—বলছি তো শাড়ি আমি ঠিক ‘ট্রাই’ করব! আর নিজে যে বিয়ের শেরওয়ানির ভাঁজটাও খোলোনি!
—বাঙালির পুজোয় শেরওয়ানি! আমাদের গ্রামে সব ধুতি পরত। তু পাগল হ্যায় ক্যায়া...
দরাজ হাসিটা ডুবে যায় প্ল্যান্টের গমগম আওয়াজে। মোবাইল হাতে সোনালি ভাবেন, আ-হা রে, পুজোর ক’টা দিন যে ভাবেই হোক ছুটি ম্যানেজ করে ঘরে আসবে বলে ডবল শিফ্ট ডিউটি করছে আমার রঞ্জন।
রঞ্জন, মানে চিত্তরঞ্জন তিওয়ারি ওড়িশার আঙ্গুলের ইস্পাত প্রকল্পে ট্রেনি ইঞ্জিনিয়ার। আর সোনালি মুখোপাধ্যায় বোকারোর ডিসি অফিসের কেরানি।
কে বেশি বাঙালি মাপতে গেলে, পুরুলিয়া ঘেঁষা ঝাড়খণ্ডের পটমডার যুবকই যদিও এগিয়ে থাকবেন! ধানবাদের স্কুলে সোনালির বাংলা আর পড়া হল কই! বছরখানেক আগে সেই প্রথম ফোনটার সময়ে নিজের মানভূমি টানের বাংলার জন্য তবু কুণ্ঠিত ছিলেন চিত্তরঞ্জন। হিন্দিতেই কথা শুরু করেন।
আসল কথাটা পাড়তে অবশ্য ৭-৮ দিনের বেশি সময় নেননি ‘রঞ্জন’। আপনি বিয়ের ব্যাপারে কী ভাবছেন— শুনেই ফুঁসে উঠেছিলেন সোনালি। রেগেমেগে ফোন কেটে দেন। লোকটা তাঁকে বিয়ে করতে চাইছে!
ঝাড়খণ্ডের খনি-অঞ্চলের মেয়ের মন তো কবেই চৌচির হয়ে গিয়েছে। তবু এক যুগ ধরে তরুণী লড়াই করে চলেছেন স্রেফ একটা ‘মানুষের শরীর’ ফিরে পাওয়ার জেদে। সেটা ২০০৩। তিনটে ছেলের অসভ্য ছেড়ছাড়ের প্রতিবাদ করেছিলেন ১৭ বছরের কলেজছাত্রী সোনালি। তার পর ধানবাদে গ্রীষ্মের রাতে বাড়ির ছাদে ঘুমন্ত সোনালির মুখে-গায়ে অ্যাসিড মেরে পালিয়েছিল ওরা।
সেই তিন অভিযুক্ত— তাপস মিত্র, সঞ্জয় পাসোয়ান, ব্রহ্মদেব হাজরা এখন জামিন পেয়ে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর সোনালি বছরের পর বছর অস্ত্রোপচারের টেবিলের কাটাছেঁড়ায় মিথ্যে করে দিতে চাইছেন জীবনের সেই অভিশপ্ত রাতটাকে। বড়ই অসম লড়াই।
‘‘প্রথম তিন বছর ইঞ্জেকশন নিয়ে জিন্দা লাশ হয়ে পড়ে থাকতাম। ঘুম ভাঙলেই যন্ত্রণায় আগুন জ্বলত। কিন্তু কাঁদব কী, মুখ হাঁ-ও তো করতে পারি না।’’ অ্যাসিডে গলে দলা পাকিয়ে গিয়েছিল চামড়া। মিশে গিয়েছিল কাঁধ-গলা। পিঠ পুড়ে চলা-ফেরার ক্ষমতা নেই। খাক হয়ে যাওয়া মাথার চুল! চোখ-নাক-কান-ঠোঁট একাকার। খেতে হতো যুদ্ধ করে। রক্তে হিমোগ্লোবিন তলানিতে। ওজন কমে ২৬ কেজি হয়ে গিয়েছিল সোনালির।
তিন বছর বাদে দিল্লির সফদরজং হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরা বললেন, ‘‘না-খেলে বড় অপারেশন হরগিজ হবে না!’’ তখন মুখ হাঁ করাতে চোয়াল কেটে দেওয়া হল। গলানো চিকেন, কলা, ডিম চামচেয় ঠেলে মুখে ঢুকিয়ে দিত ছোট বোন নেহা! হাঁ-করা গালের
পাশ দিয়ে খাবার গড়িয়ে পড়ত। তখন সেখানে চেপে রাখত তুলো। প্রাণান্তকর যন্ত্রণায় কোনও মতে খাবারের দলাটা গিলে নিতেন সোনালি। মানুষের মতো বাঁচার আশায়!
বছর তিনেক আগে এই নাছোড় আশাও মরে যাচ্ছিল। ছোটখাটো চাকুরে বাবা চণ্ডীদাস মুখোপাধ্যায় বোকারোর গ্রামের জমিজমা বেচে মেয়ের লড়াই জারি রেখেছিলেন। কিন্তু জটিল প্লাস্টিক সার্জারির খরচ জোগানো কি মুখের কথা! এক দিকে রেস্ত নেই। আর কোর্টে দোষীদের বিচার নেই! এই ‘নেই-রাজ্য’ থেকেই একটা সময়ে মুক্তি চাইছিলেন সোনালি। রাষ্ট্রপতির কাছে স্বেচ্ছামৃত্যুর আর্জি জানানোর কথা ভাবছিলেন। কিন্তু ফিনিক্স পাখি ফের ডানা মেলে কিছু বন্ধুকে পাশে পেয়ে।
অ্যাসিডে পোড়া মুখ নিয়ে কখনও লজ্জা পাননি সোনালি। অমিতাভ বচ্চনের ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’র মঞ্চে গোটা দেশ দেখল এই ‘অপরাজিতা’কে। সোনালিকে নিয়ে গান বেঁধে কলকাতার অনুষ্ঠানে সাহায্যের ডাক দিলেন কবীর সুমন। জোগাড়ের টাকায় মুখে-মাথায় কৃত্রিম ভাবে টিস্যু ফুলিয়ে চলতে থাকল দুরূহ অস্ত্রোপচার। মাথার চুল ফিরে এল। গ্রাফটিং করা মাংসে তিলে তিলে ফুটে উঠল চোখ-গাল-নাক-ঠোঁটের আদল। কলকাতার পাতানো মামা শৈবাল মিত্র, ফ্রেন্ড-ফিলজফার-গাইড ‘সুব্রতদা’দের সাহায্যে বস্টনের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকেও দেখিয়ে এলেন সোনালি।
চোখের জ্যোতি এখনও ফেরেনি। তবে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ পিটপিট করে কথা বলেন টরটরিয়ে। এখনও পর্যন্ত ৩৪টা অস্ত্রোপচার হয়েছে। গোটা ছয়েক বাকি! তার আগেই জ্বালাপোড়া জীবনে মোড় নিল অবিশ্বাস্য রূপকথা।
আশ্বিনের দুপুরে বোকারোর চাস-এর ভাড়াবাড়িতে বসে সোনালি বলছিলেন, ‘‘খালি ভাবছিলাম, কী মতলব ছেলেটার! কোনও বদ ধান্দা নেই তো! নাকি দয়া দেখাচ্ছে! বিয়ে করে হিরো হতে চায়।’’ জীবনের ওপর বিশ্বাসটাই চলে গিয়েছিল যে! ‘‘আমি সত্যি ভয় পেয়েছিলাম! এই বুঝি পুলিশ পাঠাবে আমায় ধরতে।’’— হেসে ওঠেন সোনালির রঞ্জন।
সোনালির থেকে বছরখানেকের ছোট, সুদর্শন যুবক হাসতে হাসতেই শোনান রমণীর মন জয়ের উপাখ্যান! ‘‘ওকে প্রথম ফোনটা করার সময়েই মালুম হচ্ছিল, আমার ফেরার রাস্তা নেই!’’ বছর তিনেক আগে সত্যি ঘটনা অবলম্বনে টিভি-র এক ক্রাইম সোপেই প্রথম সোনালিকে দেখেছিলেন চিত্তরঞ্জন। সেখানে ওঁর নাম পাল্টে বলা হয়, ‘মিতালি দাস’। মিতালিই যে সোনালি, ইন্টারনেট ঘেঁটে তা বের করতে আরও খানিকটা সময় লেগে যায়।
বি-টেক পরীক্ষার পরে চাকরির খোঁজ করার ফাঁকে নেটে বারবার সোনালির ছবির কাছে ফিরে যেতেন তাঁর আজকের জীবনসঙ্গী। অ্যাসিডে পোড়া সোনালি আর গত জন্মের ছটফটে কিশোরীকে পাশাপাশি মিলিয়ে চেয়ে থাকতেন অপলক। এনসিসি ক্যাডেট সোনালি বা ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে নাচের পুরস্কার নেওয়া সোনালির হাসিটা তো পাল্টায়নি। মাথায় স্কার্ফ জড়ানো অ্যাসিডদগ্ধ তরুণীকে দেখতে দেখতে ভাবতেন চিত্তরঞ্জন।
ভাবতেন, এমন দুর্ঘটনা তো যে কারও সঙ্গেই হতে পারে। তা হলে মেয়েটার জীবন কেন পাল্টে যাবে? যদি সম্ভব হয়, ওর পাশে থাকব— ইচ্ছেটা তখনই দানা বাঁধতে শুরু করে।
চাকরি পাওয়ার পরেই ইন্টারনেট তন্নতন্ন করে ঘেঁটে সোনালির ফোন নম্বরটা জোগাড় করে ফেলেন চিত্তরঞ্জন। আত্মমর্যাদায় ভরপুর মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ইচ্ছেটা আরও জোর পায়। ‘‘ওর ‘ইনার বিউটি’টায় কোনও ফারাক হয়নি। ঠিক করলাম, ও রাজি না-হলে কোনও দিন বিয়েই করব না।’’ চিত্তরঞ্জনের মা-বাবা রাজি হননি এ বিয়েতে। কিন্তু পিছু হটেননি ছেলে। কড়া জেরা করতে ছাড়েননি সোনালিও। একরোখা পাণিপ্রার্থী নিজের হাল-হদিস সব তুলে দেন সোনালির ভাই দেবাশিসের হাতে, যাতে ভাল করে খোঁজখবর নিয়ে তাঁর সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন ওঁরা। বহু সাধ্যসাধনায় বোকারোয় প্রথম বার দেখা হতেও সোনালি বলেন, এ হতে পারে না! এটা পাগলামি, তুমি পারবে না রঞ্জন!
রঞ্জন হাসেন, তুমি যে একা ছাদে যাও, অফিসে কাজ করো, তরকারি কাটতে পারো, নিজের জামা ইস্ত্রি করো, নিজে নিজে এসএমএস লেখো, আমি তো তা-ও ভাবিনি! কথা শোনো! আমায় ফিরিয়ে দিলে ওই চোরের মতো হামলা করা ছেলেগুলোই জিতে যাবে!
তার পর বৃষ্টি নামে মন জুড়ে। মন বলে সোনালিকে, একেই তো খুঁজছিলাম আজীবন! ছোটবেলায় শোনা কবীরের দোঁহা গুনগুনিয়ে ওঠে হৃদয়ে, ‘কল করে সো আজ করে, আজ করে সো অব...!’ কী হবে এত ভেবে! ভয়-আশঙ্কা তো থাকবেই, তা-বলে জীবন যে পরম মুহূর্তটা দিচ্ছে, কেন ‘না’ বলব তাকে?
কোর্টে চার হাত এক হয়েছে গত এপ্রিলে। পরে বিয়ের অনুষ্ঠান। সোনালির বন্ধুদের নেমন্তন্নে এর পরে রঞ্জনকে কখনও ছুটতে হয়েছে মুম্বই, কখনও ঢাকা। সব ছুটি খতম! পুজোর কেনাকাটার কাজে গত মাসে এক বার মাত্র আসতে পেরেছেন বোকারোয়। চাসের মার্কেটে নবদম্পতির খুনসুটি ভেসে আসে! ‘‘বিয়ের পর তোমার স্টাইল বেড়েছে খুব!’’ ‘‘বেশ হয়েছে, বাড়বে না কেন?’’ মুখে মুখে লড়ে যান নতুন বৌ।
বাড়ি ফিরে বাঁ হাতের অনামিকায় বিয়ের আংটি নাড়াচাড়া করেন সোনালি। ‘‘এখনও বেশি ভিড়ে, রোদে গ্রাফটিং করা চামড়ায় খুব কষ্ট! বেশি মেকআপ বারণ। তবু ও থাকলে, কোনও অসুখ আছে সেটা ভুলে যাই।’’ সন্ধের হাওয়ার শিরশিরানিতে কত দিন বাদে উত্সবের আগমনির ছোঁয়াচ টের পান হার না-মানা তরুণী। মনের চোখে এখনও দেখেন, ছোটবেলার পুজোর গ্রাম, ছোটনাগপুরের কাশবন, নদী, সবুজ পাহাড়!
আর দু’চোখের অন্ধকার পর্দায় নড়াচড়া করে এক অদৃশ্য অবয়ব। সোনালি হাসেন, ‘‘শুনেছি খুব হ্যান্ডসাম আমার বর। আমার থেকে রঞ্জন অনেকটা টল, তাই না!’’
বিয়ের পরে প্রথম পুজোয় বরকে নিয়ে গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছেটা নড়ে-চড়ে মনের ঘরে। নারীর বোধন দেখে শরতের ছোটনাগপুর। পুড়ে যাওয়া জীবন যখন অবান্তর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy