Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
মোদী-সঙ্গীর অ্যাডভেঞ্চার-স্কুলের ছাত্র এক বাঙালি

দুরন্ত জাম্বেজিতে শুধু নাকানিচোবানি খাওয়া 

ছোটবড় পাথরে ভরা পাড়। তার পরে গভীর জঙ্গলে ঢাকা খাড়া পাহাড়। রক-ক্লাইম্বিং করে উঠলাম উঁচু একটা বোল্ডারে।

খরস্রোতা: জাম্বেজি নদীতে র‌্যাফ্টে প্রতিবেদক ও তাঁর সঙ্গীরা। নিজস্ব চিত্র

খরস্রোতা: জাম্বেজি নদীতে র‌্যাফ্টে প্রতিবেদক ও তাঁর সঙ্গীরা। নিজস্ব চিত্র

রাজর্ষি পাল
শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৯ ০০:৫৬
Share: Save:

জাম্বেজিতে ঘূর্ণির পাক থেকে বেঁচে ফিরব ভাবিনি। কিন্তু জাম্বেজি নদীর দেবতা বোধহয় ক্ষমা করে দিলেন। স্রোতের টানে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় মনে হল, স্রোতের বেগ কমার দিকে। কিন্তু সাঁতার কাটা তখনও যাচ্ছে না। পাক খাচ্ছি শুধু। র‌্যাফ্টগুলো থেকেও অনেক দূরে চলে এসেছি। জাম্বেজি নদীর এক দিকের দেশ জিম্বাবোয়ে আর অন্য দিকে জাম্বিয়া। আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম জিম্বাবোয়ে থেকে। ঘূর্ণির টান আমাকে টেনে এনেছে জাম্বিয়ার দিকে। ভাগ্য ভাল, ঘূর্ণির পাকে এক সময় চলে এলাম পাড়ের কাছে। স্রোতের বেগ বেশ কিছুটা কমে গেল। শুরু করলাম সাঁতার কাটা, পৌঁছলাম জাম্বিয়ার পাড়ে।

ছোটবড় পাথরে ভরা পাড়। তার পরে গভীর জঙ্গলে ঢাকা খাড়া পাহাড়। রক-ক্লাইম্বিং করে উঠলাম উঁচু একটা বোল্ডারে। নীচে নদী, পিছনে জঙ্গল-পাহাড়। তখনও আমার বাঁ হাতে দাঁড় এবং ডান হাতে— আশ্চর্য হলেও সত্যি— ওয়াটারপ্রুফ ক্যামেরা। প্রবল স্রোতের মধ্যেও হাতছাড়া হয়নি। বাব্বা, অ্যাডভেঞ্চার করার শখ তখনও কানায় কানায় পূর্ণ! এ বার বাঁচার রাস্তা খুঁজতে হবে। বহু দূরে আমাদের র‌্যাফ্টগুলো। মনে হল, সঙ্গীরা দেখতে পেয়েছেন যে আমি পাড়ে উঠেছি। চেঁচালাম, কিন্তু হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে গেল আমার চিৎকার। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম, একটা কায়াকে চেপে এক জন আমার দিকে আসছেন। তিনি ভুসা, স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ যুবক। অদ্ভুত কায়দায় ‘র‌্যাপিডস’গুলোকে (নদীর পাথুড়ে খরস্রোতা অংশ) পাশ কাটিয়ে চলে এলেন একদম আমার নীচে। ওঁর কথা মতো জলে লাফিয়ে পড়লাম। কিন্তু কায়াকে ওঠার জায়গা নেই। ভুসার কথা মতো হাত দিয়ে কায়াকের একটা দড়ি ধরলাম। আমার কাজ দু’হাত দিয়ে কায়াকের দড়ি ধরে থাকা আর পা দিয়ে সাঁতার কাটার চেষ্টা করতে করতে নাকানিচোবানি খাওয়া। বাকি কাজ ভুসার— দাঁড় বেয়ে ‘র‌্যাপিডস’ কাটিয়ে এগিয়ে চলা। মনে হচ্ছিল, ভুসা আমার কৃষ্ণ। দুরন্ত জাম্বেজিতে নাকানি চোবানি খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত পৌঁছলাম। র‌্যাফ্টে উঠে ধাতস্থ হতে লাগল বেশ কিছু ক্ষণ। ঘূর্ণির টানে জলের তলায় পাথরের ফাটলে আটকে গেলে আমার দেহও খুঁজে পেত না ওরা।

আবার এগিয়ে চলা। একটা জায়গায় জাম্বেজি ঘুরে গিয়েছে পাহাড়ের ও-পারে। সেখানেই আমরা র‌্যাফ্ট থেকে নামলাম। কাঁটাগাছ আর গুল্মে ভরা পাহাড় বেয়ে যতটা সম্ভব ওঠা গেল। এর পর খাড়া পাহাড়। জাম্বেজি অনেকটা নীচে। শুধু পায়ে হেঁটে ওঠা অসম্ভব। পা হড়কালে পাথরে আছাড় খেয়ে সোজা জাম্বেজিতে। তবে এখানে জাম্বেজির একটি শাখা নদী পাহাড়ের তলা দিয়ে বয়ে গিয়েছে। সেই নদীতে জল বেশি নেই। দড়ির একপ্রান্ত বেঁধে দেওয়া হল একটা মোটা গাছের গুঁড়িতে। দড়ির অন্য প্রান্ত হাতে করে পল নেমে গেল পাহাড় থেকে। আধ-শুকনো নদীর খাত পেরিয়ে চলে গেল অন্য পাড়ে। সেখানে আর একটা গাছের গুঁড়িতে দড়ির অন্য প্রান্ত যতটা সম্ভব শক্ত করে বেঁধে ফিরে এল।

এরপর দড়িতে ঝুলে ঝুলে আমরা গেলাম খাদের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। তার পর পাহাড় পেরিয়ে জাম্বেজির অন্য পাশে। র‌্যাফ্টগুলো আগেই পৌঁছে গিয়েছে। সেই র‌্যাফ্টে চেপে আবার অনেকটা পাড়ি। যে পাড়ে নোঙর করলাম, সে দিকটা কিছুটা সমতল এবং বালুকাময়, তার পরে জঙ্গল এবং পাহাড়। সারা দিনে পেটে কিছুই পড়েনি। বুদ্ধি-সুদ্ধি সব গুলিয়ে যাচ্ছে। দু’দলে ভাগ হয়ে জঙ্গলে ঢুকলাম। আমার দলে ছিল রিচার্ড, জিম্বাবোয়ের স্থানীয় গাইড। ওঁর কল্যাণে শিকার করা গেল পাহাড়ি ছাগল। অন্য দল জোগাড় করেছে কিছু বুনো ফল এবং খাওয়া যায় এমন এক ধরনের গাছের পাতা। দেশলাই নেওয়া বারণ ছিল। শিকারের ছুরিতে লোহার পেরেক ঘষে আগুনের ফুলকি শুকনো পাতার ওপর ফেলে জ্বালানো হল আগুন। চাপানো হল শুকনো কাঠ। মাংসের টুকরো ছোট করে কেটে আগুনে ঝলসে ক্ষুধার নিবৃত্তি হল।

এ বার বাসস্থানের সন্ধান। জঙ্গলের মধ্যে বা পাথরের আড়ালে নিরাপদ জায়গা খুঁজে রাত কাটাতে হবে আমাদের। নদীর বেশি কাছে থাকলে ভয় কুমিরের, জঙ্গলের মধ্যে সাপ, বিছের। জঙ্গল আর বালিয়াড়ির মাঝামাঝি বড়সড় পাথরের আড়াল খুঁজে পেলাম আমি। সেখানে মেলে দিলাম আমার ম্যাট্রেস। শিকারের ছুরি খাপ থেকে বার করে হাতের নাগালে রাখলাম, প্রয়োজনে যাতে চট করে আত্মরক্ষা করা য়ায়। রিচার্ড কিন্তু গেল নদীর দিকে বালির ওপর শুতে। ঘুম বেশি গভীর হল না। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে তারায় ভরা আকাশ। শোনা যাচ্ছে জাম্বেজির স্রোতের আওয়াজ। কখনও বা গাছের পাতার।

ঘুম ভাঙল সূর্যোদয়ের সঙ্গে। কাঠের আগুন উস্কে দিয়ে গরম করা হল জল। মাপোনি গাছের পাতা ফেলে সেদ্ধ করে খাওয়া হল। রাক-স্যাক গুছিয়ে চলে এলাম নদীর পাড়ে। জাম্বেজির জলে ভেসে চলল আমাদের র‌্যাফ্ট। স্রোতের প্রকোপ কিছুটা কম। নেই আগের দিনের সেই ভয়ঙ্কর র‌্যাপিডস। ঘণ্টাখানেক চলার পরে আবার পাড়ে ভেড়ানো হল র‌্যাফ্টগুলো। জাম্বেজি এখানে ঘুরে পাহাড়ের অন্য দিকে চলে গিয়েছে। আমরা পাড়ে নেমে উঠলাম পাহাড়ে। কাঁটাগাছ আর গুল্মে ভরা খাড়া পাহাড়। বেশ কিছুটা উঠে আরও খাড়াই।

‘রক ক্লাইম্বিং’ করে পল খাড়া পাহাড়ের একদম ওপরে চলে গেল। ঝুলিয়ে দিল দড়ি। সেই দড়ি ধরে পর্বতারোহণের পদ্ধতি মেনে আমরাও উঠলাম। এরপর পাহাড়ের অন্য দিকে নামার পালা। দড়ি ধরেই নামা। পর্বতারোহণের পরিভাষায় ‘অ্যাবসেলিং’। সে দিকে তখন পৌঁছে গেছে র‌্যাফ্টগুলো। আবার শুরু দাঁড় বাওয়া। তার পর আবার খাড়া পাহাড় বেয়ে ওঠা শুরু হল। যতটা সম্ভব দ্রুত উঠতে হবে, কারণ আমাদের নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে হেলিকপ্টার। দেরি হয়ে গেলে চলে যাবে। এ যেন মহাপ্রস্থানের যাত্রা। সামনে এগিয়ে চল, তাকাতে নেই পিছনে।

অবশেষে শুকনো কাঠে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হল ধোঁয়ার সিগন্যাল। কিছু ক্ষণ পর শোনা গেল বহু প্রতীক্ষিত সেই আওয়াজ। আমাদের ফিরিয়ে নিতে আসছে হেলিকপ্টার।

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi Wildlife Zambezi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy