কেপিসি মেডিক্যালে কোটায় ভর্তির সেই বিজ্ঞপ্তি
ধরা যাক, মেধা-তালিকায় কেউ রয়েছে তিনশো নম্বরে। তিন হাজারে থাকা প্রার্থী ভর্তি হয়ে গেল। অথচ তার কপালে শিকে ছিঁড়ল না!
প্রসঙ্গ: পশ্চিমবঙ্গে মেডিক্যালে ভর্তি। ডাক্তারি শিক্ষার সুযোগলাভের ক্ষেত্রে যাতে মেধাই একমাত্র বিচার্য হয়, সেই লক্ষ্যে অভিন্ন প্রবেশিকা (নিট)-র ব্যবস্থা করেছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। স্থির হয়েছে, ‘ম্যানেজমেন্ট কোটা’য় ভর্তির জন্য বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ নিজে কোনও পরীক্ষা নিতে পারবে না। সে ক্ষেত্রেও শুধু নিট র্যাঙ্কই বিবেচ্য।
কিন্তু অভিযোগ, সরকারি নিয়মের ফাঁক গলে পশ্চিমবঙ্গের কোনও কোনও কলেজ আজব আজব নিজস্ব নিয়ম বানিয়েছে। যার সুবাদে মেধা-তালিকার তিনশো নম্বরকে টপকে তিন হাজারি প্রার্থী দিব্যি ভর্তি হয়ে যেতে পারে! যেমন, কলকাতার কেপিসি মেডিক্যাল কলেজ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, তারা ‘ম্যানেজমেন্ট’ কোটায় নিট উত্তীর্ণদেরই ভর্তি করবে। তবে ‘ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভ’ ভিত্তিতে। প্রথম জমা পড়া সাতাত্তর জন আবেদনকারীর নাম বিবেচিত হবে।
শুনে স্বাস্থ্যভবনের কর্তারা বিস্মিত। তাঁরা জানাচ্ছেন, ‘আগে এলে আগে সুযোগ’-এর ভিত্তিতে অন্তত ডাক্তারিতে ভর্তির কোনও সংস্থান থাকতে পারে না। ওঁদের কাছে অভিযোগও এসেছে বিস্তর। ‘কার আবেদন কখন জমা পড়ছে, আমরা জানি না। কলেজ তো এর ফায়দা তুলতেই পারে!’— লিখেছেন এক অভিভাবক।
শুক্রবার বিকেলে কেপিসি’র বাছাই তালিকা প্রকাশের পরে শোরগোল পড়ে যায়। বহু অভিভাবক ও পড়ুয়া কলেজে গিয়ে বিক্ষোভ দেখান। তাঁরা চাইলেও অধ্যক্ষ দেখা করেননি। পরশুরামন জয়শঙ্কর নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘‘আমার ছেলের নিট র্যাঙ্ক ৮১ হাজার ৯৪৫। ও পেল না। অথচ ১ লাখ ৭৪ হাজারের বেশি র্যাঙ্ক নিয়েও কেউ কেপিসি’র লিস্টে জায়গা করে নিয়েছে! এ রকম হতে পারে, ভাবা যায় না!’’ আর এক অভিভাবক চন্দন মাইতির খেদ, ‘‘আমার ছেলের নিট র্যাঙ্ক ৪৭ হাজার ১৭১। ওর বহু নীচে থেকেও কেউ কেউ এখানে পড়তে পারবে। ও পারবে না। মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।’’
আজ, শনিবার সকালে কেপিসি’তে কাউন্সেলিং ও ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু। কিন্তু ভর্তির এই নিয়মের পিছনে যুক্তি কী?
এ দিন কেপিসি’র সিইও জয়দীপ মিত্রকে ফোনে ধরা হলে উত্তর মিলল, ‘‘যা বলার, মেডিক্যাল ডিরেক্টর বলবেন।’’ মেডিক্যাল ডিরেক্টর সৌরভ ঘোষ জানালেন, বলার এক্তিয়ার অধ্যক্ষের। কেপিসি’র অধ্যক্ষ সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমরা অনেক আলোচনার পরে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’
কিন্তু এতে অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রী বঞ্চিত হবে না? টাকার খেলার অভিযোগও তো উঠছে?
সিদ্ধার্থবাবু এ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। কেপিসি কর্তৃপক্ষের তরফে অবশ্য জোরের সঙ্গে দাবি করা হয়েছে, এ সবই অপপ্রচার। তাঁদের বক্তব্য— ভর্তি হচ্ছে পুরোপুরি নিয়ম মেনে, কোথাও অবৈধ কিছু হচ্ছে না। যদিও অভিভাবকদের একাংশের পর্যবেক্ষণ: বিভিন্ন বেসরকারি কলেজ এত দিন নিজেরা ম্যানেজমেন্ট কোটায় ভর্তি করত। বিনিময়ে পড়ুয়াপিছু তিরিশ লাখ থেকে এক কোটি টাকাও নেওয়া হচ্ছিল। কেন্দ্রের নতুন নির্দেশে বেকায়দায় পড়ে তারা উপার্জনের বিবিধ অনৈতিক ফন্দি আঁটছে বলে আক্ষেপ করেছেন ওঁদের অনেকে।
আর সেই সূত্রেই ভর্তি প্রক্রিয়ায় ‘অস্বচ্ছতা’র জন্য আঙুল উঠছে অন্যান্য কিছু প্রতিষ্ঠানের দিকেও। যেমন, হলদিয়া আইকেয়ার ডেন্টাল মেডিক্যাল কলেজের ওয়েবসাইট গত শিক্ষাবর্ষের তথ্যে ভরা। এ বছর কবে অ্যাডমিশন শুরু বা শেষ, ভর্তির মাপকাঠি কী— এ সব সম্পর্কে কিচ্ছুটি নেই। ব্যাপারটা কী?
এ দিন দুপুরে কলেজে ফোন করে জানা গেল, ১০ সেপ্টেম্বর ভর্তির বিজ্ঞপ্তি বেরোবে। ক্লাস শুরু ৩০ সেপ্টেম্বরের পরে। ফের ফোন করা হল এক প্রার্থীর অভিভাবক পরিচয় দিয়ে। ‘‘নিট মেরিট লিস্টে র্যাঙ্ক ১ লাখ ২২ হাজার। চান্স আছে?’’
ও পার থেকে চাপা গলায় ভরসা— ‘‘হয়ে যাবে। ফোন নম্বর দিন। এসএমএসে একটা মেল আইডি পাঠাচ্ছি। ক্যান্ডিডেটের সার্টিফিকেট তাতে পাঠিয়ে দিন। তখন বলব, কত লাগবে।’’ খরচের আন্দাজ পেতে চাইলে জবাব এল, ‘‘চিন্তা করবেন না। বিকেলের মধ্যে সব জানিয়ে দেব।’’
বস্তুত কিছুক্ষণের মধ্যে মোবাইলে ই-মেল আইডি চলেও এল। এ বার ফোন দুর্গাপুরের গৌরীদেবী হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে, যেখানে ৩১ অগস্ট এমবিবিএসে ভর্তি শেষ হয়ে গিয়েছে। তিন হাত ঘুরে ফোন পৌঁছল জনৈক ‘স্যার’-এর কাছে। ফোনে তিনি নিজের পরিচয় দিলেন ডি কে সিংহ হিসেবে। এবং ‘ক্যান্ডিডেট’ আছে শুনে হিন্দি টানের বাংলায় আফশোস করে তিনি বললেন, ‘‘এত দেরিতে? অ্যাডমিশন তো হয়ে গেছে!’’ বলা হল, ক্যান্ডিডেটের নিট র্যাঙ্ক বারো হাজার। কিছু উপায় কি হতে পারে না?
‘‘বত্রিশ লাখের মতো পড়বে। টাকার ব্যবস্থা করে কাল সকালে চলে আসুন।’’— আশ্বাস দিলেন ‘স্যার।’ এক লাখের বেশি র্যাঙ্ক থাকলেও কি আশা আছে? ‘স্যার’ বললেন, ‘‘তা-ও হয়ে যাবে। তবে খরচা অনেক বেশি।’’
খুল্লমখুল্লা এ সব চলছে! স্বাস্থ্য দফতরের কী ভূমিকা?
রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ক’দিন আগে জানিয়েছিলেন, সমস্ত মেডিক্যাল কলেজকে বলা হয়েছে নিট-নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তি নিতে। কিন্তু তা মানা হচ্ছে কিনা, যাচাই করা অসম্ভব। কারণ, লোকবল নেই। তাঁরা শুধু ভর্তি হওয়া পড়ুয়াদের নাম-নম্বর চেয়ে পাঠাবেন। সুশান্তবাবু এ দিনও বলেন, ‘‘এত খুঁটিয়ে নজরদারি সম্ভব নয়। কাউন্সেলিংয়ের সময়ে আমাদের অফিসার কেপিসি’তে থাকবেন।’’
বাকিগুলোয়?
অধিকর্তার জবাব, ‘‘সে ব্যাপারে এখনও কিছু ঠিক হয়নি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy