ফাইল চিত্র।
কোভিড ১৯-কে ভয়? নাহ! ভয় পেলে তো পিছিয়েই যেতাম। টানা ছ’মাস সাপ্তাহিক ছুটি না নিয়েও ডিউটি করতাম না। হ্যাঁ, টানা ছ’মাস। এটা জোর করে নয়। নিজেরই মনে হয়েছে, তাই করছি। আমরা তো এখন যুদ্ধক্ষেত্রে। যুদ্ধ হলে কি সেনার ফুরসত থাকে নিয়ম মাফিক ছুটি নেওয়ার?
গত কয়েক মাসে কোভিড অবশ্যই কর্মক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন এনেছে। তবে আমার ব্যক্তিগত জীবনযাত্রায় বদল আনতে পারেনি। বরাবর নিয়মানুবর্তিতায় বিশ্বাসী। হয়তো তার ফলেই মন আর শরীর লড়াই করতে পারছে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরেই আমার সংসার। স্ত্রী আর দুই ছেলে আমার সঙ্গে থেকে মনোবল বাড়াচ্ছে। এটা জরুরি। কারণ, অনেকের কাছেই আমরা এখন অচ্ছুৎ।
আজকাল তো হাসপাতালের বাইরে পরিচিতের সঙ্গে দেখা হলে তিনি ফুটপাত বদলে নেন। চায়ের দোকানে বা বাজারে কোনও চেনা লোক আমাকে দেখেই অর্ডার বাতিল করে হাঁটা দেন। এক-দু’দিন নয়, এই অভিজ্ঞতা এখন প্রতিদিনের। এগুলো গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। অপমান লাগে না। সে দিনই এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম তাঁর অফিসে। তিনি এক সহকর্মীর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন এই বলে, ‘আমার বন্ধু করোনা-যোদ্ধা।’ সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক বসতে গিয়েও উঠে গেলেন। আর পিছনেই ফিরলেন না।
ওঁদের খাতায় আমার অপরাধ হল মেডিক্যালের (সিবি) ক্যাজ়ুয়্যাল্টি ব্লক যেটি এখন কোভিড বিল্ডিং, তার পরিচ্ছন্নতা দেখভালের দায়িত্বে আমি। তবে এমন কঠিন সময়ে এই কাজ করতে পেরে আমি গর্বিত। একশো শয্যার ওই বিল্ডিংয়ে আমার কাজ ওয়ার্ডে নিযুক্ত সরকারি ও চুক্তিভিত্তিক সাফাইকর্মীদের পরিচালনা করা। রোগীর অভিযোগ শোনা ও খাবার পৌঁছে দেওয়ার তত্ত্বাবধান করাও আমার দায়িত্ব। এ জন্য পিপিই পরে ঘুরতে হয়। তখনই রোগীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় হয়।
চেনা মুখ না দেখে ওঁদের থাকতে হয়। ফলে ‘আপনি এখন কেমন আছেন?’ এটুকু কেউ জিজ্ঞাসা করলেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন বেশির ভাগ। কিছু দিন আগে এক ভদ্রলোক ভর্তি হয়েছিলেন কোভিড নিয়ে। ভাঙা শিরদাঁড়ার অস্ত্রোপচারের আগে কোভিড ধরা পড়েছিল। অসহ্য যন্ত্রণায় পড়ে থাকা সেই রোগীকে ডায়াপার বদলে দিতে হত। কথা বলার ক্ষমতাও ছিল না। কিন্তু চোখের ভাষা দিয়ে কিছু বলতে চাইতেন। ওঁর কাছে অন্য রোগীদের মতো ফোন ছিল না। আমার ফোন থেকে বাড়ির লোকের গলা শুনিয়ে দিতাম। খুশি হতেন। সুস্থ হয়ে ফিরে গিয়েছেন তিনি। দিন পাঁচেক আগে সুস্থ হয়ে ফিরেছে আমার দেখা সব থেকে খুদে কোভিড রোগীও। বছর আটেকের ছেলেটা জমিয়ে রাখত ওয়ার্ড। একটু ভাল হতেই খেলে বেড়াত। দমকা বাতাসের মতো খুশিতে ভরিয়ে দিত সবাইকে। ওকে খুব মনে পড়ে। এত ধূসরতার মধ্যে এই ভাল স্মৃতিগুলোই মনে রাখতে চাই। না-হলে মানসিক চাপ বাড়বে। শক্তি হারাব।
সকাল সাড়ে সাতটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত ডিউটি করি এক দফা। পিপিই ছেড়ে হাসপাতালে স্নান করে বাড়ি ফিরে আর এক দফা স্নান। খেয়ে, বিশ্রাম করে সন্ধ্যায় আবার ওয়ার্ড ঘুরে রাতে ঘরে ফেরা। তখনও দু’দফায় স্নান। নিরামিষ খাই। অভ্যাস মতো হলুদ-মধু দিয়ে দুধ খাই। নিয়মিত দই, ছানা, কলা, পেয়ারা, রাজমা, ডালিয়া এ সবও খাই। ভোর চারটেয় বেরিয়ে কলেজ স্কোয়ারে পনেরো পাক হেঁটে আসি। যোগাসন করি। তাই আমার মনোবল কোভিড ভাঙতে পারবে না।
কোভিডকে ভয় না পেয়ে সতর্ক থাকতে হবে। পৃথিবীতে অনেক মহামারি এসেছে, চলেও গিয়েছে। মানুষ থেকে গিয়েছে। থাকবেও। আমি-আপনিও থাকব। ভরসা রাখুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy