নিয়তি এবং গোপাল বরের বাড়ি। নিজস্ব চিত্র।
শাসকদলের একজন সাধারণ পঞ্চায়েত সদস্য। স্বামী দিঘায় মাছের আড়তে চাকরি করেন। বছর খানেক আগে তাঁদের বানানো পেল্লাই দোতলা বাড়ি ঘিরে বর্তমানে বিতর্ক শুরু হয়েছে। যা গড়িয়েছে থানা-পুলিশ পর্যন্ত। অভিযোগ, ওই ‘অট্টালিকা’ নিয়ে আপত্তি তুলেছেন গ্রামবাসীদের একাংশ। আর শুধু আপত্তি নয়, শাসকদলের ওই পঞ্চায়েত সদস্যার স্বামী এবং তৃণমূল নেতাকে ২৫ লক্ষ টাকা জরিমানা দেওয়ার জন্য ফতোয়া জারি করার অভিযোগ উঠেছে গ্রাম কমিটির মাতব্বরদের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় পুলিশ শক্তিপদ বর নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে।
ঘটনাস্থল কাঁথি-৩ ব্লকের লাউদা গ্রাম পঞ্চায়েতের তালদা গ্রাম। ওই পঞ্চাতের এক জন তৃণমূল সদস্য হলেন নিয়তি বর। তাঁর স্বামী গোপাল বর এলাকায় তৃণমূল নেতা হিসাবে পরিচিত। ওই দম্পতির আগে মাটির বাড়ি ছিল। তবে পরে তাঁরা দোতলা বাড়ি তৈরি করেন। একজন পঞ্চায়েত সদস্যার এমন বিশাল বাড়ি তৈরি নিয়ে এলাকায় প্রশ্ন উঠেছিল। অভিযোগ, এর মধ্যেই ১৬ এপ্রিল তালদা গ্রামে একটি সালিশি সভা বসায় গ্রাম কমিটি। সেখানে গোপালের কাছে পঁচিশ লক্ষ টাকা জরিমানা দেওয়ার ফতোয়া জারি করেন কমিটির মাতব্বরেরা। তা শুনে সেখানেই অসুস্থ হয়ে পড়েন ওই তৃণমূল নেতা। তারপর তাঁকে কলকাতা একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
ওই ঘটনায় কমিটির চার জনের বিরুদ্ধে ওই পঞ্চায়েত সদস্যর বাবা শ্যামল বর মারিশদা থানার লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। গ্রাম কমিটির সভাপতি, সহ-সভাপতি এবং সম্পাদক-সহ চারজনের বিরুদ্ধে বাড়ি ভাঙচুর, খুনের চেষ্টা, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি অভিযোগে মামলা রুজু করে পুলিশ। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শক্তি বর নামে একজনকে পরে পুলিশ গ্রেফতার করে। আপাতত সে জেল হেফাজতে রয়েছে। বাকি অভিযুক্তদের খোঁজে পুলিশ তল্লাশি চালাচ্ছে। এ ব্যাপারে কাঁথির এসডিপিও সোমনাথ সাহা বলেন, ‘‘একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই এলাকায় এই ধরনের সালিশি সভা বসানোর অনেক ঘটনাই পুলিশের নজরে রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কড়া পদক্ষেপ করা হচ্ছে।’’
গ্রাম কমিটির ‘দাদাগিরি’ প্রসঙ্গে গোপাল বলেন, ‘‘বুকে স্টেন বসানো রয়েছে। মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য লোকাচার মেনে পাড়ার সকলকে নিয়ে বৈঠকে বসে ছিলাম। সেখানে আমাকে প্রথমে ২৫ লক্ষ এবং পরে ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত পাঁচ লক্ষ টাকা দিতে হবে গ্রাম কমিটি বলে সিদ্ধান্ত জানায়। চাপে পড়ে আমি অসুস্থ হয়ে যাই। আমার ছোট ভাই উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।’’ এদিকে ওই সালিশি সভার পর থেকেই নিয়তির পরিবারও ‘ঘরছাড়া’ বলে দাবি।
কিন্তু কেন এত টাকা জরিমানার ফতেয়া জারি করেছিল গ্রাম কমিটি?
স্থানীয় সূত্রের খবর, ওই নেতার মেয়ের বিয়ের অনুমতির জন্য ওই পরিমাণ অর্থ চাওয়া হয়েছিল। যদিও এর পিছনে অন্য তত্ত্বও রয়েছে বলে দাবি গ্রামবাসীর একাংশের। তাঁদের বক্তব্য, ওই নেতা দুর্নীতি করে বিপুল অর্থ করেছেন এবং দোতলা বাড়ি বানিয়েছেন। সেই জন্যই তাঁর কাছে অর্থ চাওয়া হয়েছিল। প্রতিবেশীদের পাশাপাশি স্থানীয় কয়েকজনের কথায়, ‘‘আমপানে একজনের ভাঙাচোরা বাড়ি এখনও পড়ে রয়েছে। তার ক্ষতিপূরণ জোটেনি। অথচ সরকারি বিভিন্ন রকম সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার নামে সকলের কাছ থেকে টাকা নিতেন। আর সেই টাকাতেই অট্টালিকা বানিয়েছেন তিনি।’’ ২০০৯-২০১৮ সাল পর্যন্ত কাঁথি -৩ পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন দীপক বর্মন। ওই তৃণমূল নেতা বলছেন, ‘‘নবছর ধরে গ্রামে কোনও কিছু ঘটলেই জরিমানা আদায় করা কিংবা মারধর করতেন পঞ্চায়েত সদস্যর স্বামী। জব কার্ড রয়েছে এমন গরিব লোকেদের কাছ থেকেও নেওয়া হতো কাটমানি। অন্যথায় তাদের কে হুমকি দিতেন পঞ্চায়েত সদস্য।’’ দীপকের কথায়, ‘‘গ্রামের একটি মন্দিরের ছাদ ঢালাই করার জন্য সকলে সাধ্যমত সহযোগিতা করেছিলেন। অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন ওই তৃণমূল নেতাকে সকলে মিলে খানিকটা বেশি সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তাতে তিনি রাজি হয়েছিলেন। পরে, নিজের বেহিসেবি সম্পত্তি নিয়ে জনরোষে পড়তে পারেন এই আশঙ্কা করে এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছেন। পরে গ্রামের অনেকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে পুলিশি হয়রানি করানো হচ্ছে।’’
বুধবার বিকালে তালদা গ্রামে গিয়ে দেখা গেল পেল্লাই দোতলা অট্টালিকা। চারদিকে পাঁচ ফুট উঁচু ঘেরা প্রাচীর। কী নেই সেই বাড়িতে! সাবমার্সিবল পাম্প, পাথরে বাঁধানো তুলসী মঞ্চ, উপরে ডিশ টিভি, আর গোটা ঘরটাই মার্বেল পাথরে মোড়া। সামনে সাইকেল এবং চেয়ার পড়ে রয়েছে। প্রায় ১৫ ডেসিমেল জায়গার উপরে কয়েক মাস আগেই দোতলা বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছে বলে দাবি প্রতিবেশীদের। চোখধাঁধানো বাড়ির অবশ্য বাইরের গেটে তালা ঝোলানো ছিল। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে সেই পঞ্চায়েত সদস্য নিয়তি বর বলেন, ‘‘আমার স্বামী একসময় ভিন্ রাজ্যে সংস্থায় চাকরি করতেন। আপাতত দিঘায় মাছের আড়তে নির্দিষ্ট বেতনের চাকরি করেন। কয়েকটি মাছের ভেড়িও রয়েছে। আর্থিক তছরূপের অভিযোগ প্রমাণ হলে পঞ্চায়েত সদস্যের পদ থেকে সরে দাঁড়াব।’’
সাধারণ পঞ্চায়েত সদস্যর পেল্লাই বাড়ি তৈরিতে অর্থের উৎস নিয়ে যে অভিযোগ উঠছে, সে ব্যাপারে কাঁথি-৩ পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি বিকাশ বেজ বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত সদস্যার স্বামী দিঘায় মাছের কারবারে যুক্ত। উনি ভাল টাকার বেতন পান। তাছাড়া ওঁদের বেহিসাবি সম্পত্তি নিয়ে এলাকার বাসিন্দাদের কাছ থেকে সে রকম কোনও অভিযোগ পাইনি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy