এ ভাবেই গাদাগাদি করে একটি বাড়িতে বাস করছে পাঁচটি পরিবার। নিজস্ব চিত্র ।
কুনুর নদীর জল বাড়লেই ঘুম উড়ে যায় আমাদের। তবে এ বার শুধু নিজেরা নই, আশপাশের আরও পাঁচ ঘর মিলে চার দিন ধরে জলবন্দি হয়ে রয়েছি।
স্বামী-স্ত্রী আর ছয় মেয়ে নিয়ে সংসার। গুসকরার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের শিবতলা মাঠপাড়ার এই বাড়িতে আছি ১৯ বছর ধরে। বাড়ি বলতে, দু’টো ছোট মাটির ঘর। পাশে ছোট চালাঘরে রান্নাবান্না হয়। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। অভাবের জ্বালায় মেজ মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছি ওর মাসির বাড়িতে। মুটে-মজুরের কাজ করে বাকি ছ’জনের পেট টানি। বরাবরই কুনুরের জল বাড়লে এলাকা ডুবে যায়। এ বছর জল ছাড়া হচ্ছে শুনেই ভয়ে পাচ্ছিলাম। তার উপরে কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ঘুম কেড়ে নিয়েছিল।
শনিবার, প্রথম দিন: সকাল থেকেই এলাকায় জল ঢুকতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাঁটু জল পৌঁছে গেল কোমরের সমানে। আমার বাড়ি থেকে নীচের দিকের কয়েকটা বাড়িতে জল ঢুকে গিয়েছে বলে শুনলাম। আমাদের বাড়ির দাওয়া সামান্য উঁচু হওয়ায়, তখনও ডোবেনি। তবে বাড়ির চারধারে জল জমে যায়। অরুণ ভগত নামে আমার এক পড়শি এসে জানান, তাঁর বাড়িতে জল ঢুকে গিয়েছে। ওঁরা জিনিসপত্র, ছেলেমেয়ে নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন। সব কিছু বার করারও সময় পাননি। সঙ্গে সঙ্গেই আমার বাড়িতে চলে আসতে বলি তাঁকে। তারপরে একে একে পুতুল সাহানি, রুনু ঝাঁ, দীনেশ ভগতেরাও চলে আসেন। দু’কামরার ঘরে খুব অসুবিধা হবে বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু এমন বিপদে প্রতিবেশীদের পাশে না দাঁড়ালে চলে! সকাল ৯টার মধ্যেই ওঁরা এসে পড়েন। আমার বাড়িতে তখন ২২ জন লোক। একটা চার মাসের শিশু-সহ ১২ জন ছোট ছেলেমেয়েও ছিল। ঘরে যা ছিল, তাই দিয়েই সকলের পেট ভরানোর চেষ্টা করি। সারা দিন মুড়ি খেয়ে কাটে। বাচ্চাদেরও আলাদা কিছু দিতে পারিনি। রাতে গাদাগাদি করে শুয়ে পড়ি। পাশের ছোট চালাঘরে দু’টো পরিবার ছিল। রাত থেকে জল ঢুকতে শুরু করে ওখানে।
রবিবার, দ্বিতীয় দিন: আলো ফুটতেই চালাঘর থেকে বেরিয়ে আসতে বলি ওদের। কিছুক্ষণের মধ্যে চালা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পরে। কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায় বাড়িতে। অনেক কষ্ট করে টাকাপয়সা জমিয়ে চালাটি বানিয়েছিলাম। আবার কবে পারব, জানি না। সবাই খুব চিন্তায় পড়ে যায়। দুপুরে আবার মুড়ি, চা খেতে দিই সবাইকে। রান্না করার জায়গাও ছিল না। এত জনের খাবার ছিল না বাড়িতে। কেউ কেউ বাচ্চাদের মিড-ডে মিলে পাওয়া চাল এনেছিলেন। ভেবেছিলাম, পুরসভা থেকে কিছু ত্রাণ পাঠাবে। কিন্তু সারাদিনেও কাউকে দেখলাম না। তিন বেলা ভাত না খাওয়া ছেলেমেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে রাতে ভাত ফোটানো হয়। শোয়ার ঘরেই উনুন তৈরি করে রান্না করা হয়। বারবার দেওয়াল দেখছিলাম। বাইরেটা দেখছিলাম। আবার যদি ঘর ভাঙে!
সোমবার, তৃতীয় দিন: সকালে দেখলাম, জল কিছুটা কম। জল পেরিয়ে বাইরে গিয়ে বকেয়া মজুরি নিয়ে সকলের জন্য চাল, আলু নিয়ে আসি। দুপুরে ভাত জোটে সবার। খবরের কাগজে আমাদের দশার কথা বেরনোয় বিকেলের দিকে এক দল লোক পরিস্থিতি দেখতে আসেন। এলাকার তৃণমূল কর্মীরাও ছিলেন ওই দলে। আশায় ছিলাম, হয়তো কিছু ত্রাণ পাব। কিন্তু কিছুই পেলাম না। রাতে চার মাসের শিশুর মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওই অবস্থায় তাঁকে নিয়ে গুসকরা হাসপাতালে ছুটি আমরা। তবে বাড়াবাড়ি কিছু হয়নি। অনেক রাতে বাড়ি ফিরি।
মঙ্গলবার, চতুর্থ দিন: সবাই মিলে ঠিক করি, আজ রান্না করতে হবে। একটা বড় কাঠের উনুন বানানো হয়। ছোট গ্যাস ছিল একটা। তাতেই রান্না করা হয়। বিকেলে রেড ভলান্টিয়ার্সদের তরফে ২৫ কেজি চাল, এক বস্তা আলু, পেঁয়াজ, বাচ্চাদের দুধ, বিস্কুট দিয়ে যান কয়েকজন। রাতে একটা বাচ্চার কানে পোকা ঢুকে যায়। তাকে নিয়ে ফের হাসপাতালে ছুটতে হয়। যাঁরা আমার ঘরে রয়েছেন, তাঁদের বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ। দু’টো পরিবার অনুরোধ করেছে, আরও কিছু দিন যদি এখানে থাকতে পারে। কী আর করি! বিপদের মুখে কাউকে ঠেলতে পারব না।
বুধবার, পঞ্চম দিন: জল কমেছে, তবে পুরোপুরি নামেনি। সকালে অনেকেই নিজেদের বাড়িঘরের হাল দেখতে যান। অনেক কিছু ভেঙে গিয়েছে, জিনিস নষ্ট হয়েছে। আমিও কাজে গিয়েছিলাম। কত দিন আর এ ভাবে ঘরে বসে থাকব! আমার বাড়িতেই সবার জন্য রান্না করা হয়েছে। তবে বাড়িঘর, জমির যা অবস্থা, কবে সব আগের মতো হবে বুঝতে পারছি না। জল নামার অপেক্ষা এখন।
অনুলিখন: প্রদীপ মুখোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy