ঘনঘন ভূমিকম্পে ফের ফাটল কোচবিহার রাজবাড়িতে। —নিজস্ব চিত্র।
ভারতীয় এবং ইউরেশিয়া প্লেটের অস্থিরতা ফের কাঁপিয়ে দিল অসম সহ উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকাকে। রবিবার সকাল ৫টা বেজে ৩৫ মিনিট নাগাদ উত্তরবঙ্গ জুড়েই ভূকম্পন অনুভূত হয়। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, কম্পনের উৎসস্থল ছিল অসমের কোকরাঝাড় জেলা। উত্তরবঙ্গের সাত জেলা সহ ভুটান এবং নেপালের কিছু অংশেও কম্পন অনুভূত হয়েছে। রিখটার স্কেলে কম্পনের মাত্রা ছিল ৫.৬। বিশেষজ্ঞরা এই মাত্রার কম্পনকে ‘মডারেট’ তথা সাধারণ বলে চিহ্নিত করলেও, উৎসস্থল চিন্তায় রেখেছে তাঁদের। নেপালের পর অসম। উত্তরবঙ্গের খুব কাছাকাছি এলাকা থেকে বারবার কম্পন উৎসারিত হওয়াকে বিশেষজ্ঞদের একাংশ বড় কোনও কম্পনের আভাস বলে দাবি করেছেন। যদিও, বিশেষজ্ঞদের অন্য অংশের দাবি, ঘনঘন কম্পনে ভূগর্ভস্থ অস্থির প্লেটগুলি ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হচ্ছে। এর ফলে বড় কম্পনের আশঙ্কা কমছে বলে তাঁদের দাবি। এ দিনের কম্পনে বড় ধরনের কোনও ক্ষয়ক্ষতির খবর প্রশাসন সূত্রে মেলেনি।
রবিবার ভোর থেকেই বৃষ্টি চলছিল শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়িতে। সকালের দিকে বৃষ্টির মধ্যেই কাক, পাখিদের অস্থির ভাবে ওড়াওড়ি করতে দেখা যায় বলে অনেকেই দাবি করেছেন। সাড়ে ৬টার পরে কম্পন অনুভূত হতেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে উত্তরবঙ্গ জুড়ে। গত ২৫ এপ্রিল দুপুরে নেপালে রিখটার স্কেলে ৭.৮ মাত্রার কম্পন হয়। তারপরে প্রায় মাশ খানেক ধরে চলেছিল আফটার শক। সেই আতঙ্ক এ দিনও গ্রাস করে মানুষকে। শিলিগুড়িতে পড়ে গিয়ে কোমরে গুরুতর চোট পেয়েছেন শিলিগুড়ির উত্তর ভারত নগরের বাসিন্দা গীতা দাস। ৪৬ বছরের ওই মহিলাকে তিলকরোডের একটি নার্সিংহোমে ভোরেই ভর্তি করানো হয়। দার্জিলিঙেও কম্পন টের পাওয়া গিয়েছে। তবে পাহাড় থেকে বিশেষ কোনও ক্ষতি হয়নি বলেই প্রশাসনের দাবি। ক্ষয়ক্ষতি না হলেও পাহাড় থেকে সমতলে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। গত ২৫ এপ্রিল নেপালের ভূমিকম্পের পর থেকে মাসজুড়ে একাধিকবার উত্তরবঙ্গ কেঁপে উঠেছে। সে সময়ে রাতের বেলায় বহুতলে না ফিরে বাসিন্দাদের রাস্তায়, পার্কে বসে রাত কাটিয়ে দিতেও দেখা গিয়েছে। সেই আতঙ্কের ছবিই এ দিন সকাল থেকে বিভিন্ন জেলায় দেখা গিয়েছে। মালদহের সুকান্তমোড়, গয়েশপুর, বিদ্যাসাগর পল্লি এবং মালঞ্চ পল্লি এলাকার বাসিন্দারা বৃষ্টি মাথাতেই বাইরে চলে আসেন। যাঁরা ঘুমিয়ে ছিলেন তাঁদের অনেকেই নিজেরা কম্পন টের না পেলেও, অন্যদের মুখে শুনে আতঙ্কে বেড়িয়ে আসেন। জেলার অতিরিক্ত জেলা শাসক সঞ্জীব চাকি বলেন, ‘‘ক্ষয়ভতির খবর তো পাওয়া যায়নি, তবে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।’’
ভূমিকম্পের জের। ভোরে ঘর থেকে বেরিয়ে মাঠে নেমে এলেন শিলিগুড়ির মানুষ। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
প্রাতঃভ্রমণকারী বাসিন্দাদের ভূমিকম্পের সময়ে আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে দেখা গিয়েছে বালুরঘাটে। আতঙ্কের ছবি দেখা গিয়েছে কোচবিহারেও। বেশ কিছু এলাকায় বাসিন্দাদের চিৎকার করে কান্নাকাটি জুড়ে দিতে দেখা গিয়েছে। বহুতলগুলি থেকেও মানুষ দৌড়ে রাস্তায় নেমে যান। ২০১২ সালের ভূমিকম্পে কোচবিহার রাজবাড়ির বেশ কয়েক জায়গায় ফাটল তৈরি হয়েছিল। ওই ফাটল সংস্কারের কোনও উদ্যোগ পুরাতত্ব সর্বেক্ষণের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। যেভাবে বার বার ভূমিকম্পের উৎপত্তি হচ্ছে তাতে ওই ফাটল বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বাসিন্দারা। কোচবিহার হেরিটেজ সোসাইটির সম্পাদক অরূপজ্যোতি মজুমদার বলেন, “পাঁচ নম্বর জোনে রয়েছে কোচবিহার। সেক্ষেত্রে রাজবাড়ি সহ শহরকে বাঁচাতে প্রশাসনকে আরও সক্রিয় হতে হবে।”
জলপাইগুড়ি শহরের ডিবিসি রোড, কদমতলা, শান্তিপাড়া, শিলিগুড়ির কলেজপাড়া, হাকিমপাড়া, বাবুপাড়ার মতো এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেই বৃষ্টির মধ্যেই বহুতল আবাসন থেকে রাস্তায় নেমে এসেছেন।
ভূমিকম্পে অসমের কোকরাঝাড় স্টেশনের কাছে ডেইলি বাজারের একটি দেওয়াল ভেঙে গুরুতর জখম হন দুই কলা ব্যবসায়ী। তাঁদের কোকরাঝাড় সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, দু’জনেই দেওয়ালের পাশে বসেছিলেন। কম্পনের জেরে প্রায় ২০ ফুট লম্বা দেওয়ালটি ভেঙে পরে। দেওয়ালে চাপা পরে গুরুতর জখম হন ওই দুজন। এছাড়াও কোকরাঝাড় শহর এবং গোসাইগাঁও মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় একাধিক বহুতলের বাড়ির দেওয়ালে ফাঁটল দেখা গিয়েছে। জেলাশাসক মাধব প্রসাদ শর্মা জানান, “ভূমিকম্পে দুই ব্যবসায়ী জখম হয়েছেন। বেশ কিছু বাড়িতে ফাটল দেখা গিয়েছে। আরও কোথায় কী ক্ষতি হয়েছে তা প্রশাসনের তরফে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।” আতঙ্ক ছড়ায় বঙ্গাইগাঁও, ধুবুরিতেও।
মালদহে কম্পন অনূভূত হয়নি, উত্তর দিনাজপুরে কম্পন সামান্য অনুভূত হয়েছে। তবে জলপাইগুড়ি-কোচবিহারে এ দিনের কম্পনের আফটার শক নিয়েও দেদার গুজব ছড়িয়েছে। যদিও, বিশেষজ্ঞদের দাবি, এ দিনের কম্পনের মাত্রা বেশি না থাকায় আফটার শকের আশঙ্কা নেই।
তবে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা কী নিয়ে?
পড়ে আহত গীতা দাস। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
আশঙ্কায় রেখেছে কম্পনের উৎসস্থল উত্তরবঙ্গের দোরগোড়ায় চলে আসায়। ভারতীয় প্লেট এবং ইউরেশিয়া প্লেটের সংঘর্ষেই গত ২৫ এপ্রিল নেপালের ভূমিকম্প হয়। তারপর থেকে সেই দুই প্লেটের অস্থিরতা বারবার কাঁপিয়ে তুলেছে উত্তরবঙ্গকে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ভারতীয়, ইউরেশিয় এবং অস্ট্রেলিয়ান প্লেটের সংযোগ স্থলের উপরে উত্তর পূর্ব ভারতের অবস্থান। কাশ্মীর থেকে শুরু করে হিমালয়ের পাদদেশ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অসম পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা ভারতীয়-ইউরেশিয়া প্লেটের উপর অবস্থিত। এই দু’টি প্লেটের মাঝে অসংখ্য চ্যুতি রয়েছে, তাতে প্রচুর শক্তি সঞ্চিত হওয়ায় দু’টি প্লেটই অস্থির হয়ে পড়েছে। তার ফলশ্রুতিতেই এই এলাকা বারবার কেঁপে উঠছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। উত্তরবঙ্গের খুব কাছাকাছি কম্পনস্থলে চলে আসাতেও উদ্বেগে এখানকার বিশেষজ্ঞরা। গত এপ্রিলের কম্পনের উৎসস্থল নেপাল থেকে শিলিগুড়ির দূরত্ব অন্তত সাড়ে চারশো কিলোমিটার। যদিও, রবিবারের কম্পনস্থল একেবারে ঘরের পাশে। শিলিগুড়ি থেকে ২৪২ কিলোমিটারের মধ্যে ছিল কম্পনের উৎসস্থল। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালের ভূগোল বিভাগের প্রধান সুবীর সরকার বলেন, ‘‘এটা ঠিকই বারেবারেই উত্তরবঙ্গের কাছাকাছি এলাকতেই বড় কম্পন জন্ম নিয়েছে। গত একশো বছরের বেশি সময় ধরে এমনই চলেছে। তবে এখন অস্থিরতা বেড়েছে। এই এলাকায় বড় কম্পনের আসঙ্কা যথেষ্ট রয়েছে।’’
বড় কম্পন নিয়ে অবশ্য বিশেষজ্ঞরা দু’ভাগে বিভক্ত। সুবীরবাবুর কথায়, ‘‘একদল বিশেষজ্ঞরা এ দিনের কম্পনের পরে মনে করছেন, বড় ধরণের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস। দু’টি প্লেটের চ্যুতি বরাবর যে অস্থিরতা চলছে তার ইঙ্গিত। আবার অন্যদলের মতে এমন ছোট-মাঝারি অনেক কম্পনের ফলে শক্তি বেরিয়ে গিয়ে ভূগর্ভস্থ প্লেটগুলি স্বাভাবিক হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy