শমিতা মান্না। —ফাইল চিত্র
পদ ছাড়ার তিন দিনের মাথায় শাসকদলের একাংশের বিরুদ্ধে তোপ দাগলেন সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য প্রাক্তন উপাচার্য শমিতা মান্না। মেয়াদবৃদ্ধির পরেও আচমকা অপসারিত শমিতাদেবীর অভিযোগ, স্থানীয় দুই তৃণমূল নেতার কথা মতো না-চলার কারণেই তাঁকে সরানো হল।
মঙ্গলবার শমিতাদেবী দাবি করেন, উপাচার্য থাকাকালীন ওই দুই নেতার কথা মতো না-চলায় তাঁকে বারবার হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে। তবু তাঁর কার্যকালের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু তার পরে হঠাৎ এ ভাবে সরিয়ে দেওয়ায় তিনি বিস্মিত। “গত আড়াই বছর যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের স্বার্থে আমি কাজ করেছি। তবু কেন এই সিদ্ধান্ত?” এ দিন প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
এবং নিজেই এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। জানিয়েছেন, গত আড়াই বছর ধরে তৃণমূল-প্রভাবিত সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয় টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (এসকেবুটা)-এর এক নেতা তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর ক্ষেত্রে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে আসছিলেন। ওঁর কথা শুনে কাজ না-করলে উপাচার্যকে পুরুলিয়া থেকে তাড়ানোর হুমকিও দেওয়া হয় বলে শমিতাদেবীর অভিযোগ। পাশাপাশি তাঁর দাবি, তৃণমূলের জেলা স্তরের এক নেতাও নিজের স্ত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। “ওই দুই তৃণমূল নেতার হয়তো শিক্ষামন্ত্রীর উপরেও কোনও প্রভাব রয়েছে। তাই আমাকে সরানো হল।” মন্তব্য করেছেন শমিতাদেবী। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ ব্যাপারে এ দিন কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
গত রবিবার উপাচার্য পদে শমিতাদেবীর মেয়াদ শেষ হলেও স্থির হয়েছিল, সোমবার তিনি নতুন ভাবে ছ’মাসের জন্য উপাচার্যের দায়িত্ব নেবেন। বিশ্ববিদ্যালয়-সূত্রের খবর: তাঁর মেয়াদ ছ’মাস বাড়ানো হচ্ছে এই মর্মে গত ২২ অগস্ট রাজভবন থেকে শমিতাদেবীর কাছে চিঠিও গিয়েছিল। অথচ পুজোর ছুটির মধ্যেই, গত শনিবার ফের চিঠি দিয়ে মেয়াদবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়। কী ছিল সেই চিঠিতে?
শমিতাদেবী জানান, শেষ চিঠিতে বলা হয়েছে, রবিবারই তিনি যেন শিক্ষা-অধিকর্তা (ডিপিআই) দীপকরঞ্জন মণ্ডলকে উপাচার্যের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। তড়িঘড়ি দায়িত্ব নিতে দীপকবাবু পুরুলিয়া পৌঁছে যান। রবিবারই শমিতাদেবী তাঁকে কার্যভার বুঝিয়ে দেন। শিক্ষামন্ত্রীর যুক্তি ছিল, অস্থায়ী উপাচার্য শমিতাদেবীর মেয়াদ ৫ অক্টোবর শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই নতুন উপাচার্য নিয়োগ করা হল।
কিন্তু শমিতাদেবীর কার্যকালের মেয়াদ ছ’মাস বাড়িয়ে তো চিঠি দিয়েছিল খাস রাজভবন! তা হলে?
পার্থবাবু এ প্রসঙ্গে মুখ খুলতে চাননি। যদিও পুরো ঘটনাপ্রবাহে পুরুলিয়ার ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শমিতাদেবীর সহকর্মীদের অনেকেই বিস্মিত। তাঁরা বলছেন, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের এই প্রাক্তন শিক্ষক তৃণমূলের প্রতি আনুগত্যের জেরেই উপাচার্য হয়েছিলেন। এমনকী সম্প্রতি যে পাঁচ উপাচার্য কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলন করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীর হয়ে সওয়াল করেছেন, শমিতাদেবী তাঁদের অন্যতম। “হঠাৎ কী এমন হল, যাতে উনি রাতারাতি শাসকদলের বিরাগভাজন হয়ে গেলেন?” ধন্ধে পড়েছেন ওঁরা।
শমিতাদেবী অবশ্য এখানে শিক্ষক-নেতার ভূমিকাই বড় করে দেখছেন। তাঁর অভিযোগ, “ক’দিন আগে আমার ঘরে ঢুকে এসকেবুটা-র ওই নেতা শাসিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ওঁর কথা শুনে না-চললে ঝামেলায় পড়তে হবে।” তখন ঘটনাটা প্রকাশ করলেন না কেন? শমিতাদেবীর জবাব, “তখন আমল দিইনি। তাই কাউকে জানাইনি।” তাঁর আরও ব্যাখ্যা, “কাজ শুরু করেছিলাম একটা ছোট্ট ঘরে। সেটাও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ঘর নয়। একটা স্বপ্ন নিয়ে কাজ করতে এসেছিলাম। কাজটাই আমার কাছে বড় ছিল।”
তবে এখন মুখ খুলছেন কেন?
শমিতাদেবী বলেন, “যেটাকে মোটেই আমল দেব না ভেবেছিলাম, এখন দেখলাম, সেটাই সত্যি হল! আমি সে দিন ওই নেতাকে বলেছিলাম, দরকারে চেয়ার ছেড়ে দেব। কিন্তু এ ভাবে কারও হুমকির কাছে মাথা নোয়াব না।” নেতাটি কে?
এত সবের পরেও শমিতাদেবী তাঁর নাম জানাতে চাননি। তবে জানিয়েছেন, আগেও তাঁকে টেলিফোনে পুরুলিয়া-ছাড়া করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ওঁর কথায়, “গত বছর ভাইফোঁটার দু’দিন বাদে এক রাতে আমার মোবাইলে একটা ফোন আসে। হ্যালো বলতেই লাইন কেটে যায়। দ্বিতীয় বারেও তা-ই। তিন বারের বেলায় আমি ধরতেই এক পুরুষকণ্ঠ বলে, মিঠুদি, আপনাকে পুরুলিয়া ছাড়তে হবে, আপনি পুরুলিয়া ছাড়ুন। বক্তা নিজের পরিচয় দেয়নি।” শমিতাদেবীর দাবি, ঘটনাটি তিনি ডিএম-এসপি’কে জানিয়েছিলেন। এর পরে মাওবাদী নামাঙ্কিত হুমকি-চিঠি পেয়েও তিনি প্রশাসনিক স্তরে জানিয়েছিলেন বলে এ দিন দাবি করেছেন শমিতা মান্না।
তিনি কারও নাম না-করলেও গোটা ঘটনায় ওয়েবকুপা’র রাজ্য কমিটির সহ সম্পাদক তথা এসকেবুটা’র সম্পাদক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের নাম জড়িয়ে গিয়েছে। গৌতমবাবু অবশ্য এ দিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, “শমিতাদেবীকে আমি কখনও এমন কথা বলিনি।” কেউ তাঁর নাম করে অভিযোগ করলে মানহানির মামলা করবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ওই শিক্ষক-নেতা। কিন্তু শমিতাদেবীকে আচমকা সরানো হল কেন?
গৌতমবাবুর ব্যাখ্যা, “ওঁর (শমিতাদেবী)-র মেয়াদ তো শেষ! এখন সরকার যাঁকে মনে করেছে, দায়িত্ব দিয়েছে! এতে বিতর্কের কী আছে?” একই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, “জঙ্গলমহলের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের স্বার্থরক্ষার বদলে কিছু আধিকারিকের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি প্রাধান্য পেতে শুরু করেছিল। সে কারণেও ওঁকে সরানো হয়ে থাকতে পারে। এটা সরকারের ব্যাপার। আমাদের নয়।”
অন্য দিকে শমিতাদেবীর অপসারণের পিছনে রাজনৈতিক কারণ দেখছেন শিক্ষামহলের একাংশ। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায় যেমন বলছেন, “এটাকে তাড়ানো ছাড়া কিছু বলব না। অসংগঠিত শ্রমিকদের ক্ষেত্রেই আচমকা বলা হয়, কাল থেকে আর আসতে হবে না। শিক্ষাক্ষেত্রে এটি লজ্জাজনক ঘটনা।”
রবীন্দ্রভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য পবিত্র সরকারের আশঙ্কা, রাজ্যে এ ধরনের আরও ঘটনা ঘটবে। “শাসকদলের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও শমিতা হয়তো শাসকদলের স্থানীয় নেতাদের কথা শুনতে রাজি হননি। তাই সরতে হল।” পর্যবেক্ষণ পবিত্রবাবুর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy