Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
আজ বিশ্বযুদ্ধের বড়দিন

অশ্বিন রুখতে নেটে স্বয়ং ওয়ার্ন

বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মতো মেগা ম্যাচের আগের দিন দু’দেশের জাতীয় সঙ্গীতের মহড়া হওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। হচ্ছিলও প্যাভিলিয়নের সামনে। কিন্তু ম্যাচের ড্রেস রিহার্সাল? সেটা কবে থেকে শুরু হল! ঠিক ড্রেস রিহার্সাল নয়, প্রতীকী। এগারো বনাম এগারো নয়। এটা এক বনাম এক। রবিচন্দ্রন অশ্বিন বনাম শেন ওয়ার্ন! মাইকেল ক্লার্ক সিডনি উইকেটটা ঠিক নিজের মনের মতো পাচ্ছেন না।

গৌতম ভট্টাচার্য
সিডনি শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৫ ০৫:৪৪
Share: Save:

বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মতো মেগা ম্যাচের আগের দিন দু’দেশের জাতীয় সঙ্গীতের মহড়া হওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। হচ্ছিলও প্যাভিলিয়নের সামনে। কিন্তু ম্যাচের ড্রেস রিহার্সাল? সেটা কবে থেকে শুরু হল!

ঠিক ড্রেস রিহার্সাল নয়, প্রতীকী। এগারো বনাম এগারো নয়। এটা এক বনাম এক। রবিচন্দ্রন অশ্বিন বনাম শেন ওয়ার্ন!

মাইকেল ক্লার্ক সিডনি উইকেটটা ঠিক নিজের মনের মতো পাচ্ছেন না। ওটা ঈষত্‌ শুকনোই থাকছে। অর্থাত্‌, বাউন্সের সঙ্গে টার্নও পাওয়া যাবে। এটা শোনার পর থেকেই অস্ট্রেলিয়ার অন্দরমহলে মৃদু ভূকম্পন শুরু হয়েছিল কি না জানি না।

তবে কিছু পরেই নাটকীয় ভাবে অস্ট্রেলীয় নেটে বল করতে আবির্ভূত হলেন শেন ওয়ার্ন।

সাধারণত বড় ম্যাচের আগে নিজের দেশে অস্ট্রেলিয়া নেট করলে চারটের মধ্যে তিনটে ছেড়ে দেওয়া থাকে পেসারদের। স্পিনার পায় একটা নেট। এ দিন দেখলাম পাশাপাশি দুই নেটে স্পিনার। একটায় সুইপ, রিভার্স সুইপ, স্পিনে স্টেপিং আউট অভ্যেস করছেন ফিঞ্চ-ফকনাররা। আর একটায় ওয়ার্ন টানা বল করেই যাচ্ছেন। সকালের দিকটা যে নেটে বল করছিলেন অশ্বিন।

অদ্ভুত পরিস্থিতি। কিছু ফ্যানকে বাইরে অনেক ক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখার পর ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তারা অস্ট্রেলিয়ার মাঠে অস্ট্রেলীয় টিম প্র্যাকটিস করার সময়ই নাগাড়ে চিত্‌কার করে যাচ্ছে ‘জিতেগা ভাই জিতেগা, ইন্ডিয়া জিতেগা!’ ওয়ার্ন দারুণ বল ঘোরাচ্ছেন। দু’বার ফকনারকে নাচিয়ে বোল্ড করলেন দেখে তারাই আবার আওয়াজ তুলল, ‘শেন কাম ব্যাক!’

কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার তখন অভিনন্দনের প্রত্যুত্তর দেওয়ার সময় নেই। কোথাও মনে হল, অ্যাডিলেডে স্টিভ ওয় যতটুকু উদ্দীপ্ত করেছিলেন, তার চেয়ে আরও একধাপ এগিয়ে যেতে চান ওয়ার্ন। আর তাই ড্রেসিংরুমে উদ্দীপ্ত বক্তৃতাও দিয়ে গেলেন। যার থিম: আক্রমণ এবং অশ্বিন! মাত্র মাস আড়াই আগেই অশ্বিনকে অ্যাডিলেডের স্পিনিং পিচে বাদ দিয়ে নেমেছিল বিরাট কোহলির ভারত। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে তাঁকেই মনে করা হচ্ছে দু’দলের বোলিং পার্থক্য।

ওয়ার্ন শুনলাম আবেগদীপ্ত বক্তব্যে বলেছেন, ‘বয়েজ, নক আউট পর্বে আক্রমণই একমাত্র রাস্তা। প্রথম বল থেকে তীব্রতা বাড়িয়ে যাও আর ওদের আক্রমণ করো। অশ্বিনকে কিছুতেই লাইনে স্টেডি হতে দিও না। ম্যাক্সওয়েল যেন ওকে আড়াআড়ি কয়েকটা মারে। তা হলেই ওর লাইন নষ্ট হবে।

একটা প্রশ্নের উত্তর কেউ পাচ্ছে না। নেটটা ক্যাপ্টেনের চেয়েও বেশি করে কোচের নিয়ন্ত্রণে। তা ইদানীংকালে কোচ ডারেন লেম্যানের সঙ্গে খুব খারাপ সম্পর্ক ওয়ার্নের। তাঁকে এর পরেও প্র্যাকটিসে আমন্ত্রণ জানাল কে? এই এক্তিয়ারটা তো কোচের! নাকি খয়েরি এসসিজি পিচে অস্ট্রেলিয়া বিপন্ন হতে পারে জেনে ওয়ার্ন-লেম্যান যুদ্ধবিরতি হল?

এক দুঁদে অস্ট্রেলীয় রিপোর্টার বললেন, “ঘটনাচক্রে ওয়ার্ন চলে এসেছিল।” কিন্তু মনে হল না কথাটা সত্যি বলে। কারণ ওয়ার্ন নিজে টুইট করেছেন, ‘টিম, আমাকে ট্রেনিংয়ে ডাকার জন্য ধন্যবাদ।’ ম্যাচের যা মেজাজ তাতে মনে হয় না এই মুহূর্তে সত্যি কী, কেউ জানতে চাইছে বলে। সবাই চাইছে সবচেয়ে বড় সত্যিটার জবাব কাল কারা জিতবে?

সে দিনও লিখেছি, নামেই এটা সেমিফাইনাল। নইলে মেজাজ-উপাদান-মনোভাব সব চালচিত্র মিশেটিশে রন্ধ্রে-রন্ধ্রে অকৃত্রিম ফাইনাল! অমন যে সিডনি শহর একচল্লিশ দিন আগে বিশ্বকাপের উদ্বোধনের পরেও কোনও ক্রিকেট উত্তেজনা দেখায়নি, সে আজ প্রকাশ্যেই ক্রিকেটের আলিঙ্গনে। ক্যুরিয়রে করে দেশ থেকে শ’য়ে শ’য়ে ভারতীয় জার্সি নেমেছে। সব সমর্থকের জন্য ‘বুক’ করা। আর সমর্থকেরাও তো সশরীর হাজির! সিডনির বড় রাস্তাটাস্তাগুলোয় ঘুরলেই এখন ভারতীয় ভাষা কানে আসছে:

কেম ছো, মাজা কেলি। পর্যটন সংস্থাগুলো যে মুম্বই, গুজরাত, বাংলা মিলে কত ক্রিকেট পুণ্যার্থী এনে ফেলেছে, বোধহয় ঠিকানা নেই! এদের সম্ভাব্য উপস্থিতিতে উত্তাল এসসিজি ভারতের ঘরের মাঠ দেখানো অনিবার্য মনে হচ্ছে।

উইকেটও কি দেশের বলে মনে হবে? ঠিক এ রকম সারফেসে শ্রীলঙ্কাকে দুরমুশ করেছিলেন ম্যাক্সওয়েলরা। মিচেল স্টার্ক যথারীতি গতির ফুলঝুরি তুলে দিয়েছিলেন। এ দিন রাতে দেখা গেল ম্যাক্সওয়েল টুইট করেছেন স্টার্ককে, ‘ভাল করে ঘুমোও বেস্টি। কাল বড় দিন।’ পেশাদার ক্রিকেটার কেন, যে কেউ এর মানে করবে—রেস্ট নিয়ে নে রে। কাল তো ওদের ভাজতে হবে তোকেই। পাবলিক ফোরামে এই টুইট করা তো আর এমনি এমনি নয়। মূল উদ্দেশ্য টুইটারে থাকা কোহলি-অশ্বিনদের পড়ানো যে, স্টার্ক আসছে রে তোদের জন্য!

এই পর্যায়ে এসে পুরোটাই মাইন্ডগেমে পর্যবসিত! কে কাকে কত চাপে রাখতে পারে আর কে কত সেই চাপ গায়ে না মেখে ভেতরটা ঠান্ডা রাখতে পারে। ভরত অরুণ বুধবারও বলছিলেন, “ধোনির মতো আশ্চর্য অধিনায়ক আমি দেখিনি। পুরো চাপটা গিলে ফেলে। আর ও এত ঠান্ডা দেখে আমার বোলাররাও উত্তেজিত হয় না।”

এমনিতে এসসিজি-র ইতিহাস দেখলে ম্যাক্সওয়েলের টুইট জাতীয় আগাম স্লেজিং অনর্থক মনে হবে। সচিন তেন্ডুলকরের যাবতীয় সিডনি-রমরমা সত্ত্বেও ওয়ান ডে-তে অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্য থেকেই গিয়েছে। দু’দেশের তেরো ওয়ান ডে ম্যাচে এই মাঠে ভারত জিতেছে মাত্র একবার। তিন বছরের কাছাকাছি এই মাঠে কোনও বড় ওয়ান ডে ম্যাচ অস্ট্রেলিয়া হারেনি। সামান্য ঔদ্ধত্যপূর্ণ মাইকেল ক্লার্ক দুপুরের স্বভাববিরুদ্ধ সাংবাদিক সাক্ষাতে বলে গেলেন, “এই ম্যাচটাই ভারতে হলে অন্য রকম ব্যাপার ছিল।” মানে কী? “মানে, ওখানে হলে ওরা যেমন ফেভারিট হতো, এখানে নিরঙ্কুশ আমরা।”

ভারতের পূর্বতন দলগুলি হলে বলাই যেত, মানসিক যুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া এগিয়ে আছে। কিন্তু ধোনির এই টিম বিশ্বকাপের শুরু থেকে অন্য ভাষায় কথা বলছে। অন্য ভাবে ভাবছে। রোহিত শর্মাকে সকালে কথা বলতে দেখে তো চমত্‌কৃত হয়ে গেলাম। কাল স্টার্ক-হ্যাজেলউডদের প্রথম টার্গেট তিনি হতেই পারেন। টিমের তরফে সেই রোহিতের স্পষ্ট কথা, “বড় ম্যাচ কী ভাবে খেলতে হয় আমরা জানি। আর শুনুন, এখানে প্রথম এসে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খারাপ খেলা জাতীয় সব কিছু এখন আমরা পিছনে ছেড়ে এসেছি।” আরও বলছিলেন, “আমরা এখানে বিশ্বকাপ জিতে ইতিহাস তৈরি করতে এসেছি। চার মাস বিদেশে পড়ে রয়েছি বলে কোনও যন্ত্রণা নেই। বাকি দু’টো ম্যাচ জেতার জন্য আরও পাঁচ মাস পড়ে থাকতেও কোনও আপত্তি নেই।” কোহলিও তো অস্ট্রেলিয়ান ওয়েবসাইটকে দেওয়া সাক্ষাত্‌কারে বলেছেন, ‘চাপ অস্ট্রেলিয়ার ওপর। ওরা বুঝুক সেটা কী ভাবে সামলাবে।’

শুনে মনে হচ্ছে, বাহ্‌ রে। এ রকম মনোভাব না থাকলে কি সাতে সাত হয়! পরক্ষণেই স্টিভ স্মিথকে অচঞ্চল ভাবে নেটের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে মনে হচ্ছে, এ-ই তো গোটা মরসুমে অস্ট্রেলীয় ব্যাটিংয়ের খুঁটি। স্পিন ভাল খেলেন। শর্ট বলও। পারবে ভারত এঁকে তাড়াতাড়ি ফেরাতে? স্মিথ ক্রিজে থেকে গেলে তো মেলবোর্নের টিকিটটাও অস্ট্রেলিয়ার হাতে থেকে যাবে!

উইকেটে পুরু ঘাস নয়, শুকনো খয়েরি আভা থাকছে—খবরটা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই বোধহয় নতুন করে বিশ্লেষণ শুরু হয়ে যায় এ দিন। ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে খেলার জন্য কারা মেলবোর্ন পৌঁছবে? যার যা রেটিং ছিল তা নিয়ে আবার গোনাগুনতি শুরু হয়ে যায়।

দেখলাম ওয়েবসাইটে মাইকেল হোল্ডিং বলেছেন, বোলিং ভারসাম্য ভারতকে সামান্য এগিয়ে রেখেছে। আবার ক্রিকেট পাণ্ডিত্যে যাঁর অধিকার প্রায় তুলনাহীন ধরা হয়, সেই মার্ক টেলর রাতের দিকে আনন্দবাজার প্রতিনিধিকে বললেন, “ভারত প্রচণ্ড লড়বে। কিন্তু নিজেদের পরিবেশে জিতবে অস্ট্রেলিয়াই।”

এত ট্যুরিস্ট এখন সিডনির বুকে। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কারও হাতে সিডনি হারবার, অপেরা হাউস বা বন্ডি বিচের ম্যাপ থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। বরং হাতে থাকবে এসসিজি-র টিকিট। ইভেন্টের নাম বিশ্বকাপ। ট্যুরিজমের নাম ক্রিকেট। এই অবস্থায় বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল শুরু হতে যাচ্ছে।

কিংবদন্তি বিল লরি ধারাভাষ্য দিলে নির্ঘাত শুরুই করতেন তাঁর বিখ্যাত অভিব্যক্তি দিয়ে, ‘ইটস অল হ্যাপেনিং রাইট হিয়ার অ্যাট দ্য সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড!’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy