Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

মন্দিরের টাইগারের মরণ, কাছিমের জন্য জিয়নকাঠি

তাইল্যান্ডের ‘টাইগার টেম্পল’-এ যখন ফ্রিজ থেকে উদ্ধার হল ৪০টি বাঘের ছানার দেহ, কোচবিহারে তখন কাছিমদের ভাল রাখতে কোনও কিছুই বাদ রাখছেন না মন্দির কর্তৃপক্ষ। যার জন্য তাঁরা অস্ট্রিয়ার একটি সংস্থার কাছ থেকেও বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়েছেন। কাজও করছেন সেই পরামর্শ মতো।

বাণেশ্বরের মন্দিরের পুকুরে কচ্ছপের দল। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।

বাণেশ্বরের মন্দিরের পুকুরে কচ্ছপের দল। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।

নমিতেশ ঘোষ
কোচবিহার শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৬ ০৩:২৫
Share: Save:

তাইল্যান্ডের ‘টাইগার টেম্পল’-এ যখন ফ্রিজ থেকে উদ্ধার হল ৪০টি বাঘের ছানার দেহ, কোচবিহারে তখন কাছিমদের ভাল রাখতে কোনও কিছুই বাদ রাখছেন না মন্দির কর্তৃপক্ষ। যার জন্য তাঁরা অস্ট্রিয়ার একটি সংস্থার কাছ থেকেও বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়েছেন। কাজও করছেন সেই পরামর্শ মতো। কোচবিহারে ওই কচ্ছপরা মোহন নামে বিখ্যাত। মোহনদের বাঁচাতে এক সময় এমনকী একটি সংগঠনও গড়ে ফেলেছিলেন এলাকার মানুষ।

তাইল্যান্ড থেকে বাণেশ্বরের দূরত্ব কয়েক হাজার কিলোমিটারের। দূরত্ব তাদের পরিচয়েও। তাইল্যান্ডের টাইগার টেম্পলের নাম জানে না, এমন লোকের সংখ্যা হাতে গোনা। আবার বাণেশ্বরের শিবমন্দিরের খবর রাখেন, এমন লোকের সংখ্যাও আঙুলে গুনে ফেলা যায়! পর্যটন মানচিত্রের কয়েকশো কিলোমিটারের মধ্যেও নেই কোচবিহারের এই মন্দির। সম্প্রতি টাইগার টেম্পলে যা ঘটেছে, তাতে ধুলোয় মিশে গিয়েছে তাদের বাঘ-প্রেম। প্রথমে মন্দিরের ফ্রিজ থেকে বেরোল ৪০টি বাঘের ছানার দেহ। তার পরে এক ট্রাক পূর্ণ বয়স্ক বাঘের চামড়া সরাতে গিয়ে ধরা পড়লেন মন্দিরের এক সন্ত।

এই জায়গাতেই ব্যতিক্রম বাণেশ্বর। এখানকার পুকুরটির পাড় এক সময় সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পুকুর পাড় বাঁধানো পরিবেশের পক্ষে খারাপ। পুকুরে মাছ বা অন্য জলজ প্রাণীর সঙ্গে যে কচ্ছপরা রয়েছে, তাদের জীবনধারণ তো বটেই, এমনকী ডিম পাড়ার জন্যও সিমেন্টের বাঁধানো অংশ ভেঙে ফেলা দরকার ছিল। বস্তুত, বছর পাঁচেক আগে এই পাড় বাঁধানোর পর থেকেই কচ্ছপদের মধ্যে তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। পরপর কচ্ছপ মরতে থাকে। সে সময় মোহন রক্ষা কমিটি গড়ে আন্দোলন করেন স্থানীয় মানুষ। সেই চাপেই শেষে কংক্রিটের পাড়টি ভেঙে ফেলা হয়। পুকুরের ধারগুলি আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। চোরাকারবারীরা যাতে কেউ এলাকায় ঢুকতে না পারে, সে জন্য রয়েছেও
সদা নজরদারি।

এর কয়েক বছর পরে বাণেশ্বরের পাশে এসে দাঁড়ায় অস্ট্রিয়ার একটি সংস্থা। ওই কাছিমকূলের খবর পেয়ে প্রাণী চিকিৎসকদের নিয়ে তাদের সদস্যরা হাজির হন এখানে। কী ভাবে কাছিমদের সুস্থ রাখা যায়, তা নিয়ে মন্দির কর্তৃপক্ষকে পরামর্শও দিয়েছেন তাঁরা। কী সেই পরামর্শ?

প্রথমেই ওই বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কচ্ছপদের জন্য সব থেকে ভাল খাবার ভাত। সেই কথা মেনেই এখন রোজ ছ’কেজি করে ভাত দেওয়া হয় তাদের। বর্ষাকালে এর সঙ্গে থাকে কেঁচো, গুগলি। আগে বাইরের লোক এসে খাবার দিত পুকুরে। এখন তা-ও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি ছ’মাস অন্তর জলে পাঁচশোটি অক্সিজেন ট্যাবলেট দেওয়া হয়। এর ফলে জলে অক্সিজেনের ঘাটতি পূরণ হয় কিছুটা। এ ছাড়া প্রজননের জন্য পুকুর পাড়ে বালি, কুচো পাথর ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। রয়েছে ছোট ছোট কয়েকটি ঝোপ।

কোচবিহার দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী জয়ন্ত চক্রবর্তী বলেন, “অস্ট্রিয়ার সংস্থাটির প্রতিনিধিরা ইতিমধ্যে দু’বার এসেছেন এখানে। তাঁরা নিজেরা সব দেখে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। অসুবিধে হলে জানাতে বলেছেন। জানিয়েছেন, দরকারে আবার আসবেন।’’ দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ডের সদস্য তথা কোচবিহার সদরের মহকুমাশাসক অরুন্ধতী দে বলেন, “বাইরের খাবার পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।” একই কথা জানিয়ে মোহন রক্ষা কমিটির নেতা পরিমল বর্মন বলেন, “এখন যাতে কোনও অসুবিধে না হয় সে দিকে নজর রাখছি।”

এত কিছুর ফল মিলেছে হাতেনাতে। এখন ছোটবড় মিলিয়ে আড়াইশোর বেশি কচ্ছপ রয়েছে এই পুকুরে। দিনহাটা কলেজের প্রাণীবিদ্যার শিক্ষক মঞ্জিল গুপ্ত বলেন, ‘‘প্রাকৃতিক পরিবেশ পেলে কচ্ছপের সংখ্যা তো বাড়বেই।’’

এখানে কচ্ছপ এলো কী করে, তা নিয়েও নানা কাহিনি রয়েছে। ইতিহাসবিদ দেবব্রত চাকী জানান, সপ্তদশ শতকে মোঘল সেনাপতি মিরজুমলা যখন কোচবিহার আক্রমণ করেছিলেন, সেই সময় বাণেশ্বর শিবমন্দিরটি প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এর কয়েক বছর পরে কোচবিহারের মহারাজা প্রাণনারায়ণ এই মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করে দেন। তখনই পুকুরটি খোঁড়া হয়। সম্ভবত সেই সময় থেকেই এখানে কাছিম রয়েছে। বিষ্ণুর দশাবতারে দ্বিতীয় অবতার কুর্ম।

সেই সূত্র ধরেই কুর্ম বা কচ্ছপের পুজো হয় এখানে। তবে এই কচ্ছপরা (যারা কোচবিহারে মোহন নামেই বিখ্যাত) কোথা থেকে এল, তা নিয়ে হলফ করে কেউ কিছুই বলতে পারেননি। কারও মতে, ভুটানের সঙ্গে এক সময় কোচবিহারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ভুটান সংলগ্ন অঞ্চল থেকেই কাছিমরা কোনও সময় এ দিকে চলে এসেছিল। কোচবিহার হেরিটেজ সোসাইটির সম্পাদক অরুপজ্যোতি মজুমদারও প্রায় একই কথা বলেছেন।

কিন্তু এই প্রাচীন মন্দির বা তাকে ঘিরে এমন কাছিম-কাহিনি তুলে ধরে পর্যটনের কোনও ব্যবস্থা এখনও হয়নি এখানে। বাসিন্দাদের অনেকেরই সেই আক্ষেপ রয়েছে। তবে প্রাণীসম্পদ রক্ষায় তাইল্যান্ডের টাইগার টেম্পলকে অনেক পিছনে ফেলে দেওয়ায় তাঁরা খুশি। তাঁদের এখন একটাই বক্তব্য, ‘‘মোহনরা আমাদের সম্পদ। তাঁদের আমরা এ ভাবেই রক্ষা করব।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Turtles Baby tigers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy