লক্ষ্মণ শেঠ। —ফাইল চিত্র।
জল্পনাটা ছিলই। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা নাগাদ তমলুকে জেলা সিপিএমের কার্যালয়ে ফ্যাক্স মারফত এল সেই ‘প্রত্যাশিত’ বার্তা। দল-বিরোধী কাজের অভিযোগে আলিমুদ্দিন বহিষ্কার করেছে এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম নেতা তথা তমলুকের প্রাক্তন সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠকে!
লোকসভার আগে পূর্ব মেদিনীপুরের একদা ‘একচ্ছত্র অধিপতির’ এমন পরিণতি চিন্তায় ফেলেছে জেলা সিপিএমকে। তবে, রাজনৈতিক মহলের মত, এমনিতেই সিপিএমের সাংগঠনিক পরিস্থিতি ভাল নয়। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত রয়েছে লক্ষ্মণ-অনুগামীদের হাতে রাজ্য নেতৃত্বের সাম্প্রতিক হেনস্থা। এর উপর ‘হেভিওয়েট নেতার’ সরাসরি বহিষ্কার জেলা সিপিএমকে বিপাকে ফেলবে, এমনটাই আশঙ্কা দলের অন্দরে। যদিও সিপিএম বা বাম-শরিকরা তা মানতে নারাজ। নিন্দুকেরা বলছেন, ‘এটা সিপিএমের কাছে আক্ষরিক অর্থেই মড়ার উপর খাড়ার ঘা!’
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর কাছে চিঠি দিয়ে দলের সদস্য পদ নবীকরণ করতে না চেয়ে লক্ষ্মণবাবু আগেই দল ছাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এক ধাপ এগিয়ে বুধবার প্রশাসক হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্তুতি এবং দলে গণতন্ত্র নেই বলায় লক্ষ্মণবাবু নিজেই বহিস্কারের পথ পরিষ্কার করেছিলেন বলে অনেকের ধারণা। সে দিক থেকে এই ঘটনা প্রত্যাশিত বলে বিশ্লেষণ রাজনৈতিক মহলের।
গত সোমবার সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর উপস্থিতিতে তমলুকে দলের জেলা কমিটির বৈঠকে লক্ষ্মণ-অনুগামীরা তাঁর সদস্যপদ নবীকরণ করানোর পাশাপাশি দলে যোগ্য মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। তাতে সায় দিয়েছিলেন জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর অধিকাংশ সদস্যই। ব্যতিক্রম ছিলেন পাঁশকুড়ার দুই সদস্য। তাঁরা বিমান বসুর উপস্থিতিতে সরাসরি মত দিয়েছিলেন, লক্ষ্মণবাবুর সদস্য পদ নবীকরণ করা হলে আখেরে দলের ক্ষতি হবে। তবে, বৈঠকের সিদ্ধান্ত মত বুধবার দলের ভারপ্রাপ্ত জেলা সম্পাদক প্রশান্ত প্রধান ও জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য প্রশান্ত পাত্র সদস্য পদ নবীকরণ নিয়ে বোঝাতে কলকাতায় লক্ষ্মণবাবুর বাড়িতে যান। লক্ষ্মণবাবু তাঁদের কাছে পদ নবীকরণের বিষয়টি ভেবে দেখবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু, প্রশান্তবাবুরা চলে আসার পরপরই লক্ষ্মণবাবু সংবাদ মাধ্যমের কাছে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সমালোচনার পাশাপাশি বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক দক্ষতার ভূয়সী প্রশংসা করেন। এমনকি প্রকাশ্যে দল ছাড়ার কথাও ঘোষণা করেন। সংশ্লিষ্ট মহলের মত, তাতে আরও প্রশস্ত হয় বহিষ্কারের পথ।
এই পরিস্থিতি ‘বিপাকে’ ফেলেছে একদা লক্ষ্মণ-ঘনিষ্টদেরও। পার্টি-বিরোধী কাজের জন্য এমনটাই যে প্রত্যাশিত ছিল, তা মানছেন লক্ষ্মণ-অনুগামী শিবিরের অন্যতম নেতা বলে পরিচিত জেলা সম্পাদক কানু সাহু। তিনিও তোপ দেখেছেন তাঁর একদা ছাত্রের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, “দল-বিরোধী কাজের জন্যই লক্ষ্মণবাবুকে বহিষ্কার করা হল। উনি সদস্যপদ নবীকরণ না-ই করাতে পারতেন। কিন্তু, লোকসভার ভোটের মুখে যে সব মন্তব্য করেছেন সেটা অন্যায় হয়েছে।” বহিষ্কার প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি ভারপ্রাপ্ত জেলা সম্পাদক প্রশান্ত প্রধান।
লক্ষ্মণ শেঠের মতো নেতার কাছ থেকে উচ্চ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিষদগার করা ঠিক হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা পূর্বের পর্যবেক্ষক রবীন দেব। বৃহস্পতিবার জেলা সিপিএম কার্যালয়ে দলীয় কর্মিসভায় এসে তিনি বলেন, “এর আগেও দলীয় নেতৃত্বকে বিভিন্ন ভাবে আক্রমণ করেছিলেন লক্ষ্মণ শেঠ। এখন তৃণমূল সরকারের মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে যে সব মন্তব্য করেছেন, তাতে পার্টির এত বড় রাজনৈতিক সংগ্রাম তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্মণবাবুর মতো একজন পোড় খাওয়া নেতার কাছ থেকে এ সব মন্তব্য শুনতে হচ্ছে। এটা পরিতাপের বিষয়।”
লক্ষ্মণবাবুর বহিষ্কার কী নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে?
জেলা নেতারা জানিয়েছেন, দীর্ঘ দিন লক্ষ্মণবাবু জেলায় ছিলেন না। তাই লোকসভায় এই বহিষ্কার কোনও প্রভাব ফেলবে না। তমলুক লোকসভার সিপিএম প্রার্থী ইব্রাহিম আলির দাবি, ব্যক্তির উপর নির্বাচন নির্ভর করে না। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, উনি তো নিজেই তৃণমূল সরকারের আমলে মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে জেলে ছিলেন। এরপরও বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা করছেন!
নির্বাচনে কোনও প্রভাবের কথা মানেননি বাম-শরিকেরাও। সিপিআইয়ের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন ঘড়া লক্ষ্মণবাবুর সমালোচনা করে বলেন, “ব্যক্তির চেয়ে পার্টি বড়। যে পার্টির দ্বারা উনি সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়েছেন সেই পার্টির বিরুদ্ধে বলেছেন! আর বিরোধীর প্রশংসা করছেন, এটা মোটেই কাম্য নয়।” বহিষ্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “লক্ষ্মণবাবুর মন্তব্য পার্টির আদর্শের সঙ্গে খাপ খাচ্ছিল না।”
আরএসপি’র জেলা সম্পাদক অমৃত মাইতি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে লক্ষ্মণবাবুর বিশ্লেষণ ঠিক নয়।” তাঁর কথায়, “উনি যে ভাবে নেতৃত্বের সমালোচনা করেছেন, তাতে এটা প্রত্যাশিত ছিল।” নির্বাচনের এর জেরে কোনও প্রভাব পড়বে না বলেই মনে করেন তিনি।
এখন দেখার, লক্ষ্মণ-কাঁটা পূর্বের সিপিএমকে প্রচারে কতটা স্বস্তিতে রাখে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy