Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

অবহেলায় ধ্বংসস্তূপ লালগড়ের হাওয়ামহল

কয়েকশো বছর আগে গ্রীষ্মের বিকেলে রাজাবাঁধের ‘হাওয়া মহলে’ ফুরফুরে দখিনা বাতাসে শরীর জুড়োতেন রাজা ও পারিষদরা। রাজদিঘির (স্থায়ীয় ভাষায় রাজাবাঁধ) স্ফটিকজলে নৌকাবিহার করে হাওয়া মহলে পৌঁছতেন রাজ পরিবারের সদস্যরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্ণ ‘হাওয়া মহল’ আজ কার্যত ধ্বংসস্তুপ হয়ে অতীত ইতিহাসের সাক্ষী। লালগড়ে সাহসরায় রাজ পরিবারের শতাব্দীপ্রাচীন প্রাসাদটিরও বেহাল দশা।

অবহেলায় পড়ে সর্বমঙ্গলার প্রাচীন মন্দির।

অবহেলায় পড়ে সর্বমঙ্গলার প্রাচীন মন্দির।

কিংশুক গুপ্ত
লালগড় শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:০৭
Share: Save:

কয়েকশো বছর আগে গ্রীষ্মের বিকেলে রাজাবাঁধের ‘হাওয়া মহলে’ ফুরফুরে দখিনা বাতাসে শরীর জুড়োতেন রাজা ও পারিষদরা। রাজদিঘির (স্থায়ীয় ভাষায় রাজাবাঁধ) স্ফটিকজলে নৌকাবিহার করে হাওয়া মহলে পৌঁছতেন রাজ পরিবারের সদস্যরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্ণ ‘হাওয়া মহল’ আজ কার্যত ধ্বংসস্তুপ হয়ে অতীত ইতিহাসের সাক্ষী।

লালগড়ে সাহসরায় রাজ পরিবারের শতাব্দীপ্রাচীন প্রাসাদটিরও বেহাল দশা।

শহরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, রাজ-আমলের মন্দির ও প্রাসাদকে কেন্দ্র করে লালগড়ে পর্যটন-বিকাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু লালগড়ে পর্যটন পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য সরকারিস্তরে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয় নি। এ কারণেই যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পর্যটনে উন্নতি করতে পারছে না এই শহর।

এক সময় লালগড়ের শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চা ও শিক্ষার প্রসারে রাজ পরিবারের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রতি সমর্থন ছিল রাজ পরিবারের। ব্রিটিশ সরকারের নজর এড়িয়ে চারণ কবি মুকুন্দ দাস একবার প্রাসাদে এসে দেশাত্ববোধক গান শুনিয়ে গিয়েছিলেন। জনশ্রুতি, প্রাসাদের চোরা কুঠুরিতে বিপ্লবীরা আত্মগোপন করে থাকতেন। বর্তমানে লালগড়ে দোতলা প্রাসাদে রাজ পরিবারের কয়েক শরিক ভাগাভাগি করে বাস করেন। প্রাসাদের জরাজীর্ণ অবস্থার জন্য নিজের অংশে থাকার ঝুঁকি নেন নি রাজ পরিবারের সদস্য দর্পনারায়ণ সাহসরায়। সর্বশেষ রাজা বিজয়নারায়ণ সাহসরায়ের নাতি (পৌত্র) দর্পনারায়ণবাবু কিছু দূরে মাটির বাড়িতে থাকেন। রাজ পরিবারের প্রাচীন মন্দিরগুলির দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন দর্পনারায়ণবাবু। এর মধ্যে ‘রাধামোহন জিউ’য়ের মন্দিরটি বিষ্ণুপুরি জোড়বাংলা শৈলীর। কানাইলাল ও শ্রীমতী এবং কুলদেবী সর্বমঙ্গলা-সহ বিবিধ দেবদেবীর নিত্যপুজো আজও হয়ে আসছে। এই মন্দির চত্বরের ভিতরে সর্বমঙ্গলার আদি দোতলা মন্দিরটির বেহাল অবস্থা। পরিত্যক্ত ওই মন্দিরের গায়ে পোড়া মাটির কাজ আজও সকলকে মুগ্ধ করে দিতে পারে।

ভগ্নদশার জন্য বেশ কয়েক বছর আগে সর্বমঙ্গলার বিগ্রহ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় রাধামোহন জিউ মন্দিরের গর্ভগৃহে। লালগড়ে রাধামোহন জিউয়ের রথযাত্রা আজও নজর কাড়ে। রাজ পরিবারের দেওয়ালি দুর্গামন্দিরটিও তিনশো বছরের পুরনো। মন্দিরের গর্ভগৃহের দেওয়ালে চুন ও সুরকির দুর্গামূর্তিটি খোদাই করা বলেই সম্ভবত দেওয়ালি দুর্গামন্দির নাম। রাজপরিবারের একটি শিবমন্দির রয়েছে রথতলায়। দর্পনারায়ণবাবুর কথায়, “সংস্কার ও সংরক্ষণের কাজ করার মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই। এখানে এমন দৃষ্টি নন্দন স্থাপত্য কীর্তি আছে, তা বাইরের লোকজনেরও জানা উচিত।”

রাজাবাঁধের ‘হাওয়া মহল’ নিয়ে জনশ্রুতিও কম নয়। শোনা যায়, রাজ পরিবারের প্রমোদের জন্য হাওয়া মহলটি ব্যবহৃত হত। রাজাবাঁধের মাঝে পোড়া ইটের তৈরি হাওয়া মহলটি ঠিক যেন দ্বীপের মতো। রাজপ্রাসাদ থেকে হাওয়া মহল পর্যন্ত গোপন সুড়ঙ্গ পথও ছিল। যদিও বর্তমানে সেই সুড়ঙ্গের অস্তিত্বই আর নেই। বর্গি হামলার সময় রাজপ্রাসাদের ধনসম্পদ গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে হাওয়া মহলের তলায় লুকিয়ে রাখা হত। এলাকার বাসিন্দাদের বিশ্বাস, সেই সম্পদ আজও গচ্ছিত রয়েছে। লালগড়ের বাসিন্দা পঙ্কজকুমার মণ্ডল স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চর্চা করছেন। তাঁর কথায়, “পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য সরকারি স্তরে প্রচার ও উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করা দরকার। সেই সঙ্গে লালগড়ের স্থাপত্য-কীর্তির ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে উপযুক্ত সংস্কার ও সংরক্ষণ জরুরি।” লালগড়ের আশেপাশে আরও দর্শনীয় জায়গা রয়েছে। যেমন, শঙ্কর বাণপ্রস্থ আশ্রমের উৎকল শৈলির গোরা-বনমালী মন্দির, ভবতারিণী মন্দির ও পঞ্চমুণ্ডির আসন, স্থানীয় জঙ্গলের ও কংসাবতীর তীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ডাইনটিকরিতে পঞ্চরথ পীঢ়া দেউল শৈলির মাকড়া পাথরের তৈরি বৌদ্ধ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।


রাজা বাঁধের মাঝে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হাওয়ামহল।

এত কিছু থাকা সত্ত্বেও পর্যটকদের জন্য লালগড়ে থাকার কোনও লজ-হোটেল নেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, এক সময় লালগড়ে বাইরে থেকে লোকজন বেড়াতে আসতেন। কেউ কেউ সরকারি বন বাংলোয় রাত্রি যাপন করতেন। কিন্তু মাওবাদী অশান্তি পর্বের সময় থেকে সেই বন বাংলো এখন কেন্দ্রীয় বাহিনীর দখলে। তারপর আর পর্যটকেরা সেভাবে লালগড়মুখো হন না। তাই কোনও বেসরকারি লজ-হোটেলও গড়ে ওঠেনি। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নিরঞ্জন ভৌমিক, কলেজ ছাত্রী অনন্যা মণ্ডল, মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী তাপসকুমার দে-র মতো অনেকেই বলছেন, “জঙ্গলমহলের পর্যটন প্রসারে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। লালগড়কেও সেই তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করা উচিত।এখানে পর্যটকদের জন্য ন্যূনতম ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। সরকারি কিংবা বেসরকারি স্তরে পর্যটন-প্যাকেজ চালু হওয়া দরকার। পর্যটকেরা এলে স্থানীয় ভাবে বিকল্প কর্মসংস্থানেরও সুযোগ ঘটবে।”

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন লালগড়ে রেল লাইন চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রকল্পটি এখন বিশ বাঁও জলে। বাসিন্দাদের বক্তব্য, রেল মানচিত্রে লালগড়কে অন্তর্ভুক্ত করা হলে স্থানীয় পর্যটনের পক্ষে তা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হত। লালগড় পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কৃষ্ণগোপাল রায় বলেন, “লালগড়ের পর্যটন পরিকাঠামো-সহ সার্বিক উন্নয়নে আমরা প্রশাসনিকস্তরে আলোচনা চালাচ্ছি।”

কবে সেই আলোচনার ফল মেলে, সেটাই দেখার।

ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

অন্য বিষয়গুলি:

amar shohor kingsukh gupta lalgarh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy