বিয়ের দিন কেট-চন্দন। নিজস্ব চিত্র
মাসছয়েক আগেও ইতিহাস আর প্রত্নতত্ত্ব চর্চায় দিন কাটছিল সাওপাওলোর কেট রেজিনার।
শ্রীরামপুরের চন্দন রায় ডুবে ছিলেন গানবাজনা, সিনেমা তৈরি এবং বৌদ্ধধর্ম নিয়ে পড়াশোনায়।
ভরা ফাগুনে এক হয়ে গেল চার হাত। মিলিয়ে দিল সোশ্যাল মিডিয়া। ভৌগোলিক অবস্থান, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, ভাষার দূরত্ব—সব পিছনে ফেলে কেটই উড়ে এলেন চন্দনের কাছে। এমনই প্রেমের টান!
চন্দন-ঘরণী এখন শাঁখা-সিঁদুর, শাড়ি পরছেন। রুটি বেলছেন। চা করছেন। বাংলা বলছেন— ‘খাব’, ‘ভাত’, ‘মুড়ি’, ‘ধন্যবাদ’। আর ভাঙা ইংরেজিতে বলছেন, ‘‘প্রেমের টানেই সবাইকে ছেড়ে এতটা চলে এলাম। এত ভাল শ্বশুরবাড়ি পাব কল্পনাও করিনি। এমনই একটা সুন্দর সংসার চেয়েছিলাম।’’ আর চন্দনের পরিবার বলছে, ‘‘ব্রেভ গার্ল।’’ কেট তাঁদের কাছে হয়ে গিয়েছেন কেকা।
বছর ত্রিশের কেট রেজিনা সিলভা ইয়ামাগুটির বাড়ি ব্রাজিলের সাওপাওলো শহরে। বাবা রজার কিয়োজি ইয়ামাগুটি অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী। মা রোজ নার্স। দাদা আছেন। আর রয়েছে পোষা কুকুর-বেড়াল। কেট প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। আগ্রহ রয়েছে ইতিহাসেও। মাতৃভাষা পর্তুগিজ। ভারত সম্পর্কে ধ্যানধারণা অল্পই। মহাত্মা গাঁধী আর মাদার টেরিজার কথা জানেন। পর্তুগিজ ভাষায় রামায়ণও পড়েছেন। ঘটনাচক্রে শ্বশুরবাড়িও হল তাঁর সেই জেলায়, যেখানকার আদি সপ্তগ্রাম এবং চুঁচুড়ায় এক সময়ে ঘাঁটি গেড়েছিল পর্তুগিজরা। সে দিক থেকে দেখলে এ-ও এক আশ্চর্য যোগাযোগ।
তা বলে ভারতে আসার কথা কখনও ভেবেছিলেন ঘরোয়া স্বভাবের মেয়েটি? উত্তর, ‘‘না।’’ তা হলে?
এখানেই সোশ্যাল মিডিয়া ম্যাজিক দেখিয়েছে। শ্রীরামপুরের জি সি গোস্বামী স্ট্রিটের বছর চল্লিশের চন্দন রায় ওরফে ডোডো বিয়ে না করার জেদ ধরেছিলেন। বছর পাঁচেক আগে বৌদ্ধধর্মের চর্চা শুরু করেন। সেই সূত্রেই মাসছয়েক আগে ফেসবুকে কেটের সঙ্গে আলাপ। তা ছাড়া, লাতিন আমেরিকার সংস্কৃতির প্রতিও চন্দনের ঝোঁক রয়েছে। পর্তুগিজে একটি আর স্প্যানিশ ভাষায় পাঁচটি গানও গাইতে পারেন তিনি। ফেসবুক থেকে ধীরে ধীরে মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে গান এবং অন্যান্য তথ্য আদানপ্রদানও শুরু হয়ে যায়। তা থেকে ভিডিও-কলিং। ভিতরে ভিতরে অবশ্য অন্য টান বাড়ছিল। মাস কয়েক আগে হঠাৎ একদিন কেটকে ‘প্রোপোজ’ করে বসেন চন্দন।
তার পর?
কেটের দাবি, ‘‘আমি রাজি হইনি। তিন বার না বলেছিলাম। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে রাজি হই।’’ কিন্তু মেয়ের মুখে সব শুনে প্রথমে আপত্তি তুলেছিলেন কেটের মা। পরে রাজি হন। অল্প দিনের পরিচয়ে কেট শ্রীরামপুরের যুবকটিকে এতটাই ভালবেসে ফেলেন যে একাই চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ২৫ ডিসেম্বর বিমানে চড়েন। ৩০ ঘণ্টার যাত্রা শেষে দমদম বিমানবন্দরে দেখা হতেই জড়িয়ে ধরেন চন্দনকে। চন্দনের বন্ধুরা কেটের ছবি নিয়ে ঘুরছিলেন। চন্দন বললেন, ‘‘রানওয়ে ফাঁকা না থাকায় বিমানটা আকাশে চক্কর কাটছিল। যত সময় গড়াচ্ছিল, টেনশন বাড়ছিল। ওকে দেখে চোখের জল আটকাতে পারিনি।’’
চন্দনের বাড়িতে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছেন কেট। সদর দরজা থেকে ঘর পর্যন্ত ফুল বিছানো হয়েছিল। চন্দনের চার পিসি-পিসেমশাই, দিদি জামাইবাবু সকলেই বলে উঠেছিলেন, ‘‘ব্রেভ গার্ল।’’ ভাষার দূরত্ব সত্ত্বেও কেট এখানে এসে দিব্যি মানিয়ে নিয়েছেন। গত ৫ ফেব্রুয়ারি চন্দনের সঙ্গে কেটের রেজিস্ট্রি-বিয়ে হয়। ছোট্ট অনুষ্ঠান হয়। লাল শাড়ি আর গয়নায় সেজে কেট বলেন, ‘‘এই পোশাক পরে দুর্দান্ত অনুভূতি হচ্ছে।’’ ব্রাজিলের বাড়িতে বসে কেটের পরিজনেরা বিয়ের অনুষ্ঠান দেখেছেন। আনন্দে তাঁদের চোখের জল গড়িয়েছে।
কেটের ডাকনাম কিকা। চন্দনের মা রেখাদেবী ডাকেন কেকা বলে। চন্দন বেরিয়ে গেলে রেখাদেবীর সঙ্গেই থাকেন কেট। রেখাদেবীর কথায়, ‘‘আমি ওঁর কথা বুঝি না। ও আমার কথা বুঝতে পারে না। দু’জনেই আকার-ইঙ্গিতে কথা বলি। অসুবিধা হয় না। নিজের মেয়ের মতোই হয়ে গিয়েছে এই ক’দিনে।’’
পেলে-গ্যারিঞ্চার দেশে জন্মেও কেট অবশ্য ফুটবল ভালবাসে না। চন্দন বলেন, ‘‘ও গান নিয়ে থাকতে ভালবাসে। ও আমার জীবনে না এলে সংসারের মানেটাই জানতাম না। সব কিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। আমার জন্য একটা মেয়ে এতটা দূর চলে এল। এ তো রূপকথা!’’
এই ক’দিনে চন্দনের বিদেশিনি বউের পরিবর্তন দেখে চমকে গিয়েছেন পড়শিরা। তাঁরা বলছেন, আদব-কায়দা তো দিব্যি শিখে নিয়েছেন! বাংলাটাও শিখে নেবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy