ফি দুপুরে জল ঢেলে ভাত খাওয়াই এখন দস্তুর খড়্গপুরের আয়মা এলাকায় এই পড়ুয়াদের। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ
স্কুল নেই। তাই দিনের বেলায় রোজই নুন-ভাত খেয়ে পেট ভরাতে হচ্ছে খড়্গপুর গ্রামীণের গোপালি পঞ্চায়েতের আমরাকলা গ্রামের খুদে ভাই-বোন চঞ্চল আর মল্লিকা রায়কে। চঞ্চল পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে। দিদি মল্লিকা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। স্কুল থাকলে ভাত-ডাল-তরকারির পাশাপাশি কোনওদিন ডিম, সোয়াবিনও জোটে। মল্লিকা বলছিল, “বাড়ির খাবারে পেট ভরে না। শুধু জল ঢেলে নুন দিয়ে ভাত খেতে রোজ ভাল লাগে না।” মল্লিকাদের মা অশীলা রায় জানালেন, ওদের বাবা সামান্য শ্রমিকের কাজ করেন। টানাটানির সংসারে নুন-ভাত জোগাড়েও হিমশিম খেতে হয়।
রাজ্যের দরিদ্র পরিবারের এটাই ছবি। তাই স্কুলে লম্বা ছুটির মরসুমে রীতিমতো বিপাকে পড়েছেন গরিব বাড়ির বাবা-মায়েরা। কারণ, স্কুল বন্ধ মানে মিড ডে মিলও তো বন্ধ!
এ বার অবশ্য আদালত নির্দেশ দিয়েছে, স্কুল বন্ধ থাকলেও মিড ডে মিল চালু রাখতে হবে। কিন্তু এ বারের গ্রীষ্মাবকাশে রাজ্যের স্কুলগুলিতে সেই ব্যবস্থা কার্যকর হবে কিনা প্রশ্ন। পশ্চিম মেদিনীপুরের বিদ্যালয় পরিদর্শক (প্রাথমিক) আমিনুল আহসান বলেন, ‘‘ছুটির সময় মিড ডে মিল চালু রাখার কোনও নির্দেশিকা জেলায় এসে পৌঁছয়নি।’’ এ ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগবে বলেই প্রশাসন সূত্রের খবর। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান নারায়ণ সাঁতরাও বলেন, “এটা ঠিক জেলার একাংশ পড়ুয়া মিড-ডে মিলের টানে স্কুলে আসে। কিন্তু স্কুল বন্ধ থাকলে মিড-ডে মিল বন্ধ রাখার নির্দেশ রয়েছে। তাই এ ক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না।”
রাজ্যের শিক্ষা দফতরের নির্দেশে গত এক মাস ধরে স্কুলে ক্লাস বন্ধ। গরমের জন্যই এই সিদ্ধান্ত। ১৬ থেকে ১৮ মে তিন দিন স্কুল হয়ে ফের ১৯ মে থেকে শুরু হয়ে যাবে গরমের ছুটি। এই ছুটি চলবে ৪ জুন পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সময় ছেলেমেয়েদের দুপুরে কী খেতে দেবেন, ভেবে কুল পাচ্ছেন না শালবনির কলাবেড়িয়ার সুলেখা সিংহ, লায়লা বিবিরা। সুলেখার কথায়, “দিনমজুরি করে সংসার চলে। দিনের শেষে ১২০ টাকা পাই। এতে আর কী হয়। তারই মধ্যে ছেলেমেয়েদের এক বেলার খাবারের জোগাড় করতে হচ্ছে। খুবই কষ্ট হচ্ছে।”
সুলেখার চার ছেলেমেয়ে। স্বামী শ্রীমন্ত সিংহও দিনমজুর। তাঁদের বড় মেয়ে শম্পা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে, মেজো মেয়ে পম্পা প্রথম শ্রেণিতে। ছোট মেয়ে রিম্পা আর ছেলে সুমন অঙ্গনওয়াড়িতে যায়। টানা স্কুল বন্ধ থাকায় মন খারাপ শম্পা, পম্পা, রিম্পাদেরও। ভাদুতলা হাইস্কুলের ছাত্রী শম্পার কথায়, “স্কুলে গেলে দুপুরের খাওয়াটা হত। পড়াশোনাও হত। এখন কোনওটাই হচ্ছে না!” খড়্গপুর গ্রামীণের গোপালি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত আমরাকলা গ্রামের বাসিন্দা কল্পনা প্রধানের বাড়িতেও এক ছবি। স্বামী শঙ্কর প্রধান নির্মাণ শ্রমিক। এই দম্পতির চার মেয়ে। সকলেই আমরাকলা শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের ছাত্রী। বড় মেয়ে অষ্টমী তৃতীয় শ্রেণিতে, মেজ নমিতা দ্বিতীয় শ্রেণিতে, সেজ মৌসুমী প্রথম শ্রেণিতে ও ছোট মেয়ে শিশুশ্রেণিতে পড়ে। গত একমাস স্কুল ছুটি থাকায় নুন আনতে পান্তা ফুরনো সংসারে চাপ বেড়েছে। কল্পনা বলেন, “স্কুলে গেলে মেয়েগুলো একটু খেতে পায়। এখন তিনবেলা ওদের মুখে কী তুলে দেব তা ভেবে অস্থির হয়ে যাচ্ছি। পান্তাভাত খেয়েই চলছে।”
পশ্চিম মেদিনীপুরে ৪,৮১১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। স্কুলে টানা ছুটি চলায় সমস্যা দেখা দিয়েছে জেলার সর্বত্র। গ্রামীণ এলাকায় সমস্যা বেশি। খড়্গপুরের মতো শহরেও সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে রেলের বস্তিতে গরিব বাড়ির ছেলেমেয়েরা স্কুল বন্ধ থাকায় ফাঁপরে পড়েছে। আয়মা এলাকার শ্রীভারত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী সোমবারি সরেনের কথায়, “অনেকদিন স্কুল হচ্ছে না। খাবারও দিচ্ছে না। সকালে বাবা-মা কাজে যাওয়ার আগে আমাকে জলভাত খেতে দেয়। কিন্তু আমার তখন মুড়ি-বিস্কুট খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মা বলে, মুড়ি-বিস্কুট কেনার টাকা নেই।” ছোট আয়মার বাসিন্দা গীতা মাণ্ডি আবার বলেন, “বাড়িতে তিনটে ছেলে। তিনবেলা ওদের কী খেতে দেব সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।”
আয়মার শ্রীভারত প্রাথমিকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক তুফান পণ্ডা বলছিলেন, “শহরের এই এলাকায় এখনও অনেক পরিবার দু’বেলা ঠিকমতো খেতে পায় না। কিন্তু আমাদের কাছে মিড-ডে মিল চালানোর অনুমতি নেই।” এমনকী এপ্রিল মাসের যে ক’দিন মিড-ডে মিল হয়েছে তার টাকাও এখনও পাননি বলে নালিশ করলেন ওই স্কুলের রাঁধুনি লীলাবতী যাদব। যদিও প্রধান শিক্ষক জানান, এপ্রিলের বিল একেবারে মে-তে পাঠানোর নির্দেশ থাকায় সমস্যা হয়েছে।
মিড ডে মিল চালুর ফলে গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোয় স্কুলছুটের সংখ্যাও কমেছিল। টানা স্কুল বন্ধের জেরে ফের স্কুলছুট বাড়তে পারে বলেই আশঙ্কা একাংশ শিক্ষকের। শালবনির ভাদুতলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অমিতেশ চৌধুরীর মতে, “স্কুলছুটের সংখ্যা কমাতে মিড ডে মিলের একটা ভূমিকা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অভ্যাসটা বড় ব্যাপার। টানা ছুটির ফলে কেউ কেউ এই অভ্যাস থেকে দূরে সরে যেতে পারে।”
মৌপাল দেশপ্রাণ বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক প্রসূনকুমার পড়িয়াও বলেন, “মিড ডে মিলের জন্য স্কুলছুটের সংখ্যা অনেক কমেছে। অনেক বাবা-মা ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন, কারণ পড়াশোনার পাশাপাশি স্কুলে গেলে ছেলেমেয়ের দুপুরের খাবারও জোটে।” অন্য এক শিক্ষকের আবার বক্তব্য, “একটানা ছুটির জেরে পঠনপাঠনও বিঘ্নিত হবে। সিলেবাস শেষ করা মুশকিল হবে। চাপ পড়বে সেই পড়ুয়াদের উপরই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy