Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪

পঙ্গু নার্গিসকে আগলে রাখতে বিয়ে করলেন আব্দুল

এ কাহিনি পড়ে যাওয়া থেকে উঠে দাঁড়ানোর। এ কাহিনি দুরন্ত প্রেমের এবং দুনিয়াকে‌ বুঝিয়ে দেওয়ার যে, একটু ভরসা পেলে আর কাছের মানুষেরা পাশে থাকলে বাতিল হয়েও আবার জীবনে ফিরে আসা যায়!

ভরসা: নার্গিসকে এ ভাবেই আগলে রাখেন স্বামী অাব্দুল। নিজস্ব চিত্র

ভরসা: নার্গিসকে এ ভাবেই আগলে রাখেন স্বামী অাব্দুল। নিজস্ব চিত্র

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৮ ০১:৪৮
Share: Save:

এ কাহিনি পড়ে যাওয়া থেকে উঠে দাঁড়ানোর। এ কাহিনি দুরন্ত প্রেমের এবং দুনিয়াকে‌ বুঝিয়ে দেওয়ার যে, একটু ভরসা পেলে আর কাছের মানুষেরা পাশে থাকলে বাতিল হয়েও আবার জীবনে ফিরে আসা যায়!

পৃথিবীটাই থমকে গিয়েছিল বীরভূমের পাড়ুইয়ের নার্গিসের। জীবনের মূল স্রোত থেকে বাতিল হতে বসেছিলেন। কিন্তু আব্দুল তা হতে দেননি। নার্গিসের যাবতীয় শারীরিক সমস্যার কথা জেনেও তাঁকে ভালবাসলেন, নির্ভরতা দিলেন, ধৈর্য ধরে আগলে রাখলেন তিনি। বিয়ে করলেন দু’জনে। আব্দুলের সাহস ছড়িয়ে গেল নার্গিসের মধ্যেও। তিনিও পারলেন ঘুরে দাঁড়াতে। আচমকা আসা পঙ্গুত্ব মানেই যে এক নিমেষে সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়া নয়, তার নজির তৈরি করেছেন নার্গিস আর আব্দুল।

বছর ছয়েক আগে মোটরবাইক দুর্ঘটনায় শিরদাঁড়ায় মারাত্মক আঘাত পান নার্গিস। ১৮ দিন কোমায় ছিলেন সদ্য বিবাহিত ১৭ বছরের ওই তরুণী। সেই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তাঁর প্রথম স্বামীর। নার্গিসকে ‘রেফার’ করা হয় কলকাতায়। এখানে ‘বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি’ এবং এসএসকেএম হাসপাতালে সব মিলিয়ে টানা প্রায় তিন বছরের চিকিৎসা। এখনও একা দাঁড়াতে পারেন না। বসে-বসেই চলাফেরা করতে হয়। ঘরের টুকিটাকি কাজও করেন বসে। বসতে হয় পিছনে বালিশ দিয়ে। মলমূত্র ত্যাগেও সমস্যা রয়েছে। কিন্তু তাঁকেই সহধর্মিণী করতে এক মুহূর্ত সময় নেননি আব্দুল কুদ্দুস। গত ৩ জুলাই সুস্থ-সবল শিশুপুত্রের জন্ম দিয়েছেন নার্গিস ওরফে সোমা। জমিয়ে সংসার করছেন তাঁরা।

বীরভূমের কেন্দ্রডাঙাল গ্রামের আব্দুল শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। ফলে সামাজিক বাধা আসা স্বাভাবিক ছিল। জেনেশুনে প্রতিবন্ধী মেয়েকে কে আর সুস্থ ছেলের ঘরণী বলে মানতে পারে? কিন্তু কোনও বাধাই আব্দুলকে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারেনি। বিয়ের পরে কোনও আফশোস, অনুশোচনা? কোনও হীনম্মন্যতা বোধ নার্গিসের তরফে? দু’জনেই উত্তর দিয়েছেন—‘না।’

আব্দুলের কথায়, ‘‘একটা মেয়ে টানা কয়েক বছর সুস্থ হতে লড়ছে। ঝড় বয়ে গিয়েছে ওর উপর দিয়ে। তা-ও যখনই ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে, তখনই ওকে ঝলমলে দেখেছি। পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার কঠিন লড়াইটা চালাচ্ছে নিঃশব্দে, হাসিমুখে।’’ আব্দুল আরও বলেন, ‘‘শুধু একটা মানুষের দৈহিক সৌন্দর্য দেখে ভালবাসা হয় না। নার্গিসের মনের জোর, জীবনে ফেরার তাগিদ আর লড়াইয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এই লড়াইয়ে আমি ওর পাশে থাকতে চাই আজীবন।’’ আর লাজুক হেসে নার্গিসের মন্তব্য, ‘‘আমার স্বামী বা বাড়ির লোক কখনও এমন আচরণ করেননি, যাতে মনে হয় যে, আমি তাঁদের বোঝা, বা আমাকে নিয়ে ওঁরা লজ্জিত।’’ স্বামীর কথা উঠতেই বললেন, ‘‘আব্দুল সব জায়গায় আমাকে কোলে করে নিয়ে যায়। কোলে করে চেয়ারে বসায়, গাড়িতে তোলে। ওর কোলে চড়েই একসঙ্গে কেনাকাটা করি, সিনেমা দেখি, আত্মীয়দের বাড়ি যাই। এমনকি, বাড়ির দোতলাতেও ও আমাকে কোলে করে তোলে।’’

দুর্ঘটনায় আঘাত পেয়ে পঙ্গু হয়ে যাওয়া মানুষের পুনর্বাসনে বাড়ির লোকের বা কাছের মানুষের এই ভরসা বা পাশে থাকার গুরুত্ব যে অপরিসীম, তা স্বীকার করেছেন নার্গিসের চিকিৎসক, এসএসকেএমের ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ রাজেশ প্রামাণিক। তাঁর কথায়, ‘‘এই মানুষরাও যে জীবনের মূল স্রোতে ফিরতে পারেন, কাজকর্ম করতে পারেন, যৌন জীবন যাপন করতে পারেন, সন্তানের জন্ম দিতে পারেন— এটা প্রত্যেকের জানা উচিত। চিকিৎসার পাশাপাশি দরকার কাছের মানুষদের একটু পাশে থাকা, ধৈর্য রাখা, সাহস জোগানো, ক্যাথিটার লাগানো বা হাঁটার চেষ্টার সময়ে একটু সাহায্য করা। পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় ওষুধের থেকে কোনও অংশে এর প্রভাব কম নয়।’’

এসএসকেএম হাসপাতালেই ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগে গত চার মাস ধরে এক প্রৌ়ঢ় ভর্তি রয়েছেন। শৌচাগারে পড়ে গিয়ে শরীরের নীচের অংশ অবশ। সর্বক্ষণ তাঁর পাশে হাসপাতালে পড়ে রয়েছেন তাঁর ভাই। আর এক তরুণ ইঞ্জিনিয়ার

এসেছিলেন রায়গঞ্জ থেকে। দুর্ঘটনায় গত আট বছর ধরে তিনি পঙ্গু। হুইলচেয়ারে ঘোরেন। ভালবেসে তাঁকেও বিয়ে করেছেন এক তরুণী। ঠিক এমনই তো দেখা গিয়েছিল মণিরত্নমের ‘গুরু’ ছবিতে। গুরুতর অসুখে পঙ্গু মিনুকে (বিদ্যা বালন) ভালবেসে আপন করেছিলেন শ্যাম সাক্সেনা (মাধবন)। সেই ছবিতে শ্যামও মিনুকে কোলে নিয়ে চলাফেরা করতেন। নার্গিস আর আব্দুল ‘গুরু’ দেখেননি। তবে নিজেদের জীবনের গল্পেই তাঁরা এনেছেন সেলুলয়েডের গল্পের চমক!

অন্য বিষয়গুলি:

Love lame
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy