ফিলাডেলফিয়ার পুজো।
এক রবিবার দুপুরে হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। সময়টা গত বছর দুর্গাপুজোর পরে পরেই। আমার বান্ধবী, কার্বোন্ডেল ইলিনয় থেকে। অনেক দিন আমাদের দেখা হয়নি। চাকরি বাকরি, ঘর গেরস্থালি আর কম্যুনিটি এনগেজমেন্টে সময় যে কোথায় চলে যায়!
যাই হোক খুব খুশি হয়ে ফোন তুললাম । ও বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় করে আমরা পুজো কেমন কাটালাম সেই আলোচনা হচ্ছিল। আমি খুব উত্তেজিত হয়ে আমাদের নতুন প্রতিমার বর্ণনা করছিলাম, কী ভাবে আমরা সাজালাম, কেমন অনুষ্ঠান হল... ও প্রান্ত চুপ । আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কী হল রে?’’ ও বলল, “আমরা সাত-আটটা বাঙালি পরিবার এখানে আছি। খুবই ছোট কম্যুনিটি। কিন্তু খুব আগ্রহ নিয়ে এ বছর দুর্গাপুজো করতে চেয়েছিলাম । কলকাতা থেকে মূর্তি অর্ডারও করেছিলাম । কিন্তু আমাদের ভাগ্য দেখ, মূর্তিটা আসতে গিয়ে ভেঙে গেল । বিয়ন্ড রিপেয়ার । আমাদের আর পুজো হল না ।”
বুকটা ভারী হয়ে গেল। অনুভব করতে পারছিলাম ওর হতাশাটা । কী ভাবে এই বিজয়ার দিনে ওর মুখে একটু হাসি ফোটাতে পারব তাই ভাবছিলাম । আমার হঠাৎ মনে পড়ল ফিলাডেলফিয়া ‘ঘরোয়া’র আগের প্রতিমার কথা । আমাদের নতুন মূর্তি হওয়ার আগে একটা ছোট একচালা প্রতিমা দিয়ে পুজো শুরু হয়েছিল কয়েক বছর আগে।
আরও পড়ুন: কুংফু-র দেশে মহিষাসুরমর্দিনীর বন্দনা
আরও পড়ুন: আল্পস থেকে সপরিবারে মা আসেন নিউনিখের মাতৃমন্দিরে
সেই মূর্তির আরও দারুণ একটা ইতিহাস আছে। ঘরোয়ার পুজো যখন শুরু হয় এই মূর্তিটি কিন্তু তখন বাল্টিমরে । বাল্টিমরে বড় মূর্তি আসার পর এই প্রতিমা এক জনের বেসমেন্টে রাখা ছিল। ঘরোয়ার লোকজন যখন এই প্রতিমাটি নিয়ে আসতে যান, তখন বোঝা যায় এই প্রতিমা তো ফিলাডেলফিয়ার পুরাতন অ্যাসোসিয়েশন প্রগতিতে এক সময় পুজো করা হত। তার পর ওটা বাল্টিমরকে দেওয়া হয়েছে যখন তারা প্রথম পুজো শুরু করে। এই দেশে ফাইবার এর প্রতিমা, তাই বিসর্জন এর পর জলে দেওয়া যায় না। কোনও বেসমেন্টে অথবা কোনও সেল্ফ স্টোরেজে রাখা থাকে। কিন্তু এই প্রতিমাটি গত কিছু দশক ধরে আমেরিকা ঘুরে বেড়াচ্ছে আর জায়গায় জায়গায় নতুন পুজোর সূচনা করে বাঙালি মনে আনন্দ ভরে দিচ্ছে।
ভাবলাম, মায়ের কি আবার নতুন কোন জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছা হল? মা যদি ইলিনয় যেতে পারতেন তা হলে কী ভালই না হত! ওই শহরের যে বাঙালিরা পুজো করবেন বলে আশা নিয়ে বসে আছেন, তাদের মুখেও হাসি ফুটত।
‘ঘরোয়া’ কমিটির সামনে এই প্রস্তাব রাখলাম। বান্ধবীও একটা ইমেলে অনুরোধ করল । কমিটি আমাদের অনুরোধ গ্রহণ করল । বলল, যদি কার্বোন্ডেল থেকে প্রতিমা ট্রান্সপোর্ট করার ব্যবস্থা করতে পারে তা হলে ঘরোয়ার অনুমতি আছে। মাপজোখ করে শিপিং করার কথাও ভাবা হল। কিন্তু প্রতিমা যদি আবার ভেঙে যায়! তার চেয়ে ড্রাইভ করে নিয়ে যাওয়াই উচিত মনে হল । কার্বোন্ডেল এখান থেকে ৯০০ মাইল । শীতে ড্রাইভ করা যাবে না । তাই বান্ধবীর স্বামী আর ওর বন্ধু গরমের ছুটির উইকেন্ডে ১৪ ঘণ্টা ড্রাইভ করে এসে আমাদের প্রতিমা তুলে নিয়ে গেল । অনেক ঘণ্টা রেস্টোরেশন এর পর কার্বোন্ডেল কম্যুনিটি এই বছর দুর্গা পুজো পালন করবে মায়ের প্রতিমা দিয়ে। তাদের উৎসাহ দেখে আমার মন ভরে যাচ্ছে ।
এখন আমরা বেশির ভাগ সময় ঘরোয়া পুজোর প্রস্তুতিতে মগ্ন। কত কাজ বাকি আছে এখনও। রবি ঠাকুরের চন্ডালিকা নৃত্যনাট্য করব এবার। কত প্র্যাকটিস করতে হবে এখনও। কস্টিউমস, প্রপ্স, সাউন্ড আর লাইটিং সব ফাইনাল করতে হবে। মা আবার ঘোড়ায় আসবেন। আমাদের ডেকোরেশন টিম লেগেছে কী ভাবে এই ব্যাপারটাকে মণ্ডপে ফুটিয়ে তোলা যায়।
কালচারাল কমিটির চোখে ঘুম নেই। বিখ্যাত গায়িকা কবিতা কৃষ্ণমূর্তি আসছেন এবার প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে। সোল্ড আউট শো। নিউ জার্সি, ডেলাওয়ার আর পেনসিলভেনিয়া, এই তিনটে স্টেট থেকেই বাঙালিরা ভিড় করে আসবেন। প্রায় ৭০০ । ঠিক ম্যানেজ করা যাবে তো ! স্টেজ ডেকোরেশনের ডিজাইন রেডি। বাচ্চারা এবার ডিজনি থিমে একটা ফ্যাশন শো করবে দ্বিতীয় দিনে। বস্টন থেকে এক শিল্পী গান গাইবেন। আরও আছে কিছু চমক থাকবে এখনই তা ভাঙা নিষেধ। ঢাক আর ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতা তো আছেই ।
দু’দিনের মেনুও খুবই লোভনীয়। রুই গঙ্গা যমুনা, মাটন ডাক বাংলো, ছানার জিলিপি আর দরবেশ প্রথম দিনে, চিংড়ির মালাইকারি, কালীঘাটের কষা মুরগি, রসগোল্লা আর ল্যাংচা দ্বিতীয় দিনে। শাড়ির সাথে ব্লাউজ আর গয়না রেডি করে রাখতে হবে। নাচের জিনিস আমাকে গুছাতে হবে। ওই দু’টো দিন কী ভাবে কাটবে সেটা ভেবে মনটা আনন্দে ডিগবাজি খাচ্ছে। আমি যখন এই ভাবনায় হারিয়ে যাচ্ছি, তখন কিন্তু মনের একটি কোনায় একটি ছবি ভেসে উঠছে । আমার বান্ধবী ওর বন্ধুদের সাঙ্গে সিঁদুর খেলছে মায়ের প্রতিমার সামনে আর ওর মিষ্টি মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠছে।
ছবি: পুজো উদ্যোক্তাদের সৌজন্যে।