কাবুল বিমানবন্দরে দেশ ছাড়তে মরীয়া মানুষের ভিড়। ছবি- টুইটারের সৌজন্যে।
কাবুল থেকে তখনও অনেক দূরে তালিবরা। সপ্তাহ দু’য়েক আগের কথা। কাবুলে রাতভরের পার্টিতে মজে ছিলেন জেহ্রা আর সারা (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম পরিবর্তিত)। সঙ্গে ছিলেন একদল বন্ধু-বান্ধবী। মৌতাতে মজে সকলেরই মনে হচ্ছিল ‘এ জীবন বেশ চলছে’… সেই পার্টিতেই কে যেন জেহ্রার কানে ফিসফিসিয়ে বলেছিলেন, “কাবুলে বোধহয় এটাই আমাদের শেষ পার্টি রে! চুটিয়ে আনন্দ করে নে।”
বিশ্বাসই করেননি জেহ্রা, সারা। আমেরিকার সেনা আছে। আছে আফগান সেনা। তাই ভেবেছিলেন কাবুলের কাছে ঘেঁষতেই পারবে না তালিবান। “থাম তো, যত্তসব আজগুবি কথা”, বলে জেহ্রা থামিয়ে দিয়েছিলেন বান্ধবীকে।
কথাটা যে আজগুবি নয়, জেহ্রা, সারা আর তাঁদের সেই রাতের পার্টির বন্ধু-বান্ধবীরা সেটা টের পেতে শুরু করলেন গত ১৫ অগস্ট, রবিবার দুপুর গড়িয়ে বিকেলে পৌঁছতেই। তত ক্ষণে টেলিভিশনে, অনলাইন সংবাদমাধ্যমে খবর রটে গিয়েছে, তালিবান ঢুকে পড়েছে কাবুলে। ‘ওরা কালাশনিকভ রাইফেল উঁচিয়ে ঢুকছে শহরে’। হোয়াট্সঅ্যাপের গ্রুপে একই আলোচনা। কেউ কাবুলে ঢুকে পড়া সশস্ত্র তালিবদের ছবি শেয়ার করছেন, তো কেউ দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে সন্ত্রস্ত মানুষের পড়িমরি করে বাড়ি বা ফ্ল্যাটে ফিরে আসার ছবি পাঠাচ্ছেন। মানুষের ঘরে ফেরার তাগিদ পৌঁছেছে চরমে। পরের দিন সোমবার (১৬ অগস্ট) থেকে ব্যাঙ্ক খুলবে কি না, এটিএম থেকে আফগানি (আফগানিস্তানের মুদ্রা) তোলা আদৌ সম্ভব হবে কি না, সেই চিন্তাতেই অস্থির তখন হাজারে হাজারে ঘরমুখী মানুষ। ঘরবন্দি মানুষজনও। কাবুলের এ-রাস্তা ও-রাস্তায় সবক’টি এটিএম-এর সামনে তখন থিকথিকে ভিড়। লাইন অজগরের মতো লম্বা। কোনও কোনও জায়গায় এটিএম-এর সামনে লাইন দৈর্ঘ্যে হয়ে যায় প্রায় সিকি কিলোমিটারের মতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ। সবাই যে যতটা পারেন আফগানি তুলে নিতে শুরু করেছেন। কোনও কোনও এটিএম-এ আফগানির মজুতই শেষ হয়ে গিয়েছে। বহু ক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও তাই হতাশ মুখে খালি হাতে ফিরতে দেখা যায় অনেককেই।
জেহ্রা আর সারা কাবুলের খানদান এলাকায় তাঁদের বহুতলের ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে তখন দেখছেন পিলপিল করে মানুষ ছুটছেন রাজধানী শহরের সবচেয়ে বড় বাজার পুল-এ-খিশ্তি-র দিকে। কবে কী পাবেন না পাবেন, আদৌ কিছু আর পাবেন কি না, কত দিন উপোসী হয়ে থাকতে হবে, এই সব সাতপাঁচ ভেবে পিলপিল করে মানুষকে ছুটতে দেখা যায় পুল-এ-খিশ্তি বাজারের দিকে। যে যা পারেন, যত দিনের জন্য ঘরে মজুত করে রাখা সম্ভব, সে সব বাজার থেকে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন বাড়িতে। চার দিকে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।
জানলা দিয়ে সেই সব দেখতে দেখতেই জেহ্রা আর সারা ভাবতে শুরু করে দেন এ বার কী করণীয়? কাবুলে ঘরবন্দি হয়েই থাকবেন, নাকি যে ভাবে হোক পালাবেন অন্য কোনও দেশে। গত শতাব্দীর নয়ের দশকে তালিবান শাসনের সময় দু’জনেই ছিলেন শিশু। তার পর ২০০১ সালে যখন আমেরিকার সেনা এসে ঘাঁটি গাড়ে আফগানিস্তানে, তখন জেহ্রা আর সারা কেউই ছিলেন না দেশে। কাবুলে পড়াশোনার প্রাথমিক পর্ব চুকিয়ে তখন ওঁরা দু’জনেই চলে যান বিদেশে। লন্ডনে, আমেরিকায়। সেখানে তো বটেই, দেশে ফেরার পরেও আমেরিকার সেনার দখলে থাকা কাবুলে খোলামেলা জীবনেই অভ্যস্ত ছিলেন জেহ্রা ও সারা। কিন্তু সেটা যে আর সম্ভব হবে না, গত ১৫ অগস্ট বিকেলের পর থেকেই তা বুঝে যান দু’জনে।
দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্তটা প্রথম নেন সারা। গত ১৭ অগস্ট স্বামীর সঙ্গে পকেটে সামান্য কিছু আফগানি আর কদিন পরা যায় এমন কিছু জামাকাপড় নিয়ে কাবুলের হামিদ কারজাই বিমানবন্দরে পৌঁছে যান সারা। বাকি জিনিসপত্র আত্মীয়দের কাছে রেখে ফ্ল্যাটে তালা চাবি লাগিয়ে।
সারা বলেছেন, “বিমানবন্দরের কাছাকাছি পৌঁছে দেখি পিলপিল করে মানুষ ছুটছেন সে দিকে। রাস্তায় সার সার দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেই ট্রাফিক জ্যাম সরাতে দেখি হাতে কালাশনিকভ রাইফেল উঁচিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এক তালিব। এক জনকে খোঁচা মারল রাইফেলের বাঁট দিয়ে। আর এক জনকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে লাথি মারতে লাগল একের পর এক। সেই সব দেখে আমি বিরক্তি প্রকাশ করে ফেলেছিলাম। সেটা শুনতে পায় পাশে দাঁড়ানো আর এক তালিব। কটমট করে তাকিয়ে আমাকে প্রশ্ন করে, এই সব বলছ কেন? চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক এখানে। না হলে কিন্তু ভাল হবে না। বুঝতে পারলাম গত দু’দশক ধরে আমেরিকার সেনার চোখে ধুলো দিতে দুর্গম পাহাড়ে লুকিয়ে থাকতে থাকতে তালিবরা কাবুলের রাস্তায় জ্যাম দেখে খুবই বিরক্ত।”
১৭ অগস্ট সারা তাঁর স্বামীকে নিয়ে কাবুলের বিমানবন্দরে পৌঁছে দেখেন সামনে কম করে হাজার পাঁচেক মানুষ। সকলেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যে কোনও বিমানে চেপে দেশ ছেড়ে পালাতে চাইছেন সারাদের মতোই। কিন্তু লাউঞ্জে ঢুকতে তাঁদের বাধা দিচ্ছে আফগান সেনা। আর বাইরে থিকথিকে ভিড় হাল্কা করতে কখনও বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারছে, কাউকে বা রাস্তায় ফেলে লাথি মারছে তালিব তরুণরা।
বৃহস্পতিবার (১৯ অগস্ট) জেহ্রার হোয়াটস্অ্যাপে মেসেজ আসে সারার। স্বামীকে নিয়ে পৌঁছেছেন পোল্যান্ডে। কী ভাবে? জেহ্রা জানিয়েছেন, স্বামীকে নিয়ে প্রথমে সারা চেপে বসে ন্যাটো জোটের শরিক পোল্যান্ডের সেনাবাহিনীর একটি বিমানে। সেই বিমানে চাপিয়ে পোল্যান্ডের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল কাবুল থেকে। সারার আমেরিকার পাসপোর্ট। কিন্তু পোল্যান্ডে তাঁর আত্মীয়রা আছেন। সেই সুবাদেই পোল্যান্ডের সেনাবাহিনীর বিমানে চেপে ১৮ অগস্ট স্বামীকে নিয়ে উজবেকিস্তানে পৌঁছন সারা। সেখান থেকে বেসরকারি বিমানে চেপে পোল্যান্ডে। কিন্তু সেখানে পৌঁছেই তাঁদের চলে যেতে হয় কোয়ারিন্টিনে। কোভিড টিকা নিয়ে থাকা সত্ত্বেও।
জেহ্রাও তার পর ঠিক করে ফেলেন দেশ ছাড়বেন। তাঁর মাও বলতে থাকেন ‘তুই দেশ না ছাড়লে তোর চিন্তায় আমি মরে যাব’। এই সব শুনে বৃহস্পতিবার বিকেলেই বিমানবন্দরে যান জেহ্রা। কিন্তু তার এক কিলোমিটার আগে থেকেই থিকথিকে ভিড় দেখে বাড়ি ফিরে আসেন। শুক্রবার শেষমেশ কাবুল বিমানবন্দর থেকে জেহ্রা চেপে বসেন একটি বিমানে।
পোল্যান্ড থেকে সারা হোয়াটস্অ্যাপে লিখেছেন, “জেহ্রা কোনও একটা বিমানে চেপেছে শুনেছি। কিন্তু কোন বিমান, কোথায় যাচ্ছে কিছুই জানতে পারিনি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy