প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে ঢাকা যাওয়ার তোড়জোড় করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারই মধ্যে সিবিআইয়ের চিঠি পৌঁছল নবান্নে। সারদা গোষ্ঠীর কাজকর্ম নিয়ে কেন্দ্রের পাঠানো অভিযোগের কী তদন্ত করেছে রাজ্যের প্রশাসন, গত ১৫ মে চিঠি দিয়ে সে কথাই ফের জানতে চেয়েছেন সিবিআইয়ের স্পেশ্যাল ক্রাইম ব্রাঞ্চের এসপি।
সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী ৬ জুন ঢাকায় ভারত-বাংলাদেশ স্থল-সীমান্ত চুক্তি সম্পাদনের সময় দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদীর পাশে মমতাও থাকবেন। তার আগে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ওই চিঠি পেয়ে নবান্নের কর্তারা বেশ অস্বস্তিতে।
সারদা প্রশ্নে রাজ্য প্রশাসনের সদরে সিবিআইয়ের কড়া নাড়া অবশ্য এই প্রথম নয়। ব্যুরোর স্পেশ্যাল ক্রাইম ব্রাঞ্চের ওই এসপি উপেন্দ্রকুমার অগ্রবালই গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর নবান্নে চিঠি পাঠিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ২০১১-’১২ সালে সারদা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ওঠা যে সমস্ত অভিযোগ কেন্দ্রের তরফে রাজ্যকে জানানো হয়েছিল, সেগুলো তারা পেয়েছে কি না। এবং পেলে কোনও তদন্ত হয়েছে কি না। হয়ে থাকলে তদন্ত রিপোর্ট-সহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সিবিআই দফতরে জমা দেওয়ার আর্জিও ছিল চিঠিতে।
তার পরে আট মাস কেটে গিয়েছে। সিবিআই-কে কোনও জবাব রাজ্য দেয়নি। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি রাকেশ গুপ্তকে যে চিঠি উপেন্দ্রকুমার দিয়েছেন, সেটি কার্যত আগের চিঠির প্রসঙ্গ টেনেই লেখা। আর তাতেও রয়েছে দ্রুত জবাব দেওয়ার আর্জি। প্রশাসনের খবর, দিল্লিতে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসা ইস্তক সিবিআই ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক বিষয়ক বিভাগ এ যাবৎ ছ’-ছ’টি চিঠি নবান্নে পাঠিয়েছে। তারাও জানতে চেয়েছে, লগ্নি সংস্থাগুলির অবৈধ আর্থিক লেনদেন রুখতে রাজ্য কী ব্যবস্থা নিয়েছে।
সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন ছবির উপরে।
সিবিআইয়ের চিঠির জবাব আট মাসেও নবান্ন দিল না কেন?
স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা বলেন, “আর্থিক বিশৃঙ্খলা যাচাইয়ের পরিকাঠামো আমাদের নেই। এতে অর্থ দফতর পারদর্শী। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও সেবি-র সঙ্গে তারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। তাই লগ্নি সংস্থার কাজকর্ম ওদেরই ভাল জানার কথা।”
সেই যুক্তিতেই স্বরাষ্ট্র দফতর সিবিআইয়ের চিঠি অর্থ দফতরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেখানে ফাইল পড়ে থাকে। শেষে স্বরাষ্ট্র দফতর নিজেই জবাব দিতে উদ্যোগী হয়। নবান্নের খবর: অর্থ দফতরের পরামর্শে জবাবি চিঠির একটা খসড়া তৈরি হয়েছিল মাস পাঁচেক আগে, যার বয়ান নিয়ে অর্থ দফতরই আপত্তি তুলে খসড়ায় একাধিক সংশোধনী জুড়তে চায়।
এ হেন টানাপড়েনেই সিবিআইয়ের চিঠির উত্তর এখনও দিয়ে ওঠা যায়নি বলে প্রশাসনের একাংশের দাবি। যদিও নবান্নের শীর্ষ কর্তারা এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে চাননি। অর্থসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীকে বারবার ফোন করে সাড়া মেলেনি, এসএমএসের উত্তর আসেনি। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রও ফোন ধরেননি, এসএমএসের জবাব দেননি। স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় দেশের বাইরে থাকায় তাঁর দফতরেরও কেউ মুখ খোলেননি।
তবে আগেরটির তুলনায় সিবিআইয়ের এ বারের চিঠিতে বেশি তাৎপর্য খুঁজে পাচ্ছেন রাজ্য প্রশাসনের অনেকে। তাঁদের বক্তব্য, আট মাস আগে কেন্দ্র-রাজ্য রাজনৈতিক সম্পর্কের ছবিটা অন্য রকম ছিল। তার আগে লোকসভা ভোটের প্রচারে মোদীকে ‘দাঙ্গাগুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন তৃণমূলনেত্রী, এমনকী তাঁর কোমরে দড়ি পরানোর কথাও বলেছিলেন। ‘‘গত সেপ্টেম্বরে সিবিআই যখন নবান্নে চিঠি দেয়, তখন কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাবই বজায় ছিল। তখনও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেননি মুখ্যমন্ত্রী। সিবিআইয়ের সারদা-তদন্তও ছিল তুঙ্গে।’’— বলছেন এক অফিসার।
তাই তখনকার চিঠির মধ্যে বিশেষ অস্বাভাবিক কিছু দেখছেন না নবান্নের আধিকারিকেরা। কিন্তু এখন পরিস্থিতি খানিকটা বদলে গিয়েছে বলেই তাঁদের দাবি। বিরোধীদেরও পর্যবেক্ষণ: মোদী-মমতা সম্পর্কের বরফ ইদানীং গলছে, যার জেরে সারদা নিয়ে সিবিআই-ও যেন কিছুটা নিষ্ক্রিয়। ক’দিন আগে ইস্কো সম্প্রসারণ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী এ রাজ্যে এলে মমতা তাঁর সঙ্গে একান্তে কথা বলেন। রাজভবনের সেই বৈঠকেই মমতাকে ঢাকায় যাওয়ার অনুরোধ করেন প্রধানমন্ত্রী। শেষমেশ মমতা রাজি হয়ে যান। মোদীর সেই সফরের আগাগোড়া পারস্পরিক সৌজন্য বজায় ছিল। ইস্কোর অনুষ্ঠানে ইউপিএ জমানার দুর্নীতি নিয়ে সরব হলেও সারদা প্রসঙ্গ নিয়ে একটি শব্দও বলেননি প্রধানমন্ত্রী।
এমতাবস্থায় সারদা প্রসঙ্গে সিবিআই নতুন করে নবান্নে চিঠি দেওয়ায় প্রশাসনের অন্দরে জল্পনা দানা বেঁধেছে। আধিকারিকদের অনেকের মতে, চলতি সৌহার্দ্যের বাতাবরণের সঙ্গে এটা খাপ খাচ্ছে না। বিজেপি সূত্র অবশ্য এতে আশ্চর্যের কিছু দেখছে না। তাদের বক্তব্য, সরকার পরিচালনার থেকে রাজনীতিকে দূরে রাখার কথা গোড়া থেকেই বলে আসছেন মোদী। তিনি রাজ্যে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। এবং সেখানে খুব স্বাভাবিক ভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন। এর সঙ্গে সারদা তদন্তের কোনও সম্পর্ক নেই। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহও যে কেন্দ্র-রাজ্য যুক্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের সঙ্গে দলের তৃণমূল-বিরোধী আন্দোলনের যোগসূত্র না-থাকার কথা বলেছেন, সেটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা।
মমতাও কেন্দ্রের শাসকদলের সঙ্গে কখনও সহযোগিতা, কখনও বিরোধিতার নরম-গরম রাজনীতি বজায় রেখেছেন। বিমা বিল বা বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি নিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু সিবিআইয়ের নতুন চিঠি পেয়ে জমি বিল নিয়ে নতুন করে বিরোধী সুর চড়িয়েছেন। কী ভাবে? তৃণমূলের এক নেতার ব্যাখ্যা, ‘‘সোমবার বিধানসভার কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে এসইউসি বিধায়ক কেন্দ্রের জমি অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে আলোচনার প্রস্তাব দিলে মুখ্যমন্ত্রী এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছেন।’’ ঘটনাটিকে জমি-বিলের বিরুদ্ধে সচেতন ভাবে বিরোধিতা জিইয়ে রাখার প্রয়াস হিসেবেই দেখছেন অনেকে। তাঁদের মত, এতে দিল্লির উপরে চাপও রইল, তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্ক যে কৃষক শ্রেণি, তাঁদের কাছে ভাবমূর্তি অটুট থাকল।
কিন্তু একই সঙ্গে জমি বিল নিয়ে সংসদীয় কমিটি বয়কট করছে না তৃণমূল। দলের মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনও এ দিন জানান, ‘আমরা জমি বিলের ২০০ শতাংশ বিরোধিতা করব। কিন্তু সংসদীয় কমিটি বয়কট কোনও সমাধান নয়। আমরা প্রতি পদে বিলের বিরোধিতা করব।’ ‘‘এই মিঠেকড়া অবস্থানই আপাতত তৃণমূল-বিজেপি সম্পর্কের নির্যাস,’’ মন্তব্য এক রাজনীতিকের।
সিবিআই-সূত্রের খবর, রাজ্যের লগ্নি সংস্থাগুলির কাজকর্ম সম্পর্কে গত তিন বছরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক রাজ্যকে একাধিক সতর্ক-বার্তা পাঠায়। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও সেবি-ও নানা সময়ে রাজ্যকে চিঠি দিয়েছিল। সে সবের ভিত্তিতে রাজ্য প্রশাসন কী পদক্ষেপ করেছিল, ব্যুরো এখন তা খতিয়ে দেখতে চাইছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy