Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪

দুই পা হারিয়ে লাইনেই এক ঘণ্টা বসে রেলকর্মী

প্রাণ যায় যাক, ‘নিয়মটা’ থাক। কার্যত এমনই যুক্তিতে রেললাইনে পা কাটা পড়া এক কর্মীকে হাসপাতালে পৌঁছতেই প্রায় এক ঘণ্টা সময় নিল রেল। কী ভাবে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হবে এবং কোন হাসপাতালেই বা যাবেন, তাতেই গড়াল সময়। ততক্ষণ পূর্ব রেলের ওই কর্মী দু’টি কাটা পা নিয়ে অসহায় অবস্থায় যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকলেন রেললাইনের পাশেই।

কাটা পা নিয়ে লাইনের ধারেই অসহায় অপেক্ষা সুদামা প্রসাদের।

কাটা পা নিয়ে লাইনের ধারেই অসহায় অপেক্ষা সুদামা প্রসাদের।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৫ ০২:০৭
Share: Save:

প্রাণ যায় যাক, ‘নিয়মটা’ থাক। কার্যত এমনই যুক্তিতে রেললাইনে পা কাটা পড়া এক কর্মীকে হাসপাতালে পৌঁছতেই প্রায় এক ঘণ্টা সময় নিল রেল।

কী ভাবে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হবে এবং কোন হাসপাতালেই বা যাবেন, তাতেই গড়াল সময়। ততক্ষণ পূর্ব রেলের ওই কর্মী দু’টি কাটা পা নিয়ে অসহায় অবস্থায় যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকলেন রেললাইনের পাশেই। সোমবার অমানবিক এই ঘটনার সাক্ষী থাকলেন কয়েক জন রেলকর্মী ও রেলরক্ষী বাহিনীর জওয়ানেরা। আর নিয়মের যুক্তি দেখিয়ে নির্লিপ্ত থাকলেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।

এ দিন বেলা পৌনে এগারোটা নাগাদ ঘটনাটি ঘটেছে হাওড়া স্টেশন থেকে সওয়া কিলোমিটার দূরে পূর্ব রেলের টিকিয়াপাড়া কারশেডের কাছে। রেল সূত্রে খবর, অন্য দিন নিজের দফতরে হেঁটেই যেতেন পূর্ব রেলের টিকিয়াপাড়া কারশেডের সিএনডব্লিউ কোচিং বিভাগের কর্মী সুদামা প্রসাদ। এ দিন কারশেডগামী একটি ফাঁকা অমৃতসর মেলে চেপে পড়েন তিনি। যাওয়ার সময়ে ট্রেনটির গতিও কম ছিল। ঠিক কারশেডের কাছে আসতে ওই রেলকর্মী চলন্ত ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যান। তখনই তাঁর দু’টি পা কাটা পড়ে।

পূর্ব রেল ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এই ঘটনার পরে মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত এই রেলকর্মীর ধাতস্থ হতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে। আশপাশে কেউ না থাকায় প্রথমে তাঁকে সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসেননি। তাই কোনও রকমে রেললাইনের পাশে নিজের শরীরটি টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে আসেন তিনি। এর পরে নিজেই তাঁর স্ত্রী ও দফতরের সহকর্মীদের কাছে সাহায্য চেয়ে মোবাইলে খবর পাঠান।


ইঞ্জিনে চাপিয়ে এ ভাবেই কোনওক্রমে নিয়ে যাওয়া হল তাঁকে। সোমবার।

পূর্ব রেল ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ঘটনাটি ঘটার বেশ কিছুক্ষণ পর গুরুতর আহত ওই রেলকর্মীকে প্রথম দেখতে পান এক আরপিএফ জওয়ান। যন্ত্রণায় কাতরানো ওই রেলকর্মীর কাছ থেকে ঘটনাটি জানার পরে তিনি সঙ্গে সঙ্গে আরপিএফ দফতরে ফোন করেন সাহায্যের জন্য। যে জায়গায় এই ঘটনাটি ঘটেছে, তার বাঁ দিকে আরও তিনটে লাইন পেরোলেই ইস্ট-ওয়েস্ট বাইপাস। সেই রাস্তা দিয়ে রেলের অর্থোপেডিক হাসপাতাল বা হাওড়া হাসপাতালে পৌঁছতে সময় লাগে মিনিট পনেরো। তাই তিনি ওই রাস্তা দিয়েই অ্যাম্বুল্যান্স পাঠাতে বলেন।

এ দিন ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে পূর্ণেন্দু কুমার নামে আরপিএফ-এর ওই কর্মী বলেন, ‘‘খবর দেওয়ার পরেই আরপিএফ দফতর থেকে একটি অ্যাম্বুল্যান্স ইস্ট-ওয়েস্ট বাইপাস দিয়ে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়।’’ ঘটনাস্থলে আহতের সহকর্মীরা জানান, এ ভাবে নাকি আহত রেলকর্মীকে সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায় না। তাঁকে প্রথমে টিকিয়াপাড়া কারশেডের কাছে রেলের প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। এ সব করতে গিয়ে আরও সময় নষ্ট হয়ে যায়।

যেখানে ঘটনাটি ঘটে, সেখান থেকে লাইন ধরে হেঁটে টিকিয়াপাড়ার ওই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছতে সময় লাগবে প্রায় ২০ মিনিট। কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে কী ভাবে নিয়ে যাওয়া হবে আহতকে? কারণ স্ট্রেচারে করে এতটা পথ নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই ঠিক হয় ওই রেলকর্মীকে নিয়ে যেতে আনা হবে আস্ত একটি ইঞ্জিন। সেই মতো টিকিয়াপাড়া কারশেডে থাকা একটি ইঞ্জিনও আনা হয়।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দু’টি কাটা পা নিয়ে ওই আহত ব্যক্তিকে ইঞ্জিনে তুলতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন রেলের কর্মীরা। তাঁকে নিয়ে বারবার টানা-হ্যাঁচড়ার পরেও তাঁকে তুলতে না পেরে ঠিক হয় প্লাস্টিকে মুড়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে ইঞ্জিনে তোলা হবে তাঁকে। সেই মতো ফের কারশেড থেকে আনতে পাঠানো হয় প্লাস্টিক আর দড়ি। সে সব এলে অবশেষে আহত রেলকর্মীকে ইঞ্জিনে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় টিকিয়াপাড়া স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। সেখান থেকে ফের অ্যাম্বুল্যান্সে করে নিয়ে যাওয়া হয় হাওড়া ময়দানের কাছে রেলের অর্থোপেডিক হাসপাতালে। ততক্ষণে বেজে গিয়েছে দুপুর ১২টা। দীর্ঘ এক ঘণ্টা ধরে ওই ভাবে তাঁকে নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়ার পরে স্বাভাবিক ভাবেই ততক্ষণে আরও কাহিল হয়ে পড়েছেন ওই রেলকর্মী।

এ দিন হাসপাতালে দাঁড়িয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের এক কর্মী বলেন, ‘‘কর্তৃপক্ষের গাফিলতির ও রেলের মান্ধাতা আমলের নিয়মের ফেরে যে ভাবে এক সহকর্মীর সঙ্গে অমানবিক আচরণ করতে হল, তা আমরা মেনে নিতে পারছি না। এই নিয়ম বদলানো প্রয়োজন।’’

এ দিকে, ট্রেনে কাটা পড়ে এক ঘণ্টা রেললাইনের ধারে পড়ে থাকার অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ অফিসার রবি মহাপাত্র। তিনি বলেন, ‘‘আহত রেলকর্মীর এক ঘণ্টা পড়ে থাকার খবর ঠিক নয়। খবর পেয়েই তাঁকে উদ্ধার করা হয়েছে।’’ কিন্তু আহত রেলকর্মীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে রেলের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়াটা কী দস্তুর?

রবিবাবু বলেন, ‘‘আহত কম-বেশি যা-ই হোক, কোনও রেলকর্মীকেই সরাসরি বড় হাসপাতালে না গিয়ে প্রথমে রেলের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হয়। এটাই নিয়ম। তেমনটাই করা হয়েছে। এ জন্য কোনও দেরি হয়নি।’’

এ দিকে রেলের প্রাক্তন কর্তা সুভাষরঞ্জন ঠাকুর এই যুক্তি অবাস্তব বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন। বলেন, ‘‘এমন কোনও নিয়ম রেলে নেই। ঘটনার গুরুত্ব বুঝেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা।’’

— নিজস্ব চিত্র।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy