খাগড়াগড়ের সেই বাড়ি। ফাইল চিত্র।
অষ্টমীর মাঝদুপুরে বিকট আওয়াজে গোটা পাড়া যখন কেঁপে উঠেছে, অনেকে ভেবেছিলেন, বাড়িটাতে বুঝি গ্যাসের সিলিন্ডার ফেটেছে। কিন্তু, তার পরে বাড়ির ভিতরে সব অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ। এমনকী, শিশুদের কান্নারও কোনও আওয়াজ মেলেনি।
কিছু ক্ষণ পরে বাড়ির নীচে নর্দমা দিয়ে রক্ত আর জল বয়ে যেতে দেখে সন্দেহ হয়েছিল বাসিন্দাদের। নীচের গেটে তালা লাগানো থাকায় তাঁরা চিৎকার করেন। দুই মহিলা দোতলা থেকে চিৎকার করে তাঁদের চলে যেতে বলেন। না হলে বিপদ আছে বলেও জানান। কৌতূহলী কিছু যুবক অবশ্য পাঁচিল টপকে দোতলায় উঠে দেখেন, মেঝে আর দেওয়ালে রক্ত ছড়িয়ে রয়েছে। দুই মহিলা (বিস্ফোরণ-কাণ্ডে ধৃত রাজিয়া বিবি ওরফে রুমি এবং আলিমা বিবি) একটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ বেঁধে খাটের তলার ঢোকানোর চেষ্টা করছেন। আর দু’জন জখম অবস্থায় পড়ে কাতরাচ্ছে।
বর্ধমানের খাগড়াগড়ে রাস্তার মোড়ের দোতলা সেই বাড়িটাই এখন যাবতীয় আলোচনার ভরকেন্দ্রে। বর্ধমানের মতো শহরের উপকণ্ঠে, জনবহুল এলাকার একটি বাড়িতে কী ভাবে চুপচাপ, এত দিন ধরে নাশকতার ছক কষা হচ্ছিল, সেটা ভেবেই শিহরিত স্থানীয় মানুষ। প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে অজানা নানা তথ্য উঠে আসছে সেই বাড়ি ও সেখানে বাস করা ‘রহস্যময়’ লোকেদের সম্পর্কে। বাড়ির সামনে ফাইবার গ্লাসের তিনটি জানলা সব সময় বন্ধ। ভিতরে গ্রিলের উপরে পর্দা ঝোলানো। রাস্তার দিকের একটি কাঠের জানলাও খোলা থাকতে দেখেননি এলাকাবাসী। খোলা থাকত শুধু বাড়ির পিছনের দিকের জানলার একটি অংশ। বাড়িটির দোতলায় আলো জ্বলত সব সময়।
প্রতি রাতে ১১টা থেকে ৪টে পর্যন্ত খুটখাট আওয়াজ পেতেন এলাকাবাসী। মাঝে-মাঝে ভেসে আসত কটূ গন্ধও। কিন্তু, কেউই খারাপ কিছু সন্দেহ করেননি। কারণ তাঁরা জানতেন, ওই দোতলার বাসিন্দারা সেলাইয়ের কাজ করে। রাত জেগে হয়তো সেই কাজই করছে, মনে করতেন তাঁরা। কিন্তু ঘরের মধ্যে আইইডি তৈরি হচ্ছে, তা তাঁদের কল্পনাতেও আসেনি। ২ অক্টোবর দুপুরে বিস্ফোরণের পরে তাই সকলের চোখ কপালে। যে সব গ্রেনেড উদ্ধার হয়েছে ওই বাড়ি থেকে, কোনও ভাবে সেগুলিও ফাটলে এলাকার কী হাল হতো, ভেবেই শিউরে উঠছেন তাঁরা।
ওই বাড়ির উল্টো দিকেই দোতলা বাড়ি মহম্মদ ইউনিসের। তিনি বলেন, “মাঝে-মাঝে রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখতাম, ওদের বাড়িতে সারা রাত আলো জ্বলছে। কৌতূহল হত। বাড়িতে আলোচনা করতাম, রাত জেগে ওরা কী করে।” ওই বাড়ির পিছনে টালির চালের বাড়িতে থাকেন অসীমা দাস। তাঁর কথায়, “ঠুকঠাক শব্দ হত রাতে। কিছু কাটা হচ্ছে, তা বোঝা যেত। কিন্তু ঘরের দরজা-জানলা সব সময় বন্ধ থাকায় ভিতরে কী হচ্ছে কখনও জানতে পারিনি। ওই বাড়ির বাসিন্দারা কারও সঙ্গে মিশত না।” যে জানালার অংশ খোলা থাকত, সেটির উপরে একটি লোহার পাত দেখা যেত। কয়েক জন বাসিন্দার দাবি, মাঝে-মাঝে রাতে ঘুম ভেঙে কোনও কিছু ঝালাইয়ের আওয়াজও পেয়েছেন তাঁরা। লেদ মেশিনে পাইপ কাটার আওয়াজও পেয়েছেন। মাঝে-মধ্যে ওই বাড়ির সামনে বিভিন্ন মোটরবাইক ও গাড়ি আসত। থলিতে করে জিনিসপত্র নিয়ে চলে যেত।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অবশ্য দাবি, ওই পরিবারের আচার-আচরণ নিয়ে তেমন সন্দেহ করেননি তাঁরা। তাঁদের মনে হয়েছিল, ওরা ধর্মপ্রাণ মানুষ। মহিলারা বাইরে বেরোতেন না। ছাদে কাপড় শুকোতে দিতে গেলেও তারা বোরখা পরে যেতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পড়তেন। ওই বাড়িতে দেড় বছর, এক বছর ও চার বছরের তিনটি শিশু ছিল। বিস্ফোরণের দু’দিন আগে চার বছরের শিশুটি খেলতে গিয়ে কোনও ভাবে ট্যাঙ্কের জলে পড়ে যায়। আশপাশের ছাদ থেকে পড়শিরা চেঁচামেচি করলে ওই দুই মহিলা এসে বাচ্চাটিকে তোলেন। তাকে করিমপুরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এক প্রতিবেশীর কথায়, “ওই বাড়িটা নিয়ে কৌতূহল থাকলেও সঙ্গে শিশু থাকায় ওই পরিবার কোনও খারাপ কাজে যুক্ত থাকতে পারে, এই আশঙ্কা মাথাতেই আসেনি আমাদের।”
বিস্ফোরণের পরে অবশ্য তাঁদের সব ধারণা চুরমার। বোরখা ছাড়া যে দুই মহিলাকে এলাকার লোক এক মুহূর্তের জন্যও দেখেননি, তাঁরাই কী করে নাশকতার এমন ছকে সামিল হলেন, তা নিয়ে জল্পনার শেষ নেই।
পুলিশি সূত্রের খবর, ৪২০০ টাকায় ওই ঘর ভাড়া দেন মালিক হাসান চৌধুরী। এই ক’মাসে ওই ভাড়াটেদের বিদ্যুতের বিল এসেছে ১৩০০ থেকে ১৬০০ টাকা। বাড়ির এক তলায় তৃণমূলের যে অফিসঘর ছিল, বিস্ফোরণের পরেই সেখান থেকে দলের যাবতীয় ফ্লেক্স-কাটআউট সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। রবিবার পর্যন্ত সেই ঘরের সামনে তৃণমূলের একটা পতাকা ছিল। সোমবার সেটিও খুলে ফেলা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy