শুরুতেই বলি, 'রকি আউর রানি কি প্রেমকাহানি' –তে অভিনয়ের জন্য বহু জনের প্রশংসা পাচ্ছি। আমার এবারের পুজোর প্রথম উপহার এটাই।
বছর বছর ধরে আমার পুজোর ক’টা ব্যাপার একই রকম ভাবে রয়ে গিয়েছে। যেমন, ধরা যাক সব কটা পত্রিকার পূজাবার্ষিকী কেনা। এ বারও কিনছি। আগে সব গুলিই আগাপাশতলা পড়তাম। এখন একটু বেছে বেছে গল্প-উপন্যাস পড়ি।
তবে ইদানীং সকালবেলা ঠাকুর দেখতে বেরতে পারি না। ঠিক করেছি, সারা সকাল পূজাবার্ষিকী পড়ব। স্কুল জীবনে পূজাবার্ষিকী নিয়ে একটা ব্যাপার হত। কার্শিয়াংয়ে পড়তাম। হোস্টেলে থাকতে হত। পুজোর সময় বাড়ি ফিরলে বাবার সঙ্গে রীতিমতো কাড়াকাড়ি হত বিশেষ একটা পূজাবার্ষিকী নিয়ে। তখন সত্যজিৎ রায় লিখতেন ফেলুদা-উপন্যাস। কে আগে ফেলুদা পড়বে? বাবা না আমি? তাই নিয়ে দ্বন্দ্ব। তখন মা হতেন ঝামেলা মেটানোর রেফারি। প্রথম প্রথম যখন ফেলুদা পড়ছি, নিজেকে তোপসে মনে হত। তারপর মনে হত, আমিই ফেলুদা।
আমার কাছে পুজো মানে আরও একটা ব্যাপার ছিল। অবাধ স্বাধীনতা। রাত করে বাড়ি ফিরলেও কেউ বকত না। বন্ধুদের সঙ্গে পাঁচ ছ’ ঘণ্টা হাঁটতে হাঁটতে উত্তর কলকাতার সমস্ত বিখ্যাত ঠাকুর দেখতাম। মাঝে মাঝে জিরিয়ে নিতাম চা নয়তো রোলের দোকানে।
আমি ফুটবল খেলতাম। মার্শাল আর্ট শিখতাম। সেই সুবাদে কিছু শরীরের কসরত করতে হত। বন্ধুরা ঠাকুর দেখতে দেখতে হেদিয়ে পড়ত। আমার ও সবের বালাই ছিল না। তবে একটা কথা, পুজোয় আমার খুব সাধারণ জামাকাপড় হত। বাবা বলতেন, ‘‘এমন কোনও জামাকাপড় পরবে না, এমন কোনও আচরণ করবে না, যাতে আর্থিক ভাবে ততটা সম্পন্ন নয়, এমন বন্ধুবান্ধব তোমার সঙ্গে পুজোয় ঘুরতে গিয়ে হীনম্ন্যমতায় ভোগে।’’
এ বছর দেখছি বিভিন্ন পুজো কমিটি থেকে পুজো উদ্বোধনের ডাক আসছে। পূজা পরিক্রমায় বেরোতে হবে। কিন্তু এখনও আমার খুব ইচ্ছে করে, বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন নিয়ে ঠাকুর দেখতে। একবার বেরিয়েও ছিলাম। কিন্তু এত মানুষ ঘিরে ধরলেন যে, পুজো কমিটির সদস্যেরা বললেন, ‘এ বার থেকে এলে খবর দিয়ে আসবেন।’
এখন স্বাধীন ভাবে ঠাকুর দেখার আশা ছেড়ে দিয়েছি। এ বছর পাড়ার পুজোয় অঞ্জলি দেওয়াও হয়তো হবে না। ওই কোনও একটা ফাঁকে মাকে গিয়ে দর্শন করে আসব।
পুজোর সময় কোনও একদিন আমাদের একটা পারিবারিক মধ্যাহ্নভোজন হয়। কোনও হোটেলের বড় রুম বুক করে। আশ মিটিয়ে খাই। ষষ্ঠী থেকে লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত আমি কোনও ডায়েট করি না।
পুজোর কেনাকাটা আমার স্ত্রী শর্মিলিই করে। ও আমার পছন্দ বোঝে। আমার শুধু একটাই আবদার, অনলাইন থেকে জামাকাপড় কিনলে চলবে না। দোকানে বা শোরুমে গিয়ে কেনাকাটার সুবিধে এবং মজাটাই আলাদা।
পুজোর সময় মাঝে মাঝে ভোররাতে ঠাকুর দেখতে গিয়েছি, স্ত্রী বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে। দেখি এ বার কী হয়! আর একটা ব্যাপারও খুব উপভোগ করি পুজোর দিনে। খুব ভোরবেলা দু’একজন সঙ্গী নিয়ে অথবা একাই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। চলে যাই গঙ্গার ধারে। গঙ্গার ধারে ছোট ছোট চায়ের দোকান। সেখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমার সঙ্গে যে ছেলেটি থাকে, তাকে বলি ভাল করে মাটির ভাঁড় ধুয়ে চা আনতে। মাটির ভাঁড়ই হতে হবে কিন্তু!
গঙ্গার কথা উঠতে একটা ঘটনা মনে পড়ছে। শর্মিলির সঙ্গে তখন আমার প্রেমপর্ব চলছে। এক মহাষ্টমীর দিন ওকে নিয়ে চলে গিয়েছিলাম গঙ্গায়। নৌকাবিহার করতে করতে ওকে সোজা বলেছিলাম, ‘পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে পারলে তোমাকে বিয়ে করব।’ ও ‘হ্যাঁ’ বলেছিল। ঠিক পাঁচ বছর পর আমরা বিয়ে করি।
বিয়ের আগে ওকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরনোটাও ছিল একটা ঝুঁকির ব্যাপার। শর্মিলিদের বাড়ি খুব কড়া ছিল। ওর পিসতুতো দিদির বাড়ি থেকে ওকে বাইকে তুলে নিতাম। দিদি বলতেন, ‘‘সময় মাত্র আড়াই ঘণ্টা। তার মধ্যে ঠাকুর দেখে ফিরে আসতে হবে।’’ বাধ্য হয়ে তাই-ই করতাম।
অনুলিখনে: সংযুক্তা বসু।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।