো এক নয়! উনি কোন জায়গা থেকে এটা করেন, বাইরে থেকে বোঝাও খুব মুশকিল।
এ বার আসি একটি প্রসঙ্গে। অরুণ মুখোপাধ্যায়ের প্রিয়তম ছাত্রী। এবং বলতে গেলে ছায়াসঙ্গী। আপনার বাবা যখন অসুস্থ হন, তখনও দেখেছি, উনি কতটা দরদী ভূমিকা নেন! কিন্তু ওঁর সঙ্গে আপনাদের পারিবারিক যোগাযোগ তেমন দেখিনি!
ঠিক ঠিক। আমি বুঝতে পারছি প্রশ্নটা। আমার একটা নিজস্ব রিজার্ভেশন ছিল ওঁকে নিয়ে। বহু দিন ধরেই ছিল। কিন্তু এখন আমাদের নিয়মিত কথা হয়। সহজ সে সব আদানপ্রদান। কাজেরও সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সেটা মা চলে যাওয়ার পর নয়। তার আগে থেকেই বলছি। তবে এটাও ঘটনা, আমি একটা সময় অনেক প্রতিবাদ করেছিলাম এবং আমি আমাদের দল ‘চেতনা’ থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। এক বার বলেছিলাম, আমি ফ্রান্সে যাব না। সে নিয়ে বাবার সঙ্গে আমার দূরত্ব তৈরি হয়। তবে বাবা আমায় জীবনে কতটা দিয়েছে, বলে বোঝাতে পারব না। যদিও এ কথাও বাবাকে এক বার বলতে শুনেছি, ‘‘তোকে আমি বঞ্চিত করেছি।’’ বাবাই কিন্তু আমায় অঞ্জন দত্তর কাছে পাঠান। অঞ্জনদা আমার একটা জীবনের বড় ‘ব্রেক’। ‘আলিজিন’ নাটক থেকে। তার পর পর পর কিছু নাটক করলাম।
শেষ প্রশ্ন। শোনা যায়, আপনি এক বার মদ্যপ অবস্থায় স্টেজে উঠেছিলেন!
এক বার। ‘ঘাসিরাম কোতোয়াল’-এর কার্টেন কল-এ। আমি খুব আবেগি হয়ে কেঁদেও ফেলি তখন। ওই নাটকে কিন্তু আমি অভিনয় করিনি। ছিলাম পরিচালক। পরিচালক হিসেবে ওটা আমার সেই প্রথম বড় কাজ। অধিকাংশ বাচ্চা ছেলেপুলেদের নিয়ে। পিছনে অন্ধকারে বসে টেনশনে ঠাণ্ডা পানীয় খাচ্ছিলাম! আমার কেবল মনে হয়েছিল, ‘ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা’ যদি পারে, আমরা কেন পারব না! যাই হোক, যা করে ফেলেছিলাম সে দিন, সেটা আর কোনও দিন হবে না, এটুকু বলতে পারি! কখনও না।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।