খাওয়ার দোকানে খুচরো না থাকার বোর্ড ঝুলছে।
দৃশ্য-১। উলুবেড়িয়ার একটি নার্সিংহোম। এখানে ভর্তি ছিল এক সদ্যজাত শিশু। সুস্থ হয়ে যাওয়ায় চিকিৎসকেরা তার ছুটি করে দিয়েছেন বুধবার সকালে। নার্সিংহোমে বিল হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু ছেলেকে বাড়ি নিয়ে যেতে ঝামেলায় পড়েছেন মা রেশমা বিবি। জানালেন, তাঁর স্বামী দিল্লিতে থাকেন। সেখানে জরির কাজ করেন। এদিন সকালেই টাকা পাঠানোর কথা ছিল তাঁর। কিন্তু এটিএম বন্ধ। ফলে টাকা তুলতে পারেননি তিনি। আর সেই কারণে ছেলের ছুটি আটকে গিয়েছে।
দৃশ্য-২। ধুলাগড়ি টোলপ্লাজা। সকাল ১০টা নাগাদ টোলপ্লাজার দুইদিকেই দেখা গেল গাড়ির লম্বা লাইন। কারণ টোলট্যাক্স মেটাতে বেশিরভাগ গাড়িচালক কাউন্টারে ধরাচ্ছেন পাঁচশো টাকার নোট। খুচরো দিতে হিমশিম খাচ্ছেন কাউন্টারের কর্মীরা। এক কাউন্টারে আছে তো অন্য কাউন্টারে নেই। যে কাউন্টারে আছে সেখানে ছুটছেন খুচরো না থাকা কাউন্টারের কর্মীরা। নাকাল হচ্ছেন গাড়ির চালক থেকে আরোহী।
দৃশ্য-৩। উলুবেড়িয়ায় মুম্বই রোডের ধারে একটি পেট্রোল পাম্প। এক যুবক মোটরবাইকে এসে দেড়শো টাকার তেল চেয়ে পাম্পকর্মীর হাতে ধরিয়ে দিলেন পাঁচশো টাকার নোট। অন্য দিন হলে তেল পেয়ে যেতেন। কিন্তু এদিন বিধি বাম। পাম্পের কর্মী জানালেন, পুরো পাঁচশো টাকার তেল নিতে হবে। খুচরো দেওয়া যাবে না। তেল না নিয়েই মোটরবাইকের মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলেন ওই যুবক।
পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট বাতিল করা হয়েছে মঙ্গলবার রাত ১২ টা থেকে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার দিনভর পাঁচশো ও হাজার টাকার নোটকে কেন্দ্র করে নৈরাজ্যের এই ছবি চোখে পড়ল গোটা হাওড়া জেলায়। বাগনান, উলুবেড়িয়া, আমতা, শ্যামপুর, ডোমজুড় সর্বত্র সবজি ও মাছের বাজারে ব্যবসায়ীদের মুখে শোনা গিয়েছে হাহাকার। বেশিরভাগ ক্রেতাই মাছ ও সবজি কিনতে এসে পাঁচশো টাকার নোট ধরাচ্ছেন। কিন্তু খুচরো দিতে অপারগ ব্যবসায়ীরা জানিয়ে দিচ্ছেন, হয় পাঁচশো টাকার পুরো জিনিস নিতে হবে নয়তো খুচরো দিতে হবে। কিন্তু পাঁচশো টাকার কাঁচা আনাজ কিনতে দেখা গেল না অনেককেই। ফলে খালি বাজারের ব্যাগ নিয়েই ঘরের পথে পা বাড়ালেন তাঁরা। শুকনো মুখে ফের খরিদ্দারে আশায় বসে থাকতে দেখা গেল ব্যবসায়ীদের।
পাশের জেলা হুগলিতেও বিভিন্ন বাজারে চোখে পড়েছে একই ছবি। জেলার অন্যতম বড় বাজার শেওড়াফুলি। কিন্তু ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট নিয়ে সেখানেও বেচাকেনায় সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে খরিদ্দার থেকে ব্যবসায়ীদের। ঝামেলা বেঝেছে অন্য ক্ষেত্রেও।
বাজারে দেখা নেই খরিদ্দারের। উলুবেড়িয়ায় সুব্রত জানার তোলা ছবি।
চুঁচুড়ার বেণীমাধব সোম লেনের বাসিন্দা, আইনজীবী জয়দেব সিংহরায়ের মাতৃবিয়োগ হয়েছে। শুক্রবার পারলৌকিক ক্রিয়া। জয়দেববাবু বলেন, ‘‘বুধবার সকালে মুদির দোকানি ৫০০ বা হাজার টাকার নোট নেননি। বাধ্য হয়ে ধারে মাল কিনতে হয়েছে। শুক্রবার কী পরিস্থিতি হবে, তা ভেবেই চিন্তায় পড়েছি। তবে একটাই স্বস্তি, শুক্রবার ব্যাঙ্ক খোলা থাকবে। কিন্তু কী পরিমাণ ভিড় হবে, কে জানে?
স্বামীর কিডনি বিকল। বুধবার সকালে তাঁর ডায়ালিসিস করাতে শ্রীরামপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে এসেছিলেন স্ত্রী পদ্ম বেরা। সিঙ্গুরের তেলিপুকুরের বাসিন্দা ওই মহিলা জানতেন না প্রধানমন্ত্রীর ‘ফরমান’। ডায়ালিসিসের খরচ মেটাতে এনেছিলেন ৫০০ টাকার নোট। সেই টাকা নিতে অস্বীকার করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যা শুনে গ্রাম্যবধূটি পড়েন বেজায় ফাঁপড়ে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরে টাকা মিটিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়ে ডায়ালিসিস চালু করলেন। তবে পদ্মদেবীর মতো ভাগ্য সকলের সহায়ক হয়নি! খুচরো না থাকায় কেউ পাম্পে তেল কিনতে গিয়ে ভুগেছেন, কেউ বা মেয়ের জন্মদিনের ভোজের জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন।
আবার প্রধানমন্ত্রীর এ হেন ফরমান পৌষমাস হয়ে দেখা দিয়েছে কারও কাছে। যেমন আরামবাগের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের এক গাড়ি ব্যাবসায়ী কাশীনাথ দত্ত। বাড়ির প্রাচীর তৈরির সময় তাঁর ‘গচ্চা’ গিয়েছিল ১৫ হাজার টাকা। জানালেন, স্থানীয় নেতাকে তোলা দিতে হয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ফরমান জারির পরে তা ফেরত পাওয়ার আশ্বাস মিলেছে। যে নেতাকে টাকা দিতে হয়েছিল তিনি তা ফেরত দেবেন বলেছেন। তবে তাঁকে দু’টি শর্ত মানতে হবে। কী সেই শর্ত?
কাশীনাথবাবু জানান, ওই নেতার কাছে থাকা ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট নিয়ে প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা তাঁকে তাঁর গাড়ির চালকদের মাধ্যমে পেট্রল পাম্পে তেল কিনে খরচ করতে হবে। তার বদলে ওই নেতাকে ওই পরিমাণ টাকা দিতে হবে। যদিও ওই নেতা ১০০ টাকা পিছু ১০ টাকা বাটা দিতে রাজি হয়েছেন। টাকা ফেরতের আশ্বাস পেয়ে তিনিও তাই রাজি হয়েছেন।
তথ্য: নুরুল আবসার, পীযূষ নন্দী ও প্রকাশ পাল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy