Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪

‘যখের বাক্স’ খুলে দেখলেন থরে থরে টাকা, কিন্তু সব অচল! মাথায় হাত বৃদ্ধের

এ যেন গ্রিক রূপকথার গল্প— প্যান্ডোরার বাক্স।গ্রিক পুরাণ মতে দেবতা জিউস সৃষ্টি করেছিলেন প্রথম মানবী প্যান্ডোরাকে। তাঁকে একটি বাক্স উপহার দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘কখনও খুলো না এটা।’’

বাতিল নোট হাতে খালেক। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।

বাতিল নোট হাতে খালেক। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।

বিমান হাজরা
রঘুনাথগঞ্জ শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:৪৯
Share: Save:

এ যেন গ্রিক রূপকথার গল্প— প্যান্ডোরার বাক্স।

গ্রিক পুরাণ মতে দেবতা জিউস সৃষ্টি করেছিলেন প্রথম মানবী প্যান্ডোরাকে। তাঁকে একটি বাক্স উপহার দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘কখনও খুলো না এটা।’’ হাজার লোভ হলেও বাক্সের মুখ খোলেনি সে। স্বামী এপিমিথিউসকেও সাবধান করে সে— ‘‘বাক্স খুললেই সর্বনাশ।’’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত একদিন সে নিজেই খুলে ফেলে সেই বাক্স।

পৃথিবীতে সর্বনাশের শুরু তখনই। বাক্স খুলতেই বেরিয়ে হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়ে ভিতরে ঠাসাঠাসি করে থাকা হিংসা-অপরাধ-দ্বেষ-ঘৃণারা।

জঙ্গিপুরের মির্ধাপাড়ার বৃদ্ধ মহম্মদ আব্দুল খালেক গ্রিক পুরাণের এই গল্প জানেন না। কিন্তু তাঁর বাক্সও যে আজ প্যান্ডোরার বাক্সই। যে বাক্স খুলতেই বেরিয়ে পড়েছে ক্ষোভ, হতাশা, আর যন্ত্রণা। তাঁর বাক্সের মধ্যে বালিশের খোলে যে তাড়া তাড়া বাতিল নোট। আজ যা নেহাতই কাগজের টুকরো।

হেমন্তের পর শীত এসে ফিরে গিয়েছে। দেশ তোলপাড় করা নোট বাতিলের খবর জানতে পারেননি মূক ও বধির বৃদ্ধ খালেক। যার নিট ফল ক্ষুন্নিবৃত্তি করে সংসার চালানো খালেকের ঘরে এখন ৬৩ হাজার টাকা। ৮০টি ৫০০ এবং ২৩টি ১০০০ টাকার বাতিল নোট!

তাঁর ওই টাকায় যে এক ছটাক চালও যে কেনা যাবে না তা বেশ বুঝেছেন। তার পরেই দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছেন। বাঁচিয়েছেন তাঁর বৃদ্ধা স্ত্রী গোলনেহার বিবি। তিনিও জানতেন না যে, স্বামীর বাক্সে এতগুলো বাতিল নোট পড়ে রয়েছে। আর জানবেনই বা কী করে, খালেকের সন্তানরাই বলছেন, ‘‘আব্বা বাক্সের তালা খোলার সময় সবাইকে ঘর থেকে বের করে দিতেন। চাবি থাকত তাঁর কোমড়ের ঘুনসিতে।’’ স্ত্রী পাঁচ মেয়ে, এক ছেলের সংসার খালেকের। খাতায় কলমে তিনি ৯০ শতাংশ প্রতিবন্ধী। তার জন্য মাসে ৬০০ টাকা ভাতা পান। গোলনেহার বিড়ি তৈরি করে কিছু উপায় করেন। সন্তানদের সকলেই বিবাহিত। ছেলের পৃথক সংসার। মেয়েরা এলে খালেকের হাতে গুঁজে দিতেন দু’-একশো। তাতেই কোনও রকমে চলত সংসার। খালেক নিজেও অনুষ্ঠানবাড়িতে এটা সেটা করে কিছু আয় করতেন। সেই টাকাই তিনি জমিয়েছিলেন। কাউকে না জানিয়ে তা যক্ষের মতো আগলে রেখেছিলেন জং ধরা টিনের বাক্সটাতে।

গোলনেহার বলছেন, “বোবাকালা মানুষ। চলতেন নিজের খেয়ালে। টিনের বাক্সের তালার চাবি কখনও কাছছাড়া করতেন না। বেশি কিছু বলতে গেলে রেগে গিয়ে পাগলামি করতেন। তাই কিছু বলতাম না। ভাবতাম কী-ই বা আর থাকবে!’’

কাছাকাছি শ্বশুরবাড়ি এক মেয়ে কামেলা বিবির। তিনি বলছেন, “আমার বিয়ের সময় একটা সাইকেল দেওয়ার কথা ছিল। বাবাকে বলা হলে, তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর টাকা নেই। শেষ পর্যন্ত একটা গাছ বিক্রি করে মা টাকার ব্যবস্থা করে।”

তা হলে এমন কথা জানলেন কী করে? আব্দুল খালেক ইশারায় বোঝালেন, সপ্তাহ দু’য়েক আগে পাড়াতেই এক দোকানে যান চাল কিনতে। ভাঙানোর জন্য বাক্স থেকে একটি ৫০০ টাকার নোট নিয়ে যান। দোকানদারই প্রায় ঘণ্টা দুয়েক ধরে তাঁকে পুরো বিষয়টি বোঝান।

কাঁদতে কাঁদতে তাঁর পাগলপ্রায় অবস্থা। বাড়ি ফিরে গোলনেহারের সামনে খোলেন সেই বাক্স। গোলনেহার গুণে দেখেন বাতিল নোটে ৬৩ হাজার টাকা। কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বামী-স্ত্রী। গোলনেহার বলছেন, “ও বলল, আমাদের বুড়ো বয়সে খরচের জন্য সঞ্চয় করেছিল ওই টাকাগুলো। ওর কাছে যে টাকা থাকতে পারে কেউ ভাবেনি।”

বাতিল নোট নিয়ে সর্বত্র ছুটছেন। পাড়ার মোড়ল, পার্টির নেতা, পঞ্চায়েত প্রধান। সকলেই ফিরিয়ে দিচ্ছেন। গোলনেহার বলছেন, “টাকার শোকে গলায় দড়ি দিতে গিয়েছিলেন। চোখে পড়ায় বাঁচাতে পেরেছি। সেই থেকে আগলে আগলে রাখছি।”

স্থানীয় ব্যবসায়ী বাবু শেখ জানালেন, তাঁর কাছেও এসেছিলেন ওঁরা। এখন বাতিল টাকা রিজার্ভ ব্যাঙ্কও বদলে দিচ্ছে না। তা না হলে, আমিই কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বদলে দিতাম।

মাস দেড়েক আগে নদিয়ার করিমপুরে এক বৃদ্ধার কৌটো থেকে মিলেছিল বাতিল সাড়ে ১৮ হাজার টাকার নোট। এন্তেকালের পর তাঁর কফিন কেনার জন্য টাকা জমিয়েছিলেন বৃদ্ধা। একই পরিণতি হল খালেকেরও।

পদিপিসির বর্মিবাক্স খুলে দিদিমা কাউকে দিয়েছিলেন হীরের আংটি, কাউকে সোনার হার। আর প্যান্ডোরার বাক্স থেকে ক্ষোভ-হতাশারা বেরিয়ে গেলে একা পড়েছিল আশা। কিন্তু, বাক্স খোলার পর হতাশা ছাড়া যে আর কিছুই মেলেনি নির্বাক খালেকের।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy