Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
প্রথম প্রকাশ

লগ্নির আসল ছবি: বছরে মাত্র ১৩৭৪ কোটি

দাবি আকাশছোঁয়া। কিন্তু গত পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ৬৮৭১ কোটি টাকা। অর্থাৎ, বছর প্রতি গড়ে মাত্র ১৩৭৪ কোটি!

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:৫৪
Share: Save:

দাবি আকাশছোঁয়া। কিন্তু গত পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ৬৮৭১ কোটি টাকা। অর্থাৎ, বছর প্রতি গড়ে মাত্র ১৩৭৪ কোটি!

অথচ এই সময়ে গুজরাতে লগ্নির পরিমাণ বছরপিছু ২২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। মহারাষ্ট্রে প্রায় ১৩ হাজার কোটি। অন্ধ্রপ্রদেশে ৫৩৫০ কোটি। এমনকী, ওই সময়ে গোবলয়ের মধ্যপ্রদেশও বছরে গড়ে ৩৭৪১ কোটি টাকার বিনিয়োগ টেনেছে!

পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ-বিমুখতার ট্র্যাডিশন অনেক দিন ধরেই। জ্যোতি বসুর আমলে বছরে কয়েকশো কোটি টাকার বেশি লগ্নি আসত না। এক বছর তো অঙ্কটা নেমে গিয়ে ৮৪ কোটিতে ঠেকেছিল! পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে। তাঁর শেষ বছরে রাজ্যে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হয়েছিল। তৃণমূল জমানায় বছরপিছু লগ্নির বহর আবার পা হড়কে হাজার কোটির ঘরে নেমে এসেছে। যেটা কার্যত জ্যোতিবাবুর জমানারই সমতুল।

কেন এই হাল?

রাজ্যের শিল্প তথা অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র শুধু বাস্তবায়িত শিল্প-কারখানার পরিসংখ্যানের দিকে তাকাতে রাজি নন। তাঁর দাবি, ‘‘বামফ্রন্ট যে অবস্থায় রাজ্যটাকে ছেড়ে গিয়েছিল, সেখান থেকে লগ্নিকারীদের আস্থা ফেরানোটাই জরুরি ছিল। আস্থা ফিরেছে। বিনিয়োগও আসছে।’’ যদিও তাঁর দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১০-এর ১৫ হাজার কোটি থেকে পরের বছরেই (তৃণমূল শাসনের প্রথম বছর) রাজ্যে বিনিয়োগের পরিমাণ নেমে আসে ৩২০ কোটি টাকায়!

মন্ত্রী আরও হিসেব দিয়েছেন। বলেছেন, ‘‘পাঁচ বছরে বিভিন্ন শিল্প-পার্কে ও জেলায়-জেলায় ২৮০টি প্রকল্প শুরু হয়েছে। রূপায়ণের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে সেগুলি। এর পরিমাণ ৮০ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা। আর পাঁচ বছরে ১৮১টি প্রকল্পে ৬৮৭১ কোটি টাকার লগ্নি বাস্তবায়িত হয়েছে।’’

এবং এই সব মিলিয়ে পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গে ৮৭ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে বলে অর্থমন্ত্রীর দাবি। তিনি এ-ও জানিয়েছেন, গত পাঁচ বছরে ৭১ হাজার কোটি টাকার ‘মউ’ চুক্তি সই হয়েছে। পাশাপাশি গত বছরের বিশ্ব বাংলা শিল্প সম্মেলনে ঘোষিত হয়েছে ২ লক্ষ ৪৩ হাজার কোটি টাকার লগ্নি-প্রস্তাব।

শিল্পমহল অবশ্য অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাদের বড় অংশের মতে, গত চল্লিশ বছরে এ রাজ্যে মেরে-কেটে বার্ষিক হাজার কোটি টাকার লগ্নি-সীমা অতিক্রম করতে পিঠের শিরদাঁড়া ভেঙে গিয়েছে। সেখানে পাঁচ বছরে কী ভাবে ৮০ হাজার কোটির লগ্নি আসে, সে রহস্য হয়তো ব্যোমকেশ বক্সীও ভেদ করতে পারবেন না! অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনেরও বক্তব্য, রাজ্যে এখন শিল্প নেই। আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের উদাহরণ দিয়ে তিনি এ দিন বলেছেন,‘‘কলকাতা থেকে লন্ডনে সরাসরি বিমান পরিষেবার সংখ্যা ক্রমেই কমছে। মনে হচ্ছে, শিল্পের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণেই এমনটা হচ্ছে।’’

পশ্চিমবঙ্গে অনেকের ধারণা, লগ্নিকারীদের অনাস্থা শুধু জ্যোতিবাবু বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি নয়। পুরো রাজ্যের প্রতি। এমনিতে অলস-কর্মবিমুখ হিসেবে বাঙালিদের খ্যাতি আছে। এখানে ছুটির সংখ্যা বে‌শি। ধর্মঘট প্রায় নিয়মিত। এমনকী, জওহরলাল নেহরু কলকাতাকে ‘মিছিলনগরী’ আখ্যা দিয়েছিলেন। রাজ্যের এক প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী হুমকি দিয়েছিলেন, ব্যবসায়ীদের দিনের ঘুম-রাতের ঘুম কেড়ে নেবেন। ঘেরাও আবিষ্কৃত হয়েছে রাজ্যে। অটোমেশন ও কম্পিউটার-বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রভূমিও এই পশ্চিমবঙ্গ। এমনকী, কম্পিউটার-বিরোধী আন্দোলনের নেতারা পুরস্কৃত হয়েছেন রাজ্য মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেয়ে! বাঙালি যখন কাজ করে, তখনও তার উৎপাদনশীলতা যথেষ্ট কম
বলে অভিযোগ।

এ হেন শিল্পবিমুখতা সত্ত্বেও জ্যোতিবাবু টানা প্রায় ২৩ বছর রাজত্ব করেছেন। আর তৃণমূলের অভ্যুত্থানের পিছনেও রয়েছে মোটরগাড়ি শিল্প-বিরোধী এক আন্দোলন। রাজ্যের এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘সংস্কৃতিগত ভাবে বাঙালিরা ব্যবসা-বিরোধী।’’ তাঁর উদাহরণ—‘‘দিওয়ালিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান দিন হিসেবে ধরে লক্ষ্মীপুজো হয়। অথচ বাঙালি সে দিন কালীপুজো করে!’’

কিছু আমলার বক্তব্য, অন্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ এলাকায় চাহিদা কম। স্বাধীনতার পরে সেখানে চাহিদা তৈরির চেষ্টাও হয়নি। ফলে লগ্নিকারীরা কারখানা করার ভরসা পান না। বামফ্রন্ট আমলে দাবি করা হতো, গ্রামবাংলার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। যে তত্ত্ব
মানতে নারাজ কিছু পণ্ডিত। ওঙ্কার গোস্বামী ও তাঁর সহযোগী কিছু অর্থনীতিবিদ এক গবেষণাপত্রে বলেছেন, বামেদের এই দাবি সম্ভবত অযৌক্তিক, কেননা পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে জিনিসপত্রের বিক্রি বাড়েনি। এতে আয়বৃদ্ধির দাবি ধাক্কাই খায়।

অন্য বিষয়গুলি:

1374 crore investment yearly bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy