এমনটাই বোধহয় ঘটার ছিল!
একের পর এক পার্টি অফিস ভেঙে তছনছ। আগুনে পুড়ছে দলের কর্মী, নির্বাচনী এজেন্টের বাড়ি। কালীপটকার সঙ্গে লাল পতাকা বেঁধে জ্বালিয়ে দিচ্ছে বিজয়গর্বে উন্মত্ত শাসক দলের বাহিনী! এ তো বাইরের ছবি। কিন্তু ভোটে বিপর্যয়ের পরে অন্তর্কলহেই এখন বেশি পুড়ছে বামেদের অন্দরমহল! যার জেরে বাম নেতাদের অনেকেরই আস্তিন থেকে বেরিয়ে আসছে গত আড়াই মাস ধরে লুকিয়ে রাখা ছোরা-ছুরি-তলোয়ার! শাসকের বাহিনীর মতোই দলের বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেওয়ার পালা ছেড়ে দিতে রাজি নয় কেউ! হোক না যতই কঠিন সময়।
ঘটনা যে, দলের মধ্যে যাবতীয় আপত্তি-সংশয় পেরিয়ে এবং নিজের রাজনৈতিক জীবন প্রায় বাজি রেখে কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়ার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন সূর্যকান্ত মিশ্র। তাঁর পাশে ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, গৌতম দেব, মহম্মদ সেলিমের মতো নেতারা। আর সর্বভারতীয় স্তরে দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু তখন দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। ভোট-পর্ব তিনি ওই দ্বিধার মধ্যেই কাটিয়েছেন। আর এখন কেন্দ্রীয় কমিটির দুই সদস্য এবং নিজে ভোটে দাঁড়িয়ে পরাজিত রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য দলের মধ্যে ঝড় তুলতে চাইছেন জোট-সিদ্ধান্তের জন্য। তাঁদের নিশানায় যে রাজ্য সম্পাদক, আলিমুদ্দিনে কারও বুঝতে বাকি নেই! আর এই লড়াইয়ের মাঝে আক্রান্ত কর্মী-সমর্থকদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তেমন কেউ নেই!
সূর্যবাবু পরিস্থিতি মোকাবিলা করে যাচ্ছেন শক্ত মুখেই। বেলেঘাটায় কলকাতা জেলা কমিটির এক সদস্যের বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার খবর পেয়ে শুক্রবার রাতেও কলকাতার পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছেন। ঘটনাস্থলে থাকা কলকাতা জেলার দুই নেতা মানব মুখোপাধ্যায় ও অনাদি সাহুর কাছ থেকে খোঁজ নিয়েছেন অনবরত। তিনি জানেন, জোট গড়ার সিদ্ধান্তে ভুল ছিল না। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি বুঝছেন, ভোটের ফল বিপক্ষে যাওয়ায় দল এবং কর্মীদের গভীর খাদের মুখে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার দায় তাঁর উপরেও এসে পড়বে। জোট সফল হলে কৃতিত্বের ভাগীদার হওয়ার লোক থাকত অনেক। কিন্তু বিপর্যয়ের দায় ভাগ করতে কেউ এগিয়ে আসবে না! দলের অন্দরে সূর্যবাবু অবশ্য বারবার বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছেন, দোষারোপ না করে এখন আত্মসমীক্ষার সময়। তারও আগে দরকার আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানো।
ঘটনাপ্রবাহে আশঙ্কার সিঁদূরে মেঘ দেখছে দলের একাংশ। পাঁচ বছর আগে ভোটে বিপর্যয়ের দিনই পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে সরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন বুদ্ধবাবু। এখন তেমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে দলটার হাল কে ধরবে, তা ভেবেই আতঙ্ক আলিমুদ্দিনে। এমনিতেই সিপিএমে নতুন মুখের আকাল। তার মধ্যে দোষারোপের পালা বিপর্যয়ের ধাক্কাকে বহু গুণ করে দিচ্ছে বুঝেই পাল্টা লড়াই চালাচ্ছে দলের একাংশ।
বস্তুত, সিপিএমের বিক্ষুব্ধ অংশের সঙ্গেই যোগ হয়েছে বাম শরিকদের ক্ষোভ। এমনিতেই কংগ্রেসের জন্য আসন ছাড়তে গিয়ে শরিকদের এ বার আত্নত্যাগ করতে হয়েছে। কংগ্রেসের সঙ্গে দোস্তি করতে গিয়ে ভরাডুবি হওয়ার পরে তাঁরা আর ছেড়ে কথা বলতে রাজি নন। বিক্ষুব্ধদের যুক্তি, ২০১১ সালের হার ছিল বামপন্থীদের পরাজয়। কিন্তু তাঁদের মনে হচ্ছে, এ বার হয়েছে বামপন্থার পরাজয়। কারণ, আদর্শের সঙ্গে আপস করে চিরশত্রু কংগ্রেসের হাত ধরে বিপর্যয় হয়েছে। রাজ্য সম্পাদকই যে হেতু বাড়তি পথ এগিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে সেতুবন্ধনে প্রয়াসী হয়েছিলেন, এখন তাঁকে ছাড় দিতে নারাজ বিক্ষুব্ধেরা।
দলের মধ্যেই অন্য অংশ এখনও প্রাণপণে জোট-সিদ্ধান্ত আগলানোর চেষ্টা করছেন। তাঁদের পাল্টা যুক্তি, জোটের ঢাল না থাকলে এই মমতা-ঝড়ের বাজারে বিরোধীদের ঘরে ৭৭টি আসনও আসত না। তাঁরা হিসেব করে দেখাচ্ছেন, তৃণমূলের বিপুল সাফল্যের মধ্যেও তারা পেয়েছে মোট দু’কোটি ৪৫ লক্ষ ভোট। আর বাম-কংগ্রেসের জোট পেয়েছে দু’কোটি ১৫ লক্ষ ভোট। আসনসংখ্যায় অনেক তফাত থাকলেও রাজ্যের মোট ভোটারসংখ্যার নিরিখে ৩০ লক্ষ ভোটের তফাত এমন কি, প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা? এ ছাড়াও, জোট-প্রার্থীরা ৭০টি কেন্দ্রে হেরেছেন পাঁচ হাজারের কম ভোটে। এবং ওই সব কেন্দ্রেই বিজেপি পাঁচ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছে। অর্থাৎ বিজেপি ভোট কেটে না নিলে জোটের ফল এমন খারাপ দেখাত না।
এই যুক্তি-পাল্টা যুক্তির মধ্যেই বিপর্যয়ের আগুনে পুড়ছে গোটা সিপিএম!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy