প্রতীকী ছবি।
টানা দু’বছর স্কুল বন্ধ থাকায় পড়াশোনা ভুলতে বসেছে রাজ্যের ছাত্র-ছাত্রীরা। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার মান সংক্রান্ত একটি বেসরকারি সংস্থার বার্ষিক রিপোর্টের দাবি, অবস্থা এতটাই ‘সঙ্গীন’ যে রাজ্যের সরকারি এবং বেসরকারি স্কুলে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়াদের কেউ কেউ ভুগোল-বিজ্ঞান-অঙ্কের পাশাপাশি ভুলতে বসেছে অ-আ-ক-খও। বানান করে শব্দ এবং শব্দ পাশাপাশি জুড়ে বাক্যও পড়তে পারা তো দূর, তাদের অনেকে না কি বর্ণও চিনতে পারছে না!
রাজ্যের প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়ারা এ ক্ষেত্রে কারা কোথায় দাঁড়িয়ে তার একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে বেসরকারি সংস্থাটি। তাতে কোভিড পরিস্থিতিতে গত দু’বছরে রাজ্যের শিক্ষার মান কতটা পড়েছে তার একটা স্পষ্ট ছবি তুলে ধরা হয়েছে। যা দেখে রাজ্য সরকারের গ্লোবাল অ্যাডভাইসরি বোর্ডের সদস্য নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানিয়েছেন, রাজ্যের পড়ুয়াদের শিক্ষার এই অবস্থা মোটেই ‘ভাল খবর নয়’।
ভাল খবর যে নয়, তা অবশ্য ওই বেসরকারি সংস্থার রিপোর্টে এক ঝলক চোখ বোলালেই আন্দাজ করা যায়। রিপোর্টটির নাম অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট (এএসইআর)। রাজ্যের শিক্ষার বার্ষিক মানের এই রিপোর্ট ২০১৮ সাল পর্যন্ত নিয়মিত ভাবে বের হলেও শেষ দুই বছরে অর্থাৎ ২০২০ এবং ২০২১ সালে বের হয়নি। কোভিড পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর এ বছর আবার সেই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। আর রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ২০১৮ সালের সঙ্গে ২০২১ সালের শিক্ষার মানের ফারাক অনেক। গত তিন বছরে রাজ্যের শিক্ষার মান আরও নিম্নমুখী হয়েছে। যদিও বেসরকারি সংস্থার ওই রিপোর্ট নিয়ে রাজ্য সরকারের তরফে কোনও মন্তব্য করা হয়নি
কী আছে ওই রিপোর্টে? রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ছাত্র ছাত্রীদের বুনিয়াদি শিক্ষা অর্থাৎ প্রাথমিক অক্ষরজ্ঞান, বানান করে শব্দ পড়া বা একটা গোটা বাক্য পড়ার মতো শিক্ষায় চোখে পড়ার মতো অবনতি হয়েছে। ২০১৮ সাল যেখানে প্রথম শ্রেণির স্তরের সরল বাক্য, যেমন ‘গরমে আম পাওয়া যায়’ বানান করে পড়তে পারত ৭৩.২ শতাংশ পড়ুয়া। ২০২১ সালে সেই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৬৬.৩ শতাংশে। যুক্তাক্ষরহীন কিছুটা বড় বাক্য, যা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ানো হয় তা পড়তে পেরেছে ৫৩ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী। যেখানে তিন বছর আগে এই ধরনের বাক্য পড়তে পারত ৬৬.২ শতাংশ পড়ুয়া।
কিছুটা একই অবস্থা অঙ্ক কষার ক্ষেত্রেও। প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণির পর্যন্ত এমন অনেকেই রয়েছে, যারা এক থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যাও চিনতে পারে না। ২০১৮ সালেও এমন ছাত্র ছাত্রী ছিল না তা নয়। সপ্তম শ্রেণিতে যেমন এক শতাংশ পড়ুয়া ১-৯ সংখ্যা চিনত না। তবে ২০২১ সালে এই অজ্ঞানতার হার বেড়ে আড়াই শতাংশ হয়েছে। একই ভাবে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৫.৩ শতাংশ, পঞ্চম শ্রেণিতে ৫.২ শতাংশ, চতুর্থ ৬.৭ শতাংশ, তৃতীয় শ্রেণিতে ৯.২ শতাংশ, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১২.৬ শতাংশ এবং প্রথম শ্রেণিতে ৩০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী ১ থেকে ৯ পর্যন্ত সংখ্যা চিনতে পারে না। এএসইআর রিপোর্ট বলছে ২০১৮ সালে ১-৯ পর্যন্ত সংখ্যা চিনতে পারত ৭৭.৮ শতাংশ পড়ুয়া। ২০২১ সালে ৬৮.৫ শতাংশের সেই ক্ষমতা রয়েছে। বিয়োগ, ভাগ করতে পারে না অষ্টম শ্রেণির ৩৬.৯ শতাংশ পড়ুয়া।
বেসরকারি সংস্থাটি জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ১৮টি জেলার মধ্যে ১৭টির পরিবারভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করে এই ফলাফল এসেছে। ভাষা পরীক্ষার জন্য তারা সাধারণ বর্ণ, শব্দ, সাধারণ প্রথম শ্রেণির স্তরের বাক্য এবং দ্বিতীয় শ্রেণির স্তরের বাক্য ব্যবহার করা হয়েছিল। গণনা পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল ১-৯ পর্যন্ত সংখ্যা, দুই অঙ্কের সংখ্যা, বিয়োগ এবং ভাগের অঙ্ক। ওই পরীক্ষার যে ফলাফল প্রকাশ্যে এসেছে, তার ভিত্তিতেই তৈরি করা হয়েছে রিপোর্ট।
রাজ্যের সার্বিক শিক্ষার মানের অবনতির কোনও ব্যখ্যা দেওয়া হয়নি রিপোর্টে। তবে বলা হয়েছে, সরকারি বেসরকারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ৬৫.৫ শতাংশ পড়ুয়ার বা়ড়িতে স্মার্টফোন রয়েছে। ১১.৩ শতাংশ পড়ুয়ার বাড়িতে রেডিয়ো রয়েছে। টেলিভিশন আছে ৫৬.৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর পরিবারে। পড়ার বই ছাড়া অন্যান্য পড়ার জিনিস রয়েছে কেবল ৩.১ শতাংশ বাড়িতে। কোভিড পরিস্থিতিতে অনলাইন ক্লাসেই চালানো হয়েছে পড়াশোনা। অনেক সময় টিভিতেও বিভিন্ন চ্যানেলে ক্লাস করিয়েছেন শিক্ষকেরা। সে ক্ষেত্রে যাঁদের বাড়িতে টিভি, বা স্মার্টফোন নেই তাদের অনেকেই সেই অনলাইন ক্লাসের সুবিধা পায়নি।
তবে এ ক্ষেত্রে একটি আশার কথা হল, পড়াশোনা না করতে পারলেও স্কুলছুট হয়নি বেশি ছাত্র-ছাত্রী। যদিও এ ব্যাপারেই বেশি উদ্বেগ ছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন স্কুল খোলা না থাকলে, স্কুল ছেড়েও দেবে অনেকেই। কিন্তু বাস্তবে দেখা গিয়েছে ৯০ শতাংশ ছাত্রছাত্রীরই নাম রয়েছে স্কুলের খাতায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy