ত্রিহানা চা বাগান। — ফাইল চিত্র
দুপুরের সুনসান চা বাগান। শেড ট্রি’র ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো উঁকি দিচ্ছে। একটু দূরে কারখানার দরজায় বড় তালা ঝুলছে। নিরাপত্তারক্ষীরা টুল আঁকড়ে সময় কাটাচ্ছেন। পাশের শ্রমিক মহল্লার দিকে যাওয়ার পথে ধুলো উড়িয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে সনিয়া, গুড়িয়া বা বিকাশের মতো কচিকাঁচারা। মুখগুলি খুবই শুকনো। শীত পোশাকও নেই। টিন, বেড়া, ইটের খুপরি ঘর। তেমনিই একটি ঘরের সামনে উঠোনে ঘুরঘুর করছিল রোহিণী। কিশোরী কন্যা। খালি পায়ে, ছেঁড়া জামা পড়ে ঘরের দাওয়ায় বসেছিলেন তার বাবা হেমন্ত সোউরিয়া। চোখেমুখে আশঙ্কা, অসহায়তার স্পষ্ট ছাপ।
এর মধ্যেই মঙ্গলবার বিকেলে শ্রম দফতরে ত্রিহানা বাগান নিয়ে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ডাকা হয়েছে। সোমবারই ত্রিহানা বাগানের ডিভিশনগুলিতে প্রশাসনের তরফে শ্রমিক পিছু ২৪০ টাকা করে এককালীন ভাতা দেওয়া হয়েছে। এর আগে শ্রমিকদের চাল ও কম্বল দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে মেটেনি অভাব।
এখনও পাথুরে রাস্তায় রোহিণীর ভাই, সাত বছরের ইশান প্রশ্ন করে, ‘‘খিদে পেয়েছে তো। মা কখন আসবে?’’ রোহিণী এগিয়ে এসে বলল, ‘‘সকালে আলুভাত খেয়েছিস না!’’ বহু পুরানো নীল রঙের জাম্পারের পকেট থেকে দু’টি বিস্কুট বের করে ভাইকে দিয়ে বলল, ‘‘এখন এটা খা। দেখ, বাবাও তো ভাল করে খায়নি। মা আসুক, কিছু একটা হবেই।’’
হেমন্ত সোউরিয়ার স্ত্রী লালিদেবী। তিনি এখন তরাইয়ের ত্রিহানা বাগানে চা পাতা তোলা ছেড়ে বেংডুবিতে বালি-পাথর তুলছেন। কতৃর্পক্ষ বাগান ছেড়ে চলে যাওয়ায় বাইরে কাজে যেতে বাধ্য হয়েছেন। রোহিণী বলে, ‘‘ঘরের টাকা শেষ। বাবার শরীর ভাল না। তাই মা কাজ করছে। সন্ধ্যায় মা কিছু টাকা নিয়ে এলে দোকানদার চাল, আলু দিতে পারে। নইলে ঘরে যে কয়েক মুঠো চাল আছে, তাই দিয়েই চালাতে হবে।’’
মেয়ের কথা এক মনে শুনছিলেন হেমন্ত সোউরিয়া। এতক্ষণে বললেন, ‘‘দোকান, বিদ্যুৎ বিল, ছেলের স্কুল ফি— সবই বাকি। লালিকে বাইরের কাজে যেতেই হল। ১৩০/১৪০ টাকা হয়তো পাবে। দুই-এক দিন চলবে।’’
একটু এগিয়ে বাসক গাছের বেড়ার ফাঁকে টিনের ছোট্ট ঘর রাধা সোউরিয়ার। পরিবার বলতে একমাত্র মেয়ে নিকিতা। ঘরের দাওয়ায় বসে আছেন দু’জনে, হাতে আধার কার্ড। কিছুক্ষণ আগে ব্লক অফিসের লোকেরা নাম তুলতে এসেছিলেন। লাইন দিয়ে সরকারি খাতায় নাম তুলেওছেন। নিকিতা জানতে চাইল, ‘‘মা, এই কার্ড দিয়ে কি চাল-ডাল দেবে?’’ রাধাদেবীর আশ্বাস, ‘‘কিছু তো একটা দেবে। নইলে আমি কাজে যাব। তুই একা থাকতে পারবি না?’’ মাথা নামে কিশোরী কন্যা। দুপুরে দু’মুঠো ভাতের সঙ্গে আচার ছিল আজ। থালা চেটে তা-ই খেয়েছে সে।
সকাল থেকেই বাগানে ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন রাজেন্দ্র রউতিয়া, সাকিল খেয়রেরা। রাজেন্দ্র জানান, কেউ দোকানে ধার করছেন। কেউ বা পরিচিতদের কাছ থেকে ২০০-৪০০ টাকা এনেছেন। বেশির ভাগের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও নেই। ক’দিন দেখি, নইলে বাইরে কোথায় মজুরের কাজ করতে হবে। খেয়ে বাঁচতে তো হবে। বড় রাস্তার পাশে পুরানো হাফ সোয়েটার পরে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলেন রমেশ বিশ্বকর্মা। চোখ নিঝুম ফাঁকা বাগানের দিকে। বললেন, ‘‘ঘরে ঘরে খাবার বাড়ন্ত। এমন চললে, তো হাসপাতালেও লাইন পড়বে।’’
নোট বাতিলের পরে খুচরো টাকার সমস্যার কথা বলে বাগান ছাড়েন ত্রিহানা কতৃর্পক্ষ।
পাঁচ সপ্তাহের মজুরি বকেয়া থাকলেও কতৃর্পক্ষ দিয়ে গিয়েছে এক সপ্তাহের মজুরি। তা দিয়েই টেনেটুনে চলছে শ্রমিক মহল্লার পরিবারগুলির। ত্রিহানা’র মূল ডিভিশন, জাবরা ও মোহনলাল ডিভিশন মিলিয়ে দু’হাজারের মতো শ্রমিক। স্থায়ী, অস্থায়ী মিলিয়ে। কমবেশি সব পরিবারেই এক দশা।
শুধু পেটই একমাত্র শত্রু নয়। সন্ধ্যা নামলে বন্ধ কারখানার চত্বর জুড়ে অন্য আশঙ্কা খেলা করে। তাই দিনের আলো ফুরতেই রাস্তায় থাকা এক দল কিশোরীকে ডেকে রাজেন্দ্র বললেন, ‘‘ঘরে যা সবাই। বাগানের পরিবেশ ভাল নয়।’’ তার পর মুখ ফিরিয়ে বিড়বিড় করলেন, ‘‘ভোরের আলো হয়তো ভাল খবর আনবে!’’
ত্রিহানা বাগানে এখনও সেই ভোর আসেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy