Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪
Joydeep Mukherjee

ব্রাত্য কোচ আখতার, বিদায়বেলায় ব্যথিত বন্ধু জয়দীপ

কবরস্থানেও গিয়েছিলেন প্রিয় আখতারকে মাটি দেওয়ার জন্য।

এক  ফ্রেমে তিন কিংবদন্তি। নরেশ কুমার ও জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের মাঝে বসে আছেন সদ্য প্রয়াত আখতার আলি।

এক ফ্রেমে তিন কিংবদন্তি। নরেশ কুমার ও জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের মাঝে বসে আছেন সদ্য প্রয়াত আখতার আলি। ফাইল চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২৩:২৩
Share: Save:

সাউথ ক্লাব থেকে গোটা কলকাতা শহরে একটা সময় ওঁদের বন্ধুত্বের উদাহরণ দেওয়া হত। ওঁরা হলেন প্রেমজিত লাল, জয়দীপ মুখোপাধ্যায়আখতার আলি। এই ত্রয়ীর বন্ধন সেই ২০০৮ সালেই ভেঙে গিয়েছিল! সেই বছর সবার আগে চলে গিয়েছিলেন প্রেমজিত। আর রবিবার সকালে বন্ধু প্রেমজিতের কাছে চলে গেলেন আখতার। একা রয়ে গেলেন জয়দীপ। গত কয়েক দিন ধরে জানতেন বন্ধু খুব দ্রুত ওঁকে ছেড়ে চলে যাবেন। তাই তো আখতার পুত্র জিশান আলির কাছে দুঃসংবাদ পেয়েই শেষ বিদায় জানাতে ছুটে এসেছিলেন বন্ধুর বাড়িতে। জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের কাঁধে চেপে তাঁর কফিনবন্দি নিথর দেহ লোয়ার রেঞ্জের বাড়ি থেকে সাউথ ক্লাবের উদ্দেশে বেরনোর পর তিনি কবরস্থানেও গিয়েছিলেন প্রিয় আখতারকে মাটি দেওয়ার জন্য।

মৃত্যু চির সত্য। যদিও কাছের মানুষ চলে গেলে মেনে নিতে কষ্ট হয়। জয়দীপের সেটা হচ্ছিল। আবেগতাড়িত হয়ে বলছিলেন, “আখতারের সঙ্গে আমার দীর্ঘ ৬০ বছরের সম্পর্ক। আমাদের বন্ধুত্ব ছিল বেশ নিবিড়। আমি ও প্রেমজিত ওঁর থেকে জুনিয়র হলেও আমরা এক সঙ্গে সাউথ ক্লাবে খেলতাম। বন্ধুর মতই মিশতাম। আমরা তিনজন পুরো কলকাতা চষে বেড়াতাম। সব জায়গায় আমাদের দেখা যেত। আমাদের দেখে সবাই মজা করে বলতো, ‘তোমরা তো তিন ভাই’।” এরপর কিছুটা থেমে ফের বলতে শুরু করলেন, “আমি জানতাম ও আমাকে একা রেখে চলে যাবে। গত এক বছর ধরে বেশ অসুস্থ ছিল। খুব রোগাও হয়ে গিয়েছিল। পাশাপাশি ইদানিং সব কিছু ভুলে যেত। তবুও ওর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখতাম। শুনলাম শেষ দিকে ওর মূত্রনালীতে সংক্রমণ হয়। আর সেটাই ওর চলে যাওয়ার কারণ। মানুষ হিসেবে ও ছিল অসাধারণ। এত ভাল মনের মানুষ এই জীবনে দেখিনি।”

লন টেনিস ধনীদের খেলা। তবে সদ্য প্রয়াত আখতার সেই ধারণা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন। নিজের অধ্যাবশায় তো ছিলই, টেনিস তারকা হয়ে ওঠার নেপথ্যে ছিলেন জয়পুরের মহারানি গায়ত্রী দেবী। আখতারের বেড়ে ওঠার গল্প শোনাতে গিয়ে সেই তরুণ বয়সে ফিরে গেলেন প্রাক্তন ডেভিস কাপার। বলছিলেন, “ও বাইরে থেকে নরম স্বভাবের হলেও ভেতরে ছিল একজন যোদ্ধা। এলাহবাদের খুব দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসে সেই যুগে লন টেনিস খেলা মোটেও সোজা ছিল না। তবে আখতার অসাধ্য সাধন করেছে। ইংরেজ আমলে স্যাটারডে ক্লাবে ওর বাবা টেনিস মার্কার ছিলেন। তৎকালীন যুগে টেনিস কোচকে ‘মার্কার’ বলা হত। ওর বাবা যখন মারা যান, তখন আখতার খুব ছোট ছিল। পরিবারের সব দায়িত্ব ওর ওপর এসে পড়ে। দুই ভাইকে বড় করতে হবে। পাশাপাশি ছোট থেকেই দারুণ টেনিস খেলত। ওর সেই প্রতিভা জয়পুরের মহারানি গায়ত্রী দেবীর চোখে পড়েছিল। আর সেখানেই ওর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। মহারানি নিজেও খুব ভাল লন টেনিস খেলতেন। আখতার যখন জুনিয়র উইম্বলডন জিতল, তখন ওকে আর্থিক সাহায্য করেছিলেন। নিজের টাকায় ওকে ইংল্যান্ডে পাঠান। সেটা সম্ভবত ১৯৫৫ সালের কথা। তাই আখতারও মহারানিকে মায়ের মত ভালবাসত।”

তবে কোচ আখতার আলির যে সঠিক মূল্যায়ন হয়নি, সেটাও স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন জয়দীপ। বললেন, “জাতীয় দলের কোচ হিসেবেও আমার বন্ধু অনেক সাফল্য পেয়েছে। তবুও কোনও এক অজানা কারণে কেন্দ্রীয় সরকার আখতারকে ‘দ্রোণাচার্য’ পুরস্কার দিল না! ওঁকে ব্রাত্য করার কারণ আজও খুঁজে বেড়াই। শুধু আমি ও প্রেমজিত নই, বিজয় অমৃতরাজ, লিয়েন্ডার পেজের মত ছাত্র ওর হাত দিয়ে বেরিয়েছে। এরপরেও কোচ আখতারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। আমি ডেভিস কাপার আখতার নয়, কোচ আখতার আলিকেই এগিয়ে রাখব।”

নিবিড় বন্ধুত্ব থাকলে ঝগড়াও নিশ্চিত। কিন্তু দীর্ঘ ৬০ বছরের সম্পর্কে কখনও ফাটল তৈরি হয়নি। তার জন্য আখতারকেই কৃতিত্ব দিয়ে জয়দীপ বললেন, “আখতারের সঙ্গে পাকিস্তান, মালয়েশিয়ার মত দেশে খেলেছি। তবে প্রেমজিত ও আমি সম মানের খেলোয়াড় ছিলাম। আমি আর প্রেমজিত ছিলাম অনেকটা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মত। সেই দিক থেকে খেলোয়াড় হিসেবে আখতার আমাদের থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল। তবে পিছিয়ে থাকলেও সেটা নিয়ে ও কখনও মন খারাপ করেনি। তাই আমাদের বন্ধুত্বে কখনও ভাঙন ধরেনি। কারণ ও বিশ্বাস করত যে, খেলোয়াড় হিসেবে আমি ওর চেয়ে এগিয়ে। গত কয়েক বছর ধরে প্রেমজিত লালের নামে প্রতিযোগিতা আয়োজন করছি। আগামি ১৯ ফেব্রুয়ারি শুরু হবে। এবার থেকে এই প্রতিযোগিতায় প্রেমজিতের সঙ্গে বন্ধু আখতারের নামও জুড়ে যাবে। এটাই হবে ওর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য।”

আর কথা বলতে পারছিলেন না। জয়দীপের গলা ধরে আসছিল। মাটি দেওয়ার সময় প্রিয় বন্ধুকে কী বললেন? আবেগের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে জয়দীপ বললেন, “বললাম, বন্ধু পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমার প্রতি কোনও অবিচার করে থাকলে সেটা মনে রেখো না। হে প্রিয় বন্ধু আমাদের মধ্যে কখনও কোনও ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকলে মাফ করে দিও। তুমি ভাল থেকো। আমাদের আশীর্বাদ কোরও।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE