ফাইল চিত্র।
হাউ হাউ করে শুধু কেঁদেই যাচ্ছিল বছর পনেরোর কিশোরীটি। কিছু সময় পরে ক্ষুব্ধ গলায় বলেছিল, ‘‘হ্যালো, আপনি আমার কথা শুনছেন কি?’’ ফোনের অন্য প্রান্ত বলেছিল, ‘‘অবশ্যই, একটু শান্ত হও। তোমার যখন মনে হবে, কথা বোলো। আমি অপেক্ষা করছি।’’
প্রথমে মা, তার ঠিক তিন দিনের মাথায় বাবা মারা যান ওই কিশোরীর। কোভিডে। বাঙালি মেয়েটি ভিন্রাজ্য থেকে ফোন করে জানিয়েছিল, বেঁচে থেকে আর লাভ কী! তাই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।
কোভিডে কেউ হারিয়েছেন স্বজন, কেউ বা কাজ। কারও বা সম্পর্কে ঘটেছে অবনতি, সংসারে তৈরি হয়েছে অশান্তি। দিন-রাত কোভিডে মৃত্যু দেখতে দেখতে অবসাদে আক্রান্ত এক ডাক্তারও আত্মহত্যা করার ঠিক আগের মুহূর্তে ফোন করেছিলেন। আর সেই কারণেই আজ তাঁরা সকলেই ফের সুস্থ জীবনে। কেউ লড়াই করছেন। কেউ হয়ে উঠেছেন ‘কোভিড যোদ্ধা।’
কোভিড-পরবর্তী এই সময়ে অবসাদ ও আত্মহত্যার প্রবণতা রুখতে ‘সুইসাইড প্রিভেনশন হেল্পলাইন’ (১৮০০ ৫৩২ ০৮০৭) চালু করেছে ‘ইন্ডিয়ান সাইকায়াট্রিক সোসাইটি।’ এক মাসও হয়নি, এর মধ্যেই ৫০০-র বেশি ফোন এসেছে ওই নম্বরে। অন্তত ৪৬ জনের আত্মহত্যা রোখা গিয়েছে বলেও দাবি সেখানকার চিকিৎসকদের। এর মধ্যে কোভিডে মা-বাবাকে হারানো ওই কিশোরীর পাশাপাশি কাজ হারানো মানুষও রয়েছেন। ওই সংস্থার দাবি, তাদের শরণাপন্ন হওয়া এক জনও এখনও আত্মহননের পথে যাননি।
কিন্তু এত ফোন আসছে কেন? কেনই বা করোনায় এত অসহায়ের মৃত্যুর পরেও মানুষ নিজেকে শেষ করে দিতে চাইছে? ‘ইন্ডিয়ান সাইকায়াট্রিক সোসাইটি’র সভাপতি তথা মনোরোগ চিকিৎসক গৌতম সাহা বললেন, ‘‘অবসাদ, আত্মহত্যার প্রবণতা আগেও ছিল। করোনা-পরবর্তী সময়ে গোটা বিশ্বে এক বিশাল পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। যা অর্থনীতির পাশাপাশি মানুষের মনেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। মানুষ নিজেকে খুব একা ও অসহায় বলে মনে করছে। ভরসা করতে পারার বিশ্বাসটাও হারিয়ে যাচ্ছে। সাময়িক ক্ষতি থেকে উঠে দাঁড়ালেও লড়াই করার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলছেন অনেকে। সুন্দর পৃথিবী ও পরিবেশও অসহনীয় হয়ে উঠছে।’’
সাম্প্রতিক সমীক্ষার পরে ওই সংস্থার পরিসংখ্যানও বলছে সেই কথা। কোভিড-পরবর্তী সময়ে গোটা বিশ্বে চলতি বছরেই আট লক্ষ মানুষ অবসাদে আত্মহত্যা করেছেন। আরও ভয়ঙ্কর তথ্য হল, মৃতদের ৫৪ শতাংশই ভারত ও চিনের বাসিন্দা। বর্তমানে বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে এক জন মানুষ আত্মহত্যা করেন এবং আরও ২০ জন আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এ রাজ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সিদের মধ্যেই সব চেয়ে বেশি। বিষয়টি তাই ভাবাচ্ছে মনোরোগ চিকিৎসক ও মনোবিদদেরও। ওড়িশার মনোরোগ চিকিৎসক অমৃত পত্তজোশী জানালেন, আত্মহত্যার বিষয়টি নিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচনা ও বৈঠকের পরেই সম্প্রতি তৈরি হয়েছে এই হেল্পলাইন।
কী ভাবে কাজ করছে হেল্পলাইন?
ওই নম্বরে রাত ৮টা থেকে ২টোর মধ্যে ফোন করলে যে কোনও এক জন ‘সুইসাইড ফার্স্ট রেসপন্ডার’ বা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মহিলা মনোবিদ ফোন ধরছেন। সমস্যা গভীরতর হলে ফোন চলে যাবে সুপারভাইজ়ারদের কাছে। এক-এক জনের সমস্যা শুনে সেই মতো পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা।
মানসিক ভাবে ভেঙে পড়া এমন মানুষদের কী ভাবে সামলাচ্ছেন?
‘জেম’ নামে এক রেসপন্ডার জানালেন, সেটি তাঁর ছদ্মনাম। কারা ফোন করছেন এবং তাঁদের সঙ্গে কী কথা হচ্ছে, সবটাই গোপন রাখা হয়। জেম জানালেন, লকডাউনে মঞ্চে অনুষ্ঠান করতে না পেরে অবসাদে ভুগছিলেন এক শিল্পী। কোভিডে পর পর মৃত্যু দেখে অবসাদের পাশাপাশি পারিবারিক অশান্তিতে কষ্ট পাচ্ছিলেন এক চিকিৎসক। আত্মহত্যা করতে যাওয়ার ঠিক আগে ফোন করেন দু’জনেই।
জেমের কথায়, ‘‘প্রথমে তাঁরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। ওঁদের ধাতস্থ হতে সময় দেওয়া হয়। একটু ধাতস্থ হতেই (উইন্ডো অব টলারেন্স) আস্তে আস্তে কথা বলে সমস্যাটা ঠিক কোথায়, জেনে নিয়ে শুরু হয় চিকিৎসা। জেম বলেন, ‘‘কোভিডে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় মনের কথা জানানোর কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না ওঁরা। বন্ধুত্বের সেই বিশ্বাসটুকু ফিরে পেয়ে ফের নতুন জীবনে ফিরে গিয়েছেন দু’জনেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy