পশ্চিমপাড়ার স্কুল ভবন।—নিজস্ব চিত্র।
স্কুল একটাই। কিন্তু চলে দু’ভাগে, দু’পাড়ায়।
সারাদিনই কখনও শিক্ষকেরা এ পাড়া থেকে ও পাড়া যান পড়াতে, কখনও ছাত্রেরা মিড-ডে মিল খেতে আসে ও পাড়া থেকে এ পাড়ায়। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা রোদ-জল মাথায় করে এ ভাবেই লেখাপড়া চলে কালনা ২ ব্লকের বাদলা গ্রামে।
তবে এ কথা আজকের নয়, গত ৭৫ বছর ধরে এ ভাবেই চলছে বাদলা প্রাথমিক বিদ্যালয়। গ্রামের পশ্চিমপাড়া ও দক্ষিণপাড়া কেউই নিজেদের স্কুলের ভাগ ছাড়তে রাজি না হওয়ায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবেই পড়াশোনা চালাচ্ছে। সমস্যা সমাধানে বছর খানেক আগে সর্বশিক্ষা অভিযানের টাকায় দক্ষিণপাড়ার কালীতলায় একটি দ্বিতল ভবন গড়ে ওঠে। কিন্তু দু’পাড়ার কেউই স্কুল অন্যত্র বসাতে রাজি না হওয়ায় বন্ধই রয়েছে সেই ভবন। গ্রামবাসীদের দাবি, গ্রামের মাঝামাঝি স্কুলের নতুন ভবন গড়া হোক।
কিন্তু এ কিসের লড়াই, যেখানে কেউ কাউকে জমি ছাড়তে রাজি নয়? বাদলার প্রবীণেরা জানান, একসময়ে দু’পাড়াতেই বহু সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাস ছিল। দক্ষিণপাড়ার হালদারদের সঙ্গে পশ্চিমপাড়ার পোদ্দার ও দত্তদের রেষারেষির তল্লাটে সবাই জানত। ১৯৩০ সালে দু’পাড়ার লোকেরাই গ্রামে পাঠশালা খোলার উদ্যোগ করেন। পশ্চিমপাড়ার গজলক্ষ্ণী মন্দিরের পাশে দত্ত পরিবারের দেওয়া ঘরে পাঠাশালা শুরু হয়। কোমর বাঁধে দক্ষিণপাড়াও। ওই পাড়ার কালীতলায় মাথা তোলে আরও একটি পাঠাশালা। পরে ১৯৪০ সাল নাগাদ সরকারি ভাবে গ্রামে প্রাথমিক স্কুল তৈরির অনুমোদন দিতে আসেন শিক্ষা দফতরের আধিকারিকেরা। দু’পাড়ায় দাবি করে, তাদের স্কুলকেই অনুমোদন দেওয়া হোক। শেষমেশ ঠিক হয়, গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ই হবে। তবে চারটি ক্লাসের দুটি এক পাড়ায়, দুটি অন্য পাড়ায় হবে। সেই মতো সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ক্লাসও শুরু হয়ে যায়। বছর তিনেক আগে প্রাক প্রাথমিক নামে আরও একটি ক্লাস বাড়ে। কিন্তু স্কুল সরাতে রাজি হননি বাসিন্দারা।
এখন বাদলা গ্রামে গেলে দেখা যায়, দক্ষিণপাড়ার কালীতলায় প্রাক প্রাথমিক, প্রথম শ্রেণি এবং চতুর্থ শ্রেণির ক্লাস চলছে। সীমারেখা বিহীন দুটি একতলা ভবনে মন দিয়ে লেখাপড়া করছে ছাত্রছাত্রীরা। কয়েক পা এগিয়েই রয়েছে আরও একটি ঝাঁ চকচকে দ্বিতল ভবন। কিন্তু সেখানে ছাত্রছাত্রী নেই, ঘরবন্দি হয়ে পড়ে রয়েছে কিছু পুরনো বইপত্র। স্কুলের তিন শিক্ষকের মধ্যে প্রধান শিক্ষক সমীরণ চক্রবর্তী এবং শিক্ষিকা অলকা ঘোষ মল্লিক এখানেই ক্লাস নেন। মিড-ডে মিলও হয় এখানেই। এখান থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে রয়েছে পশ্চিমপাড়ার গজলক্ষী তলার স্কুল। সেখানে একটি ঘরকে ভাগ করে চলে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণির ক্লাস চলে। ক্লাস নেন দেবজিৎ সরকার নামে এক শিক্ষক।
কিন্তু এ ভাবে স্কুল চলায় সবচেয়ে মুশকিলে পড়ে খুদে পড়ুয়ারা। রোদ-বৃষ্টিতে পায়ে হেঁটেই পশ্চিমপাড়া থেকে থালা হাতে মিড-ডে মিল খেতে যেতে হয় তাদের। আসাযাওয়ায় নষ্ট হয় বেশ খানিকটা সময়ও। পশ্চিমপাড়ার ভবনের দায়িত্বে থাকা দেবজিৎবাবু বলেন, ‘‘শুধু ছাত্রছাত্রীরা নয়, খাতায় স্বাক্ষর, প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে নানা বিষয়ে পরামর্শ নিতে আমাকেও মাঝেমধ্যেই কালীতলা যেতে হয়। ছাত্রছাত্রীরা থালা হাতে যে রাস্তা দিয়ে যায় সে রাস্তায় সারাদিন যানচলাচল করে। বিপদের ঝুঁকি থেকেই যায়।’’ শিক্ষকদের দাবী, প্রশিক্ষণ, প্রশাসনিক বৈঠক-সহ নানা কাজে মাসের বিভিন্ন দিন কোনও না কোনও শিক্ষককে বাইরে থাকতে হয়। তখন এক জন বা দু’জন মিলে দু’জায়গার ভবন পরিচালনা করা সম্ভব হয়না। প্রধান শিক্ষক সমীরণবাবু বলেন, ‘‘২০০৯ সালে আমি প্রধান শিক্ষক হয়ে আসি। তারপর গোটা স্কুলকে এক ছাতার তলায় আনার চেষ্টাও করি। কালীতলা স্কুলভবনের পাশে দু’জন স্কুলকে কাঠাখানেক জমিও দান করেন। সেখানে নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ২০১০ এবং ২০১১ সালে সর্বশিক্ষা মিশন দু’দফায় ২ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা করে দেয়। কিন্তু নতুন ভবন তৈরি হওয়ার পরেও গ্রামবাসীরা রাজি না হওয়াই সেখানে ক্লাস চালু করা যায় নি।’’ তাঁর দাবী, দুটি পৃথক স্কুল অথবা দুটি পাড়ার মাঝামাঝি ভবন না তৈরি হলে সমাধান হবে না। কারণ গ্রামবাসীদের বারবার বোঝানোর পরেও তাঁরা অনড়। এই লড়াইয়ের জেরে স্কুলের সরস্বতী পুজো এক বার হয় পশ্চিমপাড়ায়, আর এক বার দক্ষিণপাড়ায়।
কিন্তু অন্য কাজকর্মে দু’পাড়ার যাতায়াত তো রয়েছে। তাহলে স্কুল নিয়ে এমন অনড় অবস্থান কেন? প্রশ্ন করাতেই উত্তেজিত গলায় মাঝবয়সী তারাপ্রসন্ন দে বলেন, ‘‘স্কুলের জন্য দুটি পাড়া অনেক লড়াই করেছে। যেমন চলছে তেমন থাকতে দিন।’’ তাঁর দাবি, ‘‘প্রশাসনের লোকজনেরা তো ঠিক করে দিয়েছেন কেমন ভাবে স্কুল চলবে। তবে সংখ্যায় কম হলেও গ্রামের কিছু মানুষ ঘরের ছেলেমেয়েদের সুবিধা চান। ওই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক তথা বাদলা গ্রামের বাসিন্দা অনিল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বৈঠক করে সবার ভাল হয় এমন সিদ্ধান্ত পৌঁছনো খুবই জরুরি। এ গ্রামে এ কাজ কিছুটা শক্ত হলেও অসম্ভব নয়।’’ ধনঞ্জয় বারুই নামে পশ্চিম পাড়ার এক বাসিন্দাও বলেন, ‘‘দুই পাড়ার লোকজন মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে গ্রামের মাঝামাঝি স্কুল হোক। তাতে সব দিক রক্ষা হবে।’’ সমস্যার কথা মেনে নিয়েছেন কালনা দক্ষিণ চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক প্রিয়ব্রত মুখোপাধ্যায়ও। তাঁর দাবি, ‘‘সমস্যা বেশি মিড-ডে মিল নিয়ে। সমাধানের চেষ্টা চলছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy