প্রবাসে দেবীর আবাহনে মিশে থাকে দেশে ফেলে আসা শারদোৎসবের সুবাস।
পুজোয় ভোরের শিউলি থাকে না, নেই কাশফুল কিংবা পঞ্জিকার দিন-ক্ষণ-মুহূর্তের জটিল হিসেব নিকেশ। কিন্তু গাছের পাতা রং বদলানোর উপক্রম করতেই কলকাতার পুজোর দিনের গা ঘেঁষে শনি রবিবারে প্রবাসী বাঙালি জীবনের রং বদলায়। জিনস আর বিজনেস স্যুটের জায়গায় আসর জমায় ঢাকাই জামদানি আর ধাক্কা পাড় ধুতি। হ্যারি পটার জায়গা ছাড়ে সুকুমার রায়কে। দশ বছরের পুরনো ডেট্রয়েট এলাকার ‘স্বজন অফ গ্রেট লেকস’-এর পুজোও তার ব্যাতিক্রম নয়। পুজো আসার দু’মাস আগের থেকেই চলছে নাচ, গান আর নাটকের মহড়া।
ক্যান্টন, নোভাই, অ্যান আরবার, ট্রয় এমন কি টলেডো —বহু মাইলের দূরত্ব ঘুচিয়ে এই সব শহরতলির বাঙালিরা সকলে স্বজন, মা দুর্গার আবাহনের প্রস্তুতিতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন। স্বজনের পুজার বিশেষ আকর্ষণ ঠাকুরের মণ্ডপ। প্রতি বছর ঠাকুর গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে আসন নেন স্কুল বাড়িতে, সেটাই পুজোর মণ্ডপ। শুক্রবার দুপুর থেকে ভাড়া নেওয়া হয় স্কুলবাড়ি, সন্ধ্যাবেলায় পূজামণ্ডপ গমগম। প্যান্ডেল বানানোর সময় কোথায়?
সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে স্বজনের সভ্যরা সকলে হাত মিলিয়ে তৈরি করেছেন রাজবাড়ির ঠাকুর দালান। কলকাতায় থিম প্যান্ডেল হয়, বাইরে থেকে শিল্পি এসে নকশা করেন, তাকে রূপ দিতে অনেক লোক লস্কর, চন্দননগরের লাইটিং, কুমোরটুলির শোলার কাজ, আর সবার উপরে বিশাল বাজেট।
চলছে পুজোর প্রস্তুতি, দেখুন ভিডিয়ো
সুদূর আমেরিকার ডেট্রয়েট শহরে সে সব নেই। গাড়ি বানানোর জন্য বিখ্যাত এই শহরে তাই বাঙালি প্রযুক্তিবিদেরা নিজেরাই বানিয়েছেন ঠাকুর দালানের নকশা, হাতে কখনো রং তুলি কখনো ছেনি হাতুড়ি। আমেরিকায় বেড়াতে আসা বাবা মায়েরাও হাত লাগিয়েছেন। দু’মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি এক মড্যুলার মণ্ডপ, যেটা পুজোর দিন খাড়া করে ফেলতে হবে মাত্র কয়েক ঘণ্টায়। এই মণ্ডপ প্রথমবার বানানো হয় ২০১৬ সালে। তার পর মধ্যবিত্ত বাড়ির মতো বছরে বছরে এর কলেবর বেড়ে চলেছে। মণ্ডপ বানানোর হোতা গাড়ির ইঞ্জিনিয়ার দীপঙ্কর পাল কিছু কি নতুন যোগ করবেন না তার ঠাকুর দালানে? এই বছর নতুন কী করেন সেটাই দেখার অপেক্ষায়।
আরও পড়ুন: ‘সুইসপুজো’ মন টেনে নিয়ে যাচ্ছে বেহালা নতুন দলের সেই দিনগুলোয়
এ বারের স্বজনের পুজো হবে মিশিগান ইউনিভার্সিটির ধার ঘেঁষে ওয়াশটেন কমিউনিটি কলেজ প্রাঙ্গণে। পুজোর দিন ধার্য হয়েছে অক্টোবরের ১২ থেকে ১৪। সপ্তাহান্তের তিনটে দিন— শুক্র থেকে রবি। কারণ, পুজোয় তো আর ছুটি নেই। তাই বলে মহড়ায় কোন বাধা নেই। নাচ, গান আর নাটকের জন্য জোড়তোড় প্রস্তুতি চলেছে। নাট্যশিল্পী মালা চক্রবর্তী ছোটদের নিয়ে নাটক করছেন – মনোজ মিত্রের ‘জয় বাবা হনুনাথ’। তার মতে এমনিতে বাংলায় কথা না বলা বাচ্চাদের নাটকের মধ্যে দিয়ে বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচয় করানোর এই প্রক্রিয়া ছোটরাও খুব উপভোগ করছে। পুজোর একটা বড় আকর্ষণ দেশ থেকে আসা শিল্পীরা। এ বারের পুজোর প্রধান কর্মকর্তা জিষ্ণু সেন জানালেন, কলকাতার থেকে আসছেন গায়িকা মধুবন্তী আর পর্শিয়া। আর সকলে যখন নাচতে নাচতে হাঁফিয়ে যাবে, আমেরিকান হিপ্নোটিস্ট চাক কিং মঞ্চে আসবেন তার জাদুবিদ্যা নিয়ে। কিন্তু বাঙালিকে আবিষ্ট করার আসল মন্ত্র তো খাওয়ার আয়োজনে। শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে রবিবার রাত্রির প্রতিটা খাবারের আয়োজন নিখুঁত করতে না পারলে পুজোর আনন্দের বারো আনাই যে মাটি।
আরও পড়ুন: অসাধারণ মানুষরা এ বার মাতাবেন পওয়াই-মুম্বইয়ের দুর্গাপুজো
এই সব নিয়ে প্রবাসে বাঙালির পুজো! ডেট্রয়েট এলাকায় তিনটে প্রধান পুজো। বিচিত্রা, বিচিত্রা ইঙ্ক আর স্বজন। গত পঞ্চাশ বছর ধরে বাঙালির সংখ্যা বাড়ছে, তাল মিলিয়ে পুজোর সংখ্যাও। তবুও সব পুজোতেই বাঙালির ভিড়। এই কদিন যে যেখানে থাকুন, সকলে এসে জুটে যায়। একসঙ্গে হই হই করে। আর মাত্র কয়েকটা দিন। তার পরেই শুরু হবে শাড়ি আর ঘাঘরার দেখনদারি, রবীন্দ্রনৃত্য আর ডান্ডিয়ার মেলবন্ধন, ধূপের গন্ধের সঙ্গে লুচি আর মাটনের সুবাসের ভীষণ প্রতিযোগিতা। প্রবাসী বাঙালি এখন দিন গুনছছে।