এই আমার কলকাতা। আমার প্রথম প্রেমে পড়ার সাক্ষী।
‘তুমিও হেঁটে দেখ কলকাতা, তুমিও ভেবে দেখ...যাবে কি না যাবে আমার সাথে...’
সে দিন আমিও এ ভাবেই হেঁটে ফিরেছিলাম দক্ষিণ থেকে উত্তরে। শহরজুড়ে সে দিন রঙের মরসুম। আনাচ-কানাচে আবিরের ছোঁয়া। চেনা-অচেনা সবার রঙে রং মেশানোর দিন। একা আমি উদভ্রান্ত। প্রথম প্রেম ভেঙেছিল দোলের দিনে। ভাঙা মন জুড়তে ছুটেছিলাম দক্ষিণ কলকাতায়। যদি প্রিয়ার মন গলে। প্রেমিকা আমার থেকে বয়সে বেশ বড়। তাই আমার মতো এলোমেলো নয়। বরং যথেষ্ট পোড় খাওয়া। তাই অনায়াসে শক্ত হাতে আটকাতে পেরেছিল আমাকে। পথে নেমে দেখি সকলের মুখ-চোখে ভাল লাগা, ভালবাসার আবেশ! আমার চোখে সব যেন ফিকে। সবটাই ঝাপসা! নিজের খেয়ালে অঝোরে ঝরতে ঝরতে বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছিলাম। পথে যে যার মতো করে রং মাখিয়ে গিয়েছে। তারা আমায় চেনেও না। আমিও চিনি না তাদের!
এই আমার কলকাতা। আমার প্রথম প্রেমে পড়ার সাক্ষী। প্রথম প্রেম ভাঙারও। এই শহর তাই আমার নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে।
ছিল পাড়া সংস্কৃতি
খুব ছোটবেলা থেকে শুরু করি? আমার বাড়ি শ্যামবাজার আর বেলগাছিয়ার মধ্যবর্তী। যেখানে কেতকী দত্ত, চপল ভাদুড়ী, পীযূষকান্তি সরকার, নবেন্দু চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতা চক্রবর্তী, দেবশঙ্কর হালদারের মতো রথী-মহারথীদের বাস। ছোট থেকেই আমি বাউন্ডুলে। পড়াশোনা কম করতাম। ঘুরে বেড়াতাম বেশি। আর গানের প্রতি অন্ধ আকর্ষণ। আমাদের এই এলাকায় এক জন বিখ্যাত সঙ্গীত সংগ্রাহক থাকতেন। তিনি সূরজলাল মুখোপাধ্যায়। ডাক নাম হারুবাবু। সাকিন চিড়িয়া মোড়ের রেডিয়ো গলি। সংগ্রহে আট থেকে ন’হাজার পুরনো দিনের রেকর্ড। স্রেফ গান শুনব বলে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে যেতাম। এ রকম বহু বিচিত্র মানুষের মেলা উত্তর কলকাতার অলি-গলিতে। ডিউক সারা দিন গান গেয়ে চানাচুর, বিস্কুট ফেরি করে বেড়াত। দেবাশিসের বাবা মারা গিয়েছেন। ও আপন মনে বসে কাঠের কাজ করে যাচ্ছে!
আর ছিল পাড়া সংস্কৃতি। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, চায়ের দোকানে কিংবা বাড়ির রোয়াকে আড্ডার ঠেক। এক দল উঠলেই আর এক দল এসে সেই শূন্যস্থান পূরণ করত। বিয়ের মরসুমে তো কথাই নেই। গোটা পাড়ায় যেন অলিখিত উৎসব। যার বাড়িতে বিয়ে, তার ছাদে ত্রিপল খাটিয়ে প্যান্ডেল। কেটারিংয়ের বালাই নেই। সন্ধে থেকে পাড়ার ছেলেরাই কোমরে গাছা বেঁধে বালতি হাতে পরিবেশনে ব্যস্ত। সেই সময়ে প্রতি পাড়ায় এক জন করে বিলে, পল্টু বা বাবলু থাকত। চেহারা টিংটিঙে রোগা! অথচ খেত ৮০ পিস রসগোল্লা, ৪০ পিস মাছ, এক বালতি মাংস, বা ৬০ পিস লুচি! প্রত্যেক পংক্তিতে বসে খেত। একটি ব্যাচ শেষ হলে পরের ব্যাচে আবার সে!
যার বাড়ির বিয়ে তিনিও কিন্তু আদর করেই এদের খাওয়াতেন। অনেক সময়ে এমনও দেখেছি, সেই তথাকথিত পল্টু বা বাবলুর হয়তো কোনও একটি বাড়িতে নিমন্ত্রণ নেই। কিন্তু পরদিন সেই বাড়িতে প্রচুর খাবার বেঁচেছে। এ বার কী হবে? ডেকে আন তাকে। ডাক পড়ত সেই রোগা ডিগডিগে ছেলেটির। তারও যেন চক্ষুলজ্জার বালাই নেই। অম্লান বদনে বসে যেত খাওয়ার টেবিলে। তার সামনে যত্ন করে সাজানো ৪০টি লুচি, ২০টি বেগুন ভাজা, এক বালতি মাংস আর গোটা ৫০টি রসগোল্লা। খাওয়া শেষ। বিলেও হাত মুছতে মুছতে নির্বিকার চিত্তে ফিরে যেত নিজের ঠেকে। পরম আত্মীয়তা বোধ হয় একেই বলে।
ধর্মতলায় গেলে যাব ‘অনাদি কেবিন’-এ।
আরও একটা অনুষ্ঠানের চল ছিল উত্তর কলকাতায়। সেটা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। বছরের কয়েকটি দিন ঠিক করা থাকত। যেমন ২৩ জানুয়ারি, ২৬ জানুয়ারি, ১৫ অগস্ট। আমি কোনও দিনই দৌড়ঝাঁপ ভালবাসি না। কিন্তু এমন উদ্যোগে আমার উৎসাহের অভাব নেই। টালা পার্কের খেলার মাঠ-সহ যে কোনও বড় পার্কে আমাদের পাড়ার স্পোর্টস হত। সকাল থেকে খেলার মাঠে চুন ছড়াচ্ছি। তার পরেই বাজারে জিলিপি বা বিস্কুট আনতে। রেস হবে তো! খুব ভাল স্টার্টারও ছিলাম। দৌড় শুরুর আগে বন্দুক ছুড়ে ‘রেডি স্টেডি গো’ বলা বা বাঁশি বাজানো, এ সবে পোক্ত।
একটু বড় হওয়ার পরে আরও একটি নেশা চাপল। অন্য পাড়ার স্পোর্টসেও যোগ দিতে হবে। কেন! ওই পাড়ায় এক সুন্দরীকে মনে ধরেছে। তাকে একটি বার চোখের দেখা দেখব। তাই সকাল থেকে সেই পাড়ায় ঘুরঘুর। ওটুকুই আমাদের কাছে তখন স্বর্গসুখ। যত বড় হতে লাগলাম, সেই আকর্ষণ ছড়িয়ে পড়ল সরস্বতী পুজোতেও। বসন্ত পঞ্চমী মানেই আমার গায়ে বাসন্তী পাঞ্জাবি! এখন ভাবলেও হাসি পায়। তখন ওটাই কায়দা। সেই বিশেষ সাজে সেজে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া। যেন নিষিদ্ধ বস্তু হাতের কাছে পাওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণ। কী যে তার আকর্ষণ, কী বলব! সব মেয়েই যেন সে দিন পরম সুন্দরী! উত্তর কলকাতা বনেদি। এমনিতেই শাসন বেশি। কিন্তু ওই একটি দিন আমরা সব দড়ি ছেঁড়া গরু!
খাওয়ার গল্প না বললে কলকাতার গপ্পো অর্ধেক! ভুরিভোজের জন্য আমার পছন্দ মধ্য কলকাতা। কারণ, ওখানে চমৎকার মোগলাই মেলে। সন্ধের টিফিনের জন্য ঢুঁ মারব গিরিশ পার্কের ‘নিরঞ্জন আগার’-এ। যেখানে এখনও কাঠ কয়লার আঁচে রান্না হয়। তার পর যাব ‘মিত্র ক্যাফে’ বা ‘অ্যালেন’-এ। অথবা হেঁদুয়ার ‘বসন্ত কেবিন’-এ। ধর্মতলায় গেলে যাব ‘অনাদি কেবিন’-এ। কলেজ স্ট্রিটে গেলে ‘প্যারামাউন্ট’ বাদ পড়বে না। এ বার আসি ভরপেট খানাপিনায়। চাঁদনি চকে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সাবিরের বিরিয়ানির খোশবাই। পরপর হাতছানি আমিনিয়া, রহমানিয়া। আর্সালান তখনও হয়নি। মল্লিক বাজারের মোড়ের দোকান সিরাজকেই বা ছাড়ি কী করে!
পকেটে যখন একটু পয়সা হল, যেতে শুরু করলাম পার্ক স্ট্রিট, চিনে রেস্তরাঁ ‘চাং ওয়া’-এ। তখন গোটা শহরের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, কেবিন। পর্দা টানা ছোট ছোট খুপরি কেবিন। প্রেমিক-প্রেমিকাদের স্বর্গোদ্যান। বসলেই কেবিনের কর্মীরা এসে পর্দা টেনে দিয়ে যেতেন। এবং খাবারের অর্ডার নেওয়ার আগে টোকা দিতেন পর্দার পাশের কাঠের দেওয়ালে। এত পেলব প্রাইভেসি আজকের পাঁচ তারা হোটেলেও বুঝি মেলে না! এখন কেবিনের স্বাদ পাবেন এক মাত্র ‘চাং ওয়া’-এ। আর ছিল পাইস হোটেল। সেখানে ঢালাও ভাত, তরকারি, আলু ভাতে, মাংসের ঝোল, মাছের ঝোল। যত কড়াকড়ি মাছ, মাংসের টুকরোর বেলায়।
দেখতে দেখতে তিলোত্তমা ছিপছিপে আধুনিকা। শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্সে দুরন্ত। আমার এই শহরকে বড় অচেনা লাগে। শপিং মলে কত বার গিয়েছি, হাতে গুনে বলতে পারব। তার চেয়ে বেশি আকর্ষণ হাতিবাগানের ফুটপাথের দরাদরিতে। পাঁচ তারা হোটেলের বদলে বেঁচে থাক কেবিন। যেখানে নিরিবিলিতে সাধারণের প্রেম আশ্রয় পায়। আমি আজও তাই যৌবনের শহরের কাছে নিজেকে বাঁধা রেখেছি।