ফাইল চিত্র।
‘এই শহর দিনে রাতে সবাইকে টানে/ লাভ দেখিয়ে, লোভ দেখিয়ে, লুকোনো ইচ্ছার গায়ে হাত বুলিয়ে,’— জগন্নাথ চক্রবর্তীর এই কবিতার মতোই মেদিনীপুর শহরে জন্মানো আমাকে ছোট থেকেই হাতছানি দিত কলকাতা। প্রপিতামহ রাজনারায়ণ বসুর লেখা ‘সেকাল আর একাল’ পড়ে বাংলার নবজাগরণ ও কলকাতা সম্পর্কে আগ্রহ হয় শিশুকালেই। সংস্কৃত কলেজের ইংরাজি শিক্ষকের চাকরি ছেড়ে ১৮৫১ সালে মেদিনীপুরের জেলা স্কুল ও কলেজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন রাজনারায়ণ বসু। সেই থেকে আমাদের মেদিনীপুরে বাস।
সালটা ১৯৭৭, ২৪ সেপ্টেম্বর। বাবার কোলে চড়ে ‘নিজের চোখের চেয়েও বড় চোখ মেলে পা দিয়েছিলাম এই শহরের বাঁধানো রাস্তায়’। ইডেন গার্ডেন্সে পেলের টিম, কসমস আর মোহনবাগানের খেলা দেখতে। এর কিছু বাদে এক কবিতা-তরুণীর প্রেমে পড়ে তার সন্ধানে কলকাতায় আসা। এ বার কলকাতা তার রূপ-রস-গন্ধ দিয়ে এক জন্মান্ধকে রামধনুর রং চেনাতে থাকে।
তখন ফার্ন রোডে থাকছি। সল্টলেকের কলেজে ম্যানেজমেন্ট পড়ি। হাতিবাগানে যাই কবিতার মহড়ায়। আকাশবাণী ভবনের যুববাণীতে পার্টটাইম কাজ করি। আর সন্ধ্যা নামলে নন্দনে বসে আড্ডা। নন্দন প্রাঙ্গণ তখনও এমন সেজে ওঠেনি। সদ্য সেখানে নিরাপত্তা কঠোর হচ্ছে। অন্ধকার গাঢ় হলে যুগলদের তুলে দিত পুলিশ। রবীন্দ্র সদন প্রাঙ্গণে সেই সময়ে বাৎসরিক আকর্ষণ ছিল, পঁচিশে বৈশাখের প্রভাতী কবি-প্রণাম। নন্দনের চলচ্চিত্র উৎসবে কলকাতা সেজে উঠত। আজও ওঠে। ‘গানমেলা’ ও ‘কবিতা উৎসব’ এ শহরের আর এক আকর্ষণ। আমাদের কবিতার মিউজ়িক— আবৃত্তির ব্যান্ড ভাবনা, মহড়া ও কাজকর্ম হত খিদিরপুরের কবিতীর্থের এক বাড়িতে। দেখেছিলাম, বর্ণ হিন্দুদের সঙ্গে খানদানি মুসলমান এবং খ্রিস্টান পরিবারগুলির সেখানে সহাবস্থান। প্রবল বর্ষায় কবিতীর্থের কোমর সমান জল পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেতাম ছাদের ঘরে, কবিতার কারখানায়। সেই জল এখনও জমছে। তবু খিদিরপুরের আকাশ শান্তিতে ভোরের
আজান শোনে।
হাবিব তনবিরের নাটক, তিজন বাইয়ের পাণ্ডবানীর সেই ছত্তীসগঢ়ি ভাষায় মহাভারতের কাহিনির আবৃত্তি তখন ছড়িয়ে যাচ্ছে আকাশে। ১৯৯৬-এর ১৭ নভেম্বর। পিট সিগার এলেন কলকাতায়। এ দিকে সুমনের হাত ধরে নতুন বাংলা গানের পালে হাওয়া লেগেছে। নচিকেতা, লোপামুদ্রারা পাল্টে দিচ্ছেন বাঙালির গানের স্বপ্ন। অনেক দিনের নীরবতা ভেঙে মঞ্চে এলেন শম্ভু মিত্র, তাঁর দিনান্তের প্রণাম নিয়ে। যা আবৃত্তির সমকালীন গ্রন্থনা। এরই মধ্যে শক্তি, সুনীল, আয়ান রশিদের প্রশ্রয়ে আয়োজন করছি কবিতা সন্ধ্যার। প্রবেশ করছি গালিবের গজ়ল থেকে গিনসবার্গের কবিতায়। এক মধ্যরাতে দু’কামরার বাইরে কারও আহ্বান, ‘শোভন বাড়ি আছ?’ বেরিয়ে দেখি, শক্তিদা। সঙ্গে আবৃত্তিরসিক দম্পতি।
এমন ভাবে শহরকে দেখার চোখ কিন্তু সাম্প্রতিক তালাবন্ধ শহরের ঝলকও দেখেছিল ১৯৯২ সালের রামমন্দির ধ্বংসের পরে। সাম্প্রদায়িক ভাইরাসে আক্রান্ত শহরে ১৪৪ ধারা চলছিল। হাঁটতে হাঁটতে হাওড়া থেকে বাইপাসের ধারের বাসায় ফিরেছিলাম। তারও আগে অবশ্য ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গাঁধীর হত্যার পরেও বন্ধ শহর দেখেছেন শহরবাসী।
কলকাতা আমার ভালবাসার রাজধানী। নিত্যনতুন বিভঙ্গে, বিন্যাসে, বৈপরীত্যে ধরা দেয় সে। তবুও শহরের কিছু জিনিস প্রেমিক-মনেও প্রশ্ন তোলে। যেমন, জলের বিশুদ্ধতার রকমভেদ কেন হবে? ইউরোপ, আমেরিকায় ঘোরার সুবাদে দেখেছি, সেখানে শৌচাগার থেকে খাবার টেবিল— একই গুণমানের জল পৌঁছয়। এ শহরের অন্যতম গণপরিবহণ অটো নিয়েও বেজায় অবহেলা। ভাড়ার যদি নির্দিষ্ট তালিকা অটোস্ট্যান্ডে টাঙানো থাকত, খেয়ালখুশির বিক্রম কমত বলেই মনে হয়। কষ্ট পাই যখন শুনি, নেশাগ্রস্ত চালকের চাকায় পিষে মৃত্যু হয়, খুচরো না পেলে যাত্রীকে লাঞ্ছিত হতে হয়।
কয়েক বছরে অনেকগুলি উড়ালপুল শহরের গতি বাড়িয়েছে। যানজটও কমছে ধীর গতিতে। মনে হয়, আরও কয়েকটি উড়ালপুল পেলে ভাল হত। যেমন, বাইপাসকে যাদবপুরের সঙ্গে যুক্ত
করেছে জীবনানন্দ সেতু। কিন্তু রোজ সেখানে থমকে থাকে গতি। পাশেই আরও একটি সংযোগের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখলে মানুষ কিছুটা হাঁফ ছাড়েন। কলকাতার আকাশরেখাকে ক্রমে ঢাকছে হোর্ডিং, স্কাইস্ক্র্যাপার। উঁচু বাড়ির ছাদ থেকেও সবুজ মাঠ, গাছপালা আড়াল হয়ে যাচ্ছে ওদের দাপটে। অবৈধ ও পুরনো সব ব্যানার, পোস্টার তাপ্পি মারা জামার মতো শহরের গায়ে ঝুলছে। গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা ও মোড়ে, ফুটপাতে এক-তৃতীয়াংশের বেশি জায়গা নিয়ে হকারেরা বসে আছেন। হাঁটতে কষ্ট হয়।
তবুও যে কবিতা-তরুণীর সন্ধানে কলকাতায় আসা। জীবিকা নয়, জীবনের জন্য। আজও সেই তরুণীর অন্বেষণে আমি। ‘ধ্বংসের নেশায়, ধ্বংসকে ভালবেসে আমরা চেয়েছি জন্মজয়ের প্রবল উত্থান’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy