দুই সেনাপতি: বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের আগে সাংবাদিক বৈঠকে ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহালি এবং নিউজ়িল্যান্ডের অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন। সোমবার ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে। রয়টার্স, এএফপি
ম্যাঞ্চেস্টার না মুম্বই? মঙ্গলবার কোথায় সেমিফাইনাল খেলতে নামছে বিরাট কোহালির ভারত? গুলিয়ে যেতে পারে।
সিটি সেন্টারের আশেপাশে প্রচুর ভারতীয় রেস্তরাঁ। আমিষ, নিরামিষ— সব ধরনের খাবারই আছে। সেখানে দু’দিন ধরেই নীল জার্সির ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। হ্যাঁ, ঠিকই লেখা হয়েছে। সোমবারেই বিরাট কোহালিদের নীল জার্সি পরে রাস্তায় নেমে পড়েছেন ভারতীয় ক্রিকেট-ভক্তেরা। বিশ্বকাপ চলাকালীন যত দিন যাচ্ছে, এই নীল জার্সি যেন জাতীয় পোশাকে পরিণত হয়েছে।
জাতীয় ক্রিকেট দল সেমিফাইনাল খেলতে নামছে। জাতীয় পোশাক গায়ে উঠে গিয়েছে। তা হলে ‘জাতীয় খাদ্য’ আর দূরে থাকে কেন? সিটি সেন্টার সংলগ্ন একটা রেস্তরাঁয় ঢুকে যা মেনু দেখা গেল, ভারত অধিনায়ক খুব খুশি হতেন। বড়া পাও, পাও ভাজি দুই-ই পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়াও রয়েছে উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতীয় বিশেষ বিশেষ নিরামিষ খাবারের লোভনীয় সব পদ।
বিরাট এর মধ্যে এক দিন বলছিলেন, ‘‘তিন টাকার বড়া পাও খেতাম প্র্যাক্টিস শেষে। এখন বাসে করে রাজার মতো আসি। তার পরে ট্রেনিং সেরে আবার এসি বাসে করে পাঁচতারা হোটেলে ফিরে যাই। যে-পথটা পেরিয়ে এসেছি, তা সব সময় মাথায় রাখার চেষ্টা করি আমি। সেই কারণেই কখনও কোনও কিছুকে নিশ্চিত বলে ধরে নিই না।’’
ভারত অধিনায়কের যদি ছোটবেলার ক্রিকেট শিক্ষার সরণি ধরে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়, ম্যাঞ্চেস্টার নাচতে নাচতে ব্যবস্থা করে দেবে। সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন স্ত্রী অনুষ্কাকেও। প্লেটে বড়া পাও সাজিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি রেস্তরাঁ তাঁর প্রেমিক-মনে দোলা লাগিয়ে গানও বাজিয়ে দেবে, ‘মেরে সপনো কি রানি কব আয়েগি তু’।
ভারত অধিনায়কের জীবনের ‘সপনো কি রানি’ এসেই গিয়েছেন। এখন অপেক্ষা ক্রিকেট-স্বপ্ন পূরণের। তিন টাকার বড়া পাও খাওয়ার সেই জীবনসংগ্রাম থেকে এখন তিনি ভারত অধিনায়ক এবং বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে নেতৃত্ব দিতে নামছেন। আর কোটি কোটি ভারতবাসী স্বপ্ন দেখছে তাঁর দলকে ঘিরে। বিরাট তো আছেনই, স্বপ্নকে আরও রঙিন করে তুলেছে রোহিত রোশনাই। পাঁচটি সেঞ্চুরির পরে পাঁচতারা বলে ডাকা হচ্ছে তাঁকে।
আজ ভারতীয় দলের হেড কোচ রবি শাস্ত্রী আইসিসি-কে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত ভাবে বলছিলেন, ‘‘অনেক দিন ধরেই জানতাম, রোহিত বিশ্বের সেরা ওয়ান ডে ক্রিকেটারদের এক জন। কিন্তু বড় ক্রিকেটার সে-ই, যে বড় মঞ্চে ভাল খেলে দেখায়। রোহিত সেটাই করে দেখাচ্ছে। বিশ্বকাপে পাঁচটা সেঞ্চুরি অভাবনীয়। আশা করব, আরও দু’টো ভাল দিন রয়েছে ওর জন্য।’’
প্রার্থনা এখন বাকি দু’দিনের জন্য। নিউজ়িল্যান্ডকে হারাতে পারলে ফাইনাল। তার পরে লর্ডসে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর ডাক। তিরাশিতে লর্ডসের ব্যালকনিতে কাপ হাতে দাঁড়ানো কপিল দেবের সেই বিখ্যাত ছবি। বিরাটের তখন বয়স? জন্মানইনি। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের পাঁচ বছর পরে পৃথিবীর আলো দেখেন এখনকার অধিনায়ক।কপিলের কাপ জয়ের দলের এক সদস্য এ বারেও বিরাটদের ড্রেসিংরুমে উপস্থিত। হেড কোচ রবি শাস্ত্রী।
নিউজ়িল্যান্ডকে নিয়ে চার দিকে যেমন একটা আবহ তৈরি হয়েছে যে, হেলায় ফাইনালে চলে যাবে ভারত, তা নিয়ে সাবধান করে দেওয়ার আদর্শ লোক শাস্ত্রী। তিরাশির কাপ জয়ের ইতিহাসকে টেনে তিনি নিশ্চয়ই সতর্ক করে দিতে চাইবেন বিরাটদের যে, ‘‘ক্রিকেটে সব সময় ফেভারিট জেতে না। আন্ডারডগরা অনেক হিসেব ওলটপালট করে দিয়ে যেতে পারে। আমরা যেমন সকলকে বোকা বানিয়ে লয়েডের স্বর্ণযুগের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দিয়েছিলাম।’’
আজ কোহালির সাংবাদিক বৈঠকে উপচে পড়া ভিড়। দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত নেই। নিউজ়িল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনের সময় আবার সেনসেক্স পড়ার মতোই ঝুপ করে সংখ্যাটা নেমে গেল। উইলিয়ামসনের হাবভাব দেখে মনে হল, আন্ডারডগ তকমা পেয়ে বেশ খুশিই। যত চাপ তো বিরাটদের উপরেই। এগারো বছর আগের এক ফাইনালে তাঁদের দেশকে এ-রকমই একটা সেমিফাইনালে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কোহালি এবং কেন। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের সেই ম্যাচ নিয়ে দু’জনেই বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন আজ। সে-বার উইলিয়ামসনের নিউজ়িল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল কোহালির ভারত।
এ বারেও কাপ জয়ের লক্ষ্য কোহালির দলে এমনই নেশার মতো ছড়িয়ে পড়েছে যে, ব্যক্তিগত কীর্তিতে কেউ আর বুঁদ হচ্ছেন না। রোহিত আগের দিনই বলেছেন, পাঁচটা সেঞ্চুরির তখনই মূল্য থাকবে, যদি চ্যাম্পিয়ন হতে পারেন। কোহালি আজ একই সুরে জানিয়ে দিলেন, তাঁর কোনও সেঞ্চুরি না-থাকায় আক্ষেপ নেই। রোহিত সব সেঞ্চুরি করে দেওয়ায় বরং তিনি অধিনায়ক হিসেবে খুশি। ‘‘রানটা কার ব্যাট থেকে এল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসল হল, দলের কতটা কাজে আসতে পারলাম। আমি আমার ভুমিকা নিয়ে খুশি। আরও খুশি রোহিতের স্বপ্নের ফর্ম দেখে। আশা করব, আরও দু’টো ভাল দিন যাক ওর।’’ সেই আরও দু’টো দিনকে ঘিরে প্রার্থনার সুর।
বিশ্বকাপে সব মাঠের দখল নেওয়ার মতো মঙ্গলবার ওল্ড ট্র্যাফোর্ডও তেরঙ্গা পতাকা আর নীল জার্সির সমুদ্রে পরিণত হতে চলেছে। আজ দুপুরে স্টেডিয়ামের বাইরে বেরোতেই নমুনা পাওয়া গেল, কী পরিমাণ উৎসাহ তৈরি হয়েছে প্রথম সেমিফাইনাল নিয়ে। দেখা গেল, এক দিন আগেই গেটের সামনে প্রচুর লোক এসে জড়ো হয়েছেন। সকলের মুখেই এক প্রশ্ন— কালকের ম্যাচের একটা টিকিট পাওয়া যাবে? ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের ভিতর থেকে যাঁরাই বেরিয়ে আসছেন, অপেক্ষমাণ জনতার এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। ভারতীয় দল প্র্যাক্টিসে নামার আগে কয়েক জন বাঙালির দেখাও মিলল। নিউ ইয়র্ক থেকে খেলা দেখতে এসেছেন। তাঁরা অবশ্য অনেক আগে থেকেই অনলাইনে টিকিট বুক করেছিলেন।
এখানেই শেষ নয়। ওল্ড ট্র্যাফোর্ড থেকে বাস, ট্রাম বা ট্যাক্সি ধরে শহরের যে-কোনও হোটেলে চলুন লাঞ্চ সারার জন্য। প্রত্যেকের মেনুতে চিকেন টিক্কা মসালা ঢুকে পড়েছে। তার সঙ্গে নান এবং সাদা ভাত কমপ্লিমেন্টারি। এখন আর এখানে এসে আলাদা করে ভারতীয় খাবার খুঁজতেও বেরোতে হয় না। এমনকি হোটেলের রিসেপশনেও চিনা বা ইংরেজ কর্মীরা বলে উঠছেন, ‘শুক্রিয়া’। ট্যাক্সিতে উঠলে ড্রাইভার প্রথমেই জিজ্ঞেস করবেন, ‘‘আমি তো পঞ্জাব থেকে, আপনি ভারতের কোথা থেকে আসছেন?’’
কোনও সন্দেহ নেই ম্যাঞ্চেস্টারকে মুম্বইয়ে পরিণত করার আয়োজন সম্পূর্ণ। মাঠে তবু ক্রিকেটীয় দ্বৈরথ হবে এবং সব সময় গ্যালারি যে খেলে দেবে না, এজবাস্টনে ইংল্যান্ড ম্যাচই তার প্রমাণ। সে-দিন গ্যালারির আশি শতাংশ ভারতীয় দর্শকে ভর্তি থাকলেও জিততে পারেননি কোহালিরা। তিরাশির স্মৃতি মাথায় রাখাও ভাল যে, ফেভারিট মানেই জেতার গ্যারান্টি কার্ড নিয়ে উপস্থিত হওয়া নয়। এই ওল্ড ট্র্যাফোর্ডেই তো গ্রুপ ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল কপিলের দলের। তার পরেও তাঁদের কেউ ধর্তব্যের মধ্যে আনছিল না। ২৫ জুন লর্ডসে এর পরে ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা অঘটন ঘটিয়ে দিলেন তাঁরা।
যদি আন্ডারডগের জয়ধ্বনি না উঠত সে-দিন, ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসই নতুন ভাবে লেখা হত না। আজ ফেভারিট হয়েও তাই ভারত, আন্ডারডগ হইতে সাবধান!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy