ভোট আসে ভোট যায়। নকশালবাড়ির বাজারের হাল রয়ে যায় এমনই। সন্দীপ পালের তোলা ছবি।
নন্দপ্রসাদ স্কুলের সামনে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরের একটি ঢাউশ বোর্ড। লোহার খুঁটিতে বসানো সেই বোর্ডে স্কুলের পাঁচিল তৈরির প্রকল্পের নাম, বরাদ্দ লেখা।
নকশালবাড়ি ব্লক জুড়েই এমন পেল্লায় সব বোর্ডে পাকা রাস্তা, কালভার্ট সহ নানা প্রকল্পের নাম বরাদ্দের ঘোষণা। স্কুলের সামনে লাগানো বোর্ডের পাশেই টেবিলে চিপস, চকোলেট সাজিয়ে বিক্রি করেন লক্ষ্মী সিংহ। তাই দিয়েই সংসার চলে। সংসার বলতে তিনি এবং তাঁর একত্রিশ বছরের প্রতিবন্ধী ছেলে দেবাশিস। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ভোটের ইভিএম মেশিন পরীক্ষা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি নানা প্রস্তুতির জন্য আপাতত নকশালবাড়ির নন্দপ্রসাদ বালিকা বিদ্যালয়ের নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে না। তাই চকোলেট, চিপসেরও বিক্রি নেই।
রায়পাড়ায় মাটির রাস্তার পাশে টিনের চালের একটি ঘর। সেই ঘরেই থাকেন লক্ষ্মী দেবী তাঁর মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলে দেবাশিস। ভোটের কথা শুনেই ঘরের দাওয়ায় বসে হতাশা উগরে দিলেন। বললেন, ‘‘প্রতিবারই ভোট দিই। কিন্তু সরকার থেকে কিছুই তো পাই না। উল্টে ভোট এলেই কয়েকদিনের জন্য স্কুল ছুটি হয়ে যায়, আমার রোজগারও বন্ধ হয়ে যায়।’’
লক্ষ্মীদেবীর আক্ষেপ, ‘‘আগের সরকারের সময়েও, বিপিএল তালিকায় নাম ওঠেনি। এই সরকারের সময়েও তালিকায় আমরা নেই। কয়েক বছর আগে একশো দিনের কাজ পেয়েছিলাম, এখন তাও বন্ধ।’’ কিছুক্ষণ থমকালেন। স্মৃতি হাতড়ে জানালেন, সরকারি সাহায্য মোটেই পাননি এমনটা নয়। বেশ কয়েকবছর আগে ঝড়ে ঘর ভেঙে যাওয়ায় ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন। তা দিয়ে ঘরে টিন লাগিয়েছেন।
ব্লক জুড়ে উন্নয়নের নানা প্রকল্পের খতিয়ান দিয়েও খুব একটা স্বস্তিতে নেই তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। তৃণমূলের জেলা কমিটির নেতা এবারের পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী অমর সিংহের কথাতেও ফুটে উঠেছে সেই অস্বস্তি। তাঁর কথায়, ‘‘এবারে গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে পঞ্চায়েত সমিতি, মহকুমা পরিষদ সবেতেই আমরা জিতব, তখন সামগ্রিক উন্নয়নের কাজ হবে।’’
বিরোধীরা অবশ্য পাল্টা দাবি করে বলছে, রাজ্যে পরিবর্তনের পরে পঞ্চায়েতের তিন স্তরেই দলবদল করে ক্ষমতা দখল করেছিল তৃণমূল। যে অমরবাবু এখন ব্লকে তৃণমূলের অন্যতম সেনাপতি, গত পঞ্চায়েত ভোটে তিনি-ই ছিলেন কংগ্রেসের মুখ। দু’হাজার এগারো সালে অমরবাবু সদলবলে তৃণমূলে যোগ দেন। তার পরেই বদলে যায় গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি এবং পঞ্চায়েত সমিতির ক্ষমতাও। স্বাভাবিকভাবেই, অনুন্নয়নের দায় এখন তৃণমূলের দিকে ঠেলছে কংগ্রেস-বামেরা। ভোট নিয়ে জানতে উৎসুক সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের দেখলেই কংগ্রেস নেতা উজ্জ্বল দাস ডেকে বলছেন, ‘‘বাসিন্দাদের হাল দেখতে হলে একবার তেঁতুলতলা ঘুরে আসুন। অমরবাবুদের চোখে এখন সে সব পড়ে না।’’
আম, কাঁঠাল নানা গাছগাছালিতে ঘেরা তেঁতুলতলা। সেখানেই দেখা মিলল আরেক লক্ষ্মী দেবীর। আশ্বিনের শুরুতেও বৃষ্টির বিরাম নেই। সকাল থেকেই আকাশকে গালমন্দ করে চলেছেন লক্ষ্মী সাউরিয়া। উঠোনে ভিজে জ্বালানি কাঠ শুকোতে দিয়েছেন সত্তর ছুঁইছুঁই বৃদ্ধা। টিন আর দরমার ঘরে তিনি একাই থাকেন। বিপিএল তালিকায় নাম রয়েছে। কিন্তু ইন্দিরা আবাসের ঘর পাননি। বার্ধক্য ভাতার তালিকাতেও তাঁর নাম নেই বলে দাবি করলেন। বললেন, ‘‘রেশন কার্ড ছাড়া কিছু পাইনি। কতজনকেই তো বললাম। এখন আর কেউ খোঁজ নিতেও আসে না।’’
অনুন্নয়নের অভিযোগের সঙ্গে তৃণমূলকে তাড়া করছে দলের নানা গোষ্ঠী সমীকরণও। অমরবাবুর বিরুদ্ধেই দলের এক সমর্থক নির্দল হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছেন। ২০১১ সালের আগে ব্লকে তৃণমূলের অস্তিত্ব ছিল না বলে দাবি করছেন অমরবাবুও। এবারের ভোটে যে তাঁদের অনুগামীরাই টিকিট পেয়েছেন তাও সরাসরি জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা ব্লক থেকে যে তালিকা তৈরি করে দিয়েছি, জেলা নেতারা তাই মেনে নিয়েছেন।’’ এতেই ক্ষোভ দানা বেঁধেছে দলের অন্দরে। এলাকার এক পুরোনো নেতার কথায়, ‘‘যাঁদের বিরুদ্ধে জমি দখল থেকে শুরু করে, চোরাকারবারির অভিযোগ রয়েছে। যারা ক্ষমতার জন্য দলে এসেছে, তারাই এখন নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়।’’ তাই দলের জনসভায় সব গোষ্ঠীর নেতাদের দেখা গেলেও, স্বস্তিতে নেই অমরবাবুরা। বিরোধীদের অভিযোগ, সেই অস্বস্তি দূর করতেই আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে তৃণমূল। মাটিগাড়ি-নকশালবাড়ির কংগ্রেস বিধায়ক শঙ্কর মালাকার বলেন, ‘‘নিজেদের বিপদ বুঝে তৃণমূল এখন পুলিশ দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে, হুমকি দিচ্ছে। যদি অবাধ ভোট হয়, তবে নকশালবাড়ি ব্লকে আমাদের জয় নিশ্চিত।’’
ব্লক কংগ্রেস সভাপতি অমিতাভ সরকারের কথায়, ‘‘আমরা কোনও হুমকিতে ভয় পাই না। তৃণমূলকে ঠেকাতে সকলে মিলে লড়ব।’’ সকলে মিলের অর্থ অবশ্য অমিতাভবাবু প্রকাশ্যে খোলসা করতে রাজি নন। তবে নকশালবাড়িতেও শিলিগুড়ির ছায়া পড়েছে বলে দাবি বিরোধীদের একাংশের। বিজেপির জেলা কমিটি সদস্য তথা নকশালবাড়ি ব্লকের নেতা মনোরঞ্জন মণ্ডল অবশ্য খোলাখুলি বলছেন, ‘‘তৃণমূলকে ঠেকাতে নীচু তলায় কিন্তু বিরোধীদের জোট হয়েছে। আমরা অবশ্য সেই জোটে নেই। তবে স্থানীয় স্তরে কোনও সমঝোতা হলে, জানা নেই।’’
বিরোধী জোট প্রসঙ্গে শঙ্করবাবু বললেন, ‘‘পঞ্চায়েতস্তরে আশির দশক থেকেই আমরা নানা জোট দেখেছি। সেই মতো স্থানীয় স্তরে জোট হতেই পারে।’’
‘শিলিগুড়ি মডেল’ এর প্রবক্তা অশোকবাবুর নকশালবাড়িতে আনাগোনাও রক্তচাপ বাড়িয়েছে তৃণমূল নেতাদের। ব্লকের নেতারা জানালেন, জেলা কমিটিকে জানানো হয়েছে, বড় জনসভার কোনও প্রয়োজন নেই। বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বিরোধীদের জোট নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করতে হচ্ছে। অমরবাবুর কথায়, ‘‘চোরাকারবারিদের সঙ্গে দলের কোনও সম্পর্ক নেই। বিরোধীরাই তো নীতিহীন জোট করেছে। ’’
সিপিএমের নকশালবাড়ি ব্লকের নেতা তথা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গৌতম ঘোষ বলেন, ‘‘আমাদের সময়ে যা কাজ হয়েছে, বাসিন্দারা জানেন। তৃণমূল তো সব প্রকল্পের নাম নিয়ে সাইনবোর্ড করেছে, সিংহভাগ প্রকল্পই দিনের আলো দেখেনি। উন্নয়ন শুধু সাইনবোর্ডে হয়েছে।’’
আগের বারের পঞ্চায়েত ভোটে তিনস্তরে কোনটিতেই নকশালবাড়ি ব্লকের সব আসনে তৃণমূল প্রার্থী দেয়নি। সে হিসেবে এবার নকশালবাড়ির পিচে তৃণমূলের প্রথম ইনিংস। শুরুর ইনিংসেই অনুন্নয়ন, গোষ্ঠী সমীকরণ, জমির দালালি-চোরাকারবারী এবং শিলিগুড়ি মডেলের মতো একের পর এক বাউন্সারের মুখোমুখি তৃণমূলের প্রার্থীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy