ভবানীপুরের বাড়িতে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
সাতসকালে উঠে দাড়ি কামিয়ে ‘রে়ডি।’ সাদা লুঙ্গির মধ্যে গুঁজে নিয়েছেন নীল, গোল-গলা আটোসাঁটো টি-শার্ট। অস্থির ভাব। কখনও বসছেন, কখনও দাঁড়াচ্ছেন। বারবার জানতে চাইছেন, সময় কত হল? সওয়া বারোটা বাজল কি?
পাঁজি-পুঁথি দেখে জ্যোতিষী বলে দিয়েছেন, রবিবার বেলা সওয়া বারোটার পরে হাসপাতাল ছেড়ে বেরোতে হবে। ওটাই নাকি শুভক্ষণ।
সেই মতো রবিবার সকালে এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ডের বিছানা ছাড়া ইস্তক সওয়া বারোটার অপেক্ষায় ছিলেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। শনিবার সারদায়-মামলায় জামিন পেয়ে যাঁর বন্দি-জীবনে আপাতত দাঁড়ি পড়েছে। অধৈর্য অপেক্ষায় ছিলেন অনুগামীরাও। দেখা গেল, ওয়ার্ডে ঢুকে পড়েছেন কামারহাটির তৃণমূল কাউন্সিলর বিশ্বজিৎ গণ। ‘দাদা’র জন্য দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর প্রসাদ নিয়ে এসেছেন। প্রসাদ খেয়ে ‘দাদা’ আবেগে চেপে ধরলেন ‘ভাই’-এর হাত। রাজপুর-সোনারপুরের কাউন্সিলর অর্পিতা সরকার ও তাঁর সঙ্গী তৃণমূল নেতা শিবনাথ ঘোষও তখন হাসপাতাল চত্বরে হাজির।
মদন মিত্র মানেই অনুগামীর ভিড়। শনিবার তাঁর জামিনলাভের খবর আসতেই ভবানীপুর থেকে কামারহাটি উৎসবে মেতে উঠেছিল। এ দিন অবশ্য অনুগামীরা শনিবারের মতো দল বেঁধে হাসপাতালে আসেননি। দুই ছেলে ও ঘনিষ্ঠ কয়েক জন শুধু ছোটাছুটি করেছেন। আর ছিল পুলিশ।
ঘড়ির কাঁটা ১২টা ১৫ পেরোতেই গুঞ্জন শুরু হল হাসপাতালে মোতায়েন পুলিশদের মধ্যে। এক পুলিশ অফিসার গটমট করে হেঁটে এসে অ্যাম্বুল্যান্স চালককে বললেন, ‘‘রেডি থাকুন। মন্ত্রী এখনই বেরোবেন।’’
১২টা ২০।
উডবার্ন ওয়ার্ডের দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসলেন মদন মিত্র। ততক্ষণে লুঙ্গি-টি শার্টের বদলে গায়ে চাপিয়ে নিয়েছেন হলুদ পাঞ্জাবি। পরনে সাদা পাজামা। আত্মীয়-ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে উঠে বসলেন। মুখে কোনও কথা নেই। মুক্ত মন্ত্রীকে বাড়ি পৌঁছে দিতে এ দিন ট্রাফিক-বিধির তোয়াক্কা করেনি পুলিশও। নিয়ম হল, দুপুরে হরিশ মুখার্জি রোড ধরে গাড়ি যাবে ভবানীপুর থেকে এসএসকেএমের দিকে। কিন্তু এ দিন মন্ত্রীর অ্যাম্বুল্যান্স, পুলিশ এসকর্ট, অনুগামীদের মোটরবাইক, মায় পিছু ধাওয়া করা সংবাদমাধ্যমের গাড়ি ওই রাস্তা ধরেই দিব্যি ছুটেছে উল্টো বাগে।
কয়েক মিনিটে ভবানীপুরের শাঁখারিপাড়ার বাড়িতে পৌঁছে গেলেন মন্ত্রী। গাড়ি থেকে নেমে বললেন, ‘‘সত্যের জয় হল। মানুষের জয় হল।’’
এবং এটুকু বলে বাস্তবিকই বিজয়ীর ভঙ্গিমায় ঢুকে গেলেন বাড়ির অন্দরে। ‘দাদা’ বলে আদরের সম্ভাষণ করে কোলে তুলে নিলেন নাতি মহারূপকে। বাইরে তখন পুরোদমে মিষ্টি বিলোনো হচ্ছে। মিত্র বাড়িকে ঘিরে তৈরি হওয়া ভবানীপুর অগ্রদূত উদয়ন সঙ্ঘের ফাঁকা মণ্ডপে যেন বাজছে বোধনের বাদ্যি!
ভিতরের দৃশ্য কী?
বসার ঘরের নিচু খাটে বসে মদনবাবু। চারপাশে আত্মীয়-পরিজনের ভিড়। সকলের সঙ্গে কথা বলছেন, তারই মাঝে আদর করে চলেছেন ছ’মাসের নাতিকে। পাশে রাখা অক্সিজেন সিলিন্ডার। হাসপাতালের অভ্যেসমাফিক মাঝে-মধ্যে অক্সিজেনও টানছেন। এরই মাঝে পরিবারের ‘নির্দেশ’ এল, দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে হবে। তড়িঘড়ি হলুদ পাঞ্জাবি ছেড়ে গলিয়ে নিলেন গেরুয়া টি-শার্ট। ভাত ও দু’পদের সব্জিতে ‘লাঞ্চ’ সারতেও বিশেষ সময় নিলেন না।
আমিষ ছাড়লেন কেন? মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠের ব্যাখ্যা, ‘‘কড়া কড়া ওষুধ খান তো! ইদানীং তাই আমিষ এড়িয়ে চলছেন দাদা।’’
খেয়ে উঠে দাদা ঘরে খিল দিলেন। বলে গেলেন, এখন কথা নয়, কোনও শলা-পরামর্শও নয়। শুধু নিশ্চিন্তে ঘুমোতে চান। বিকেলে উঠে অনুচর ছেলেটিকে বললেন, ‘‘সাড়ে দশ মাস বাদে নিশ্চিন্তে ঘুমোলাম।’’
এ দিন বিকেলের পরে অবশ্য মন্ত্রী ঘরেই বন্দি থেকেছেন। অ্যাটেন্ডান্ট ও ছোট ছেলে শুভরূপ ছাড়া কারও ঢোকার অনুমতি ছিল না। সন্ধ্যায় ছোট ছেলের মুখে বাবা জেনেছেন, এ দিনই দিল্লি গিয়েছেন মুকুল রায়। শুনেও কোনও মন্তব্য করেননি। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, মদনবাবু এখন দিন কয়েক বাড়িতে কাটিয়ে পুরোপুরি সুস্থ হতে চান। চলতে চান নেত্রীর নির্দেশে।
জামিন পাওয়ার পরে মদনবাবুর ঘনিষ্ঠ মহল বলেছিল, তিনি আরও ক’দিন হাসপাতালে থাকতে চান। কিন্তু রাতেই সিদ্ধান্ত বদলে যায়। স্থির হয়, রবিবারই তিনি বাড়ি ফিরবেন। সেই মতো জ্যোতিষীর কাছ থেকে শুভক্ষণের হদিস, ও অ্যাম্বুল্যান্সে প্রত্যাবর্তন। রাতে দলের বড় দরের আর কেউ না-এলেও দেখা করে গিয়েছেন আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। পরে তিনি বলেন, ‘‘আইনি বা রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কথা হয়নি। কেমন আছেন খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম।’’
ঘরের ‘দাদা’ ঘরে ফেরায় হাঁফ ছেড়েছে শাঁখারিপাড়া। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে পুলিশও। লালবাজারের অন্দরের খবর, কলকাতা পুলিশের থানা-এলাকা বাড়লেও সে অনুপাতে লোক বাড়েনি। তার উপরে রোজ ৪৫ জন পুলিশকর্মীকে (ফি শিফ্টে ১৫ জন) মন্ত্রীর নিরাপত্তায় উডবার্ন ওয়ার্ডে মোতায়েন করতে হতো!
‘‘শুধু কী নিরাপত্তা! আরও কত দিক যে সামাল দিতে হতো, তা যদি বুঝতেন!’’— মন্তব্য এক পুলিশ অফিসারের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy