অতিথি দেব ভব। আর কিছু না জুটুক সামান্য ডাল-ভাত-সব্জি খাইয়ে অতিথি সৎকারে চিরাচরিত বাঙালি প্রথায় বোধহয় দাঁড়ি পড়তে চলছে। এখন অতিথির পাতে মহার্ঘ ‘ডাল’ দিয়ে ভাত দেওয়ার বদলে ‘চিকেন-ভাত’ দামে সস্তা পড়ছে। আসলে ডাল এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর লাগাম ছাড়া মুল্যবৃদ্ধিই এর জন্য দায়ী।
কিন্তু অতিথি সৎকারের তো এক রকম ব্যবস্থা হল, আর দেবতার জন্য? সাম্প্রতিক কালে জিনিসপত্রের বেলাগাম মুল্যবৃদ্ধিতে সব চেয়ে বিপাকে পড়েছেন মঠমন্দির কর্তৃপক্ষ। নবদ্বীপ মায়াপুরের কয়েকশো মঠ-মন্দিরে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ দেবতার নিরামিষ ভোগ প্রসাদ হিসাবে খেয়ে থাকেন। উৎসব বা পর্যটনের মরশুমে তো কথাই নেই। চাল-ডাল-তেল-চিনি এবং নানা ধরনের শাকসব্জি দিয়েই প্রধানত মঠমন্দিরের ভোগ হয়। প্রায় প্রতিটি জিনিসের দাম কয়েক মাসের মধ্যে অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে চাপে পড়ছেন সকলে। এই অবস্থায় কেউ বাড়িয়ে দিয়েছেন ভোগের মালসার দাম তো কেউ আবার দাম একই রেখে কমিয়ে দিয়েছে পদের সংখ্যা।
ঠাকুরবাড়ির ভোগ বলতে যারা শুধুই খিচুড়ি-পায়েস-মালপোয়া বোঝেন তাঁদের জানিয়ে রাখা ভাল, মঠ-মন্দিরের প্রতি দিনের ভোগের পদ পদে কচুর শাক, মোচা, থোর থেকে মরশুমি সব্জি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাদ যায় না সজনে ফুল, বক ফুল, নিমপাতাও। সঙ্গে দু’-তিন রকমের ডাল, পনির, ছানা, ধোঁকার তরকারি, নানা রকম ভাজা। সঙ্গে সাদা অন্ন, পোলাও, পায়েস দেওয়া বাধ্যতামূলক আর এই ষোড়শপচারে নিত্য দিন দেবতার ভোগ সামলাতে নাজেহাল কর্তৃপক্ষ। নবদ্বীপে বেশ কিছু মন্দির আছে যেখানে প্রায় প্রতি দিনই নানা অনুষ্ঠান উপলক্ষে দু’-পাঁচশো লোক প্রসাদ খান। শ্রাদ্ধ, অন্নপ্রাশন বা পৈতের মতো অনুষ্ঠানে এই সব মন্দিরে প্রসাদ খাওয়ানো একটা চালু রেওয়াজ। সেই সব মন্দিরে প্রসাদের দাম বেড়েছে এক মাস থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে। যেমন গোরাচাঁদের আখড়ার বাসুদেব চৌধুরি বলেন, “৯০ টাকার মুগডাল বেড়ে ১৩০ টাকা কেজি হয়েছে। ১০৫ টাকা কেজির সর্ষের তেল ১২০-১৩০ টাকা। আমরাও বাধ্য হয়েছি প্রসাদের দাম বাড়াতে।” ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৯০ টাকা।
ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দির পরিচালন সমিতির সম্পাদক জয়ন্ত গোস্বামী জানিয়েছেন “মূল্যবৃদ্ধির জন্য বাড়াতে হয়েছে প্রসাদের দামও। ছিল ৯০ টাকা, বেড়ে হয়েছে ১১০ টাকা। যে মাটির পাত্রে ভোগ দেওয়া হয় সেটির দাম ছিল ১২ টাকা, বেড়ে হয়েছে ২০ টাকা।”
মহাপ্রভুর জন্মস্থান মন্দিরের প্রধান অদ্বৈত দাস বলেন, “সাধারণ দিনে কমপক্ষে দু’শো লোক প্রসাদ পান। সদ্য সমাপ্ত ঝুলন বা জন্মাষ্টমীর মতো বৈষ্ণবীয় উৎসবে সংখ্যাটা হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বাজারের যা দাম তাতে নিরুপায় হয়ে প্রসাদের দাম ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা নিতে হচ্ছে। শাক-সব্জি থেকে আলু-চাল সবের দাম তো কেবল উপর দিকেই চড়ছে।”
আবার কেশবজী গৌড়ীয় মঠের মঠাধক্ষ্য মধুসূদন মহারাজ জানান তাঁরা কমিয়েছেন ভোগের পদ। তবে প্রসাদের মূল্যের কোনও বদল ঘটেনি। তিনি বলেন, “সাধারণত চার পদের সব্জি দেবতার নিত্য ভোগে দেওয়া হতো। সেটা কমিয়ে এখন দু’টো করা হয়েছে।” কেশবজি গৌড়ীয় মঠের প্রসাদ (দাম একই আছে কমেছে প্রসাদের পদ) সাদা অন্ন, ডাল, এক রকম ভাজা, মরশুমি সব্জির তরকারি, পায়েস। বাদ গিয়েছে ছানা বা পনিরের তরকারি এবং দু’রকম সব্জির পদ।
নবদ্বীপ হরিসভা মন্দিরের প্রধান বিবেকবন্ধু ব্রহ্মচারী বলেন, “আমরা এখনও একশো টাকাতেই প্রসাদ দিচ্ছি, তবে বাজার যদি না নামে তা হলে কত দিন দিতে পারব জানি না। ভোগে দু’রকম ডাল কমপক্ষে দিতে হয়। তিতো ডাল এবং সাধারণ ডাল। কিন্তু সব চেয়ে দাম বেড়েছে ওই ডালেরই।”
বাজারের দর দেখে অনেকেই বিকল্প ব্যবস্থাও করছেন। নবদ্বীপ মোহান্ত বাড়ির বাবু মোহান্তের কথায়, ‘‘অস্বাভাবিক দামের জন্য ভোগে এক নম্বর সোনা মুগডালের ব্যবহার প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছে।’’ অনেক মন্দিরে ছোলার ডালের ব্যবহার বেড়েছে। তবে তাতেও যে খুব সাশ্রয় হচ্ছে, এমন নয়। ৮০ টাকার ছোলার ডালের কেজি বেড়ে হয়েছে ১২০-১৩০ টাকা। ৩৬-৩৮ টাকা কেজির চিনি বেড়ে হয়েছে ৪৪-৪৫ টাকা। মুদিখানার যাবতীয় মশলার দাম গড়ে ২০ শতাংশ বেড়েছে। কাঁচাসব্জির বাজারে মরশুমি পটল, ঝিঙে, বেগুন ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। জ্যোতি আলু ২০ টাকা, চন্দ্রমুখী ২৬-২৮ টাকা। পেঁপে, কুমড়ো, চালকুমড়ো ২০ টাকা।
তবে জিনিসপত্রের এমন লাগামছাড়া দামে কী ভাবে যে এর পর চলবে, তা নিয়ে চিন্তা যাচ্ছে না কারওরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy