রাতের অন্ধকারে তল্লাট কাঁপিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মহিলা-পুরুষ ঢুকছে বাড়িটায়, ঢুকছে তো ঢুকছেই। আবার সকালের আলো ফুটলেই তারা দলে দলে বেরিয়ে পড়ছে। রাতভর বাড়ির চারদিক জুড়ে যতদূর চোখ যায় শুধু গাড়ি আর গাড়ি। রীতিমতো মধুচক্রের লক্ষণ! পাড়ার আমেরিকানদের মনে তো ঘোর সন্দেহ হবেই! আসলে, ওই বাড়ির ভিতরে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসর বসেছে, ছোটপর্দায়। খেলায় জলপানের বিরতির ফাঁকে আমরা সিগারেট টানতে বাইরে বেরিয়েছি, পাশের বাড়ির এক মাঝবয়সী মার্কিন এসে চোখ মারার মতো ভঙ্গি করে শুধোল, ‘হচ্ছেটা কী’! আমরা বললাম, ‘ক্রিকেট’! আমেরিকানরা আবার ক্রিকেটটা তেমন বোঝে না। আগন্তুক আবদার করল, ‘সেটা কেমন খেলা বটে, বোঝাও তো!’ হাতে সময় কম, খেলা শুরু হতে চলেছে। কোনও মতে ‘বেসবলের মতো’ বলে পড়শিকে কাটিয়ে আমরা ফের বাড়ির বৈঠকখানায় দেহ রাখলাম!
মার্কিন মুলুকে বসে আমরা বাঙালিরা এর তার বাড়িতে পালা করে দল বেঁধে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারতের খেলা দেখি, সিনেমা হলের পর্দার মতো ঢাউস টিভি-তে। কাজের দিনগুলিতে নয় অবশ্য, সপ্তাহান্তে ভারতের খেলা পড়লে তবে। এবার তো প্রযুক্তির কৃপায় বাড়তি পাওনা খেলার সঙ্গে বাংলা ধারাবিবরণী শোনা। তবে ওই যে, দিন-রাতের সময়ের ফারাক। কাজেই খেলা শুরু মার্কিন সময়ের কাকভোরে, রাতজাগা চোখে খেলা দেখা। ঠিক যেমন আমরা মহালয়ার ভোরে রাতজাগা কানে বেতারে বীরেন ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শুনতাম!
সবাই আসবে। কিন্তু দর্শকাসন বণ্টন হবে ‘যোগ্যতা’র ভিত্তিতে। সুতপার নেতৃত্বে আমাদের বিশেষজ্ঞ কমিটি খেলা দেখতে আগ্রহীদের অডিশন নেবে, বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ইতিহাস ও সমকালের বিষয়ে কুইজ। যারা ভাল ফল করবে, তারা বসবে প্রথম দিকের সারির আসনগুলিতে। বাকিদের পিছনে নিল ডাউন হয়ে বসে ঘাড় উঁচিয়ে খেলা দেখতে হবে।শুভাশিসদা ক্রিকেটের সংবিধান বিশেষজ্ঞ, সে আমাদের ফোর্থ আম্পায়ার। থার্ড আম্পায়ার-সহ খেলার তিন জন আম্পায়ারের কাজকর্ম খুঁটিয়ে দেখা তার কাজ। তাকে সাহায্য করার জন্য স্বরূপদা থাকে বটে, কিন্তু তার আবার ‘রুদালি’ ঘরানা। সে ভারতের কেউ আউট হলেও কাঁদে, কেউ ছয় মারলেও কাঁদে, ভারতের কেউ উইকেট পেলেও কাঁদে, ক্যাচ ফেললেও কাঁদে! সে হাতে তোয়ালে নিয়ে খেলা দেখতে বসে।
আর ‘চ্যাপলিন’ গোছের দর্শক হল সুনির্বাণ।ভারতের এক ফিল্ডার ক্যাচ ফেলে দেওয়ায় সে বিদ্রূপের ছলে হেসে ফেলেছিল। তাকে হলুদ কার্ড দেখাল আচরণবিধি বিষয়ক আধিকারিক সুরঞ্জন, শাস্তি, এক ঘণ্টার জন্য খেলা দেখা বন্ধ, বাড়ির কোনও রুদ্ধদ্বার কক্ষে সে সাময়িক নির্বাসিত। পরের খেলায় সুনির্বাণ ফের হেসে ফেলল এক ভারতীয় ব্যাটসম্যান একটা বাজে বলে বোল্ড হওয়ার জন্য। এবার ক্ষমাহীন লাল কার্ড, পরের দিনের খেলায় সুনির্বাণের নো এন্ট্রি!
প্রযুক্তিগত নিরাপত্তার দিকটা দেখে দেবজিত। নেটওয়ার্কের একটু হেরফের হলেই বেচারাকে কথা-পেটা করা হয়। কিন্তু সে এই পবিত্র কাজটাকে ভারতমাতার সেবা বলে মনে করে, তাই শত গালাগাল উপেক্ষা করে সে হাতে রিমোট নিয়ে ধ্যানস্থ! এবার সে একটা নতুন পরিষেবা চালু করেছে, খেলা চলাকালীন বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে সে ভিডিও কল-এ যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছে আমেরিকার অন্যান্য শহরের খেলা দেখা বাঙালিদের সঙ্গে। এই সার্ভিসের নাম দেওয়া হয়েছে লাইভ সাপোর্টার। সুপার হিট প্রোগ্রাম!
অশোকাবৌদি খেলা দেখতে বসে পদ্মাসনে, সত্যনারায়ণের প্রসাদী ফুল হাতে নিয়ে। পাশে ভক্তিভরে চোখ বুজে বসে থাকে তার ডাক্তার বর বীতশোকদা, গলায় স্টেথো, কোলে ফার্স্ট এড বক্স, হাতে ব্লাডপ্রেশার মাপার যন্তর। খেলা দেখার উত্তেজনায় কারও বুক ধড়ফড় করলে বা বমি ভাব হলে, সঙ্গে সঙ্গে আপৎকালীন চিকিৎসা শুরু। কিছু ব্যাপার অবশ্য ডাক্তারবাবুর হাতের বাইরে। যেমন, রূপমের পেটের রোগ, কথায় কথায় তার ‘বড় ইয়ে’ পেয়ে যায়। আর মাঝবয়সী অনুব্রতদার আবার মধুমেহ, বারে বারে ‘ছোট ইয়ে’ পেয়ে যায় তার। কিন্তু দেখা গেছে, রূপম বা অনুব্রতদা একটু নড়াচড়া করলেই ভারতের কেউ আউট হয় কিংবা ভারতীয় বোলাররা নো বল বা ওয়াইড ডেলিভারি করে। আবার তাদের নড়তে না দিলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে। তাই সালিশি সভার আপস মীমাংসা অনুসারে ওরা দু’জনেই খেলা দেখতে বসে দীর্ঘস্থায়ী ডায়াপার পরে।
দর্শকদের আচরণবিধি নিয়ে একটা কমিটি আছে আমাদের, নেতৃত্বে রূপঙ্কর। সেদিন দীপ্ত একটু দেরিতে এসে খেলা দেখতে বসা মাত্র এক ভারতীয় ব্যাটসম্যান আউট। ব্যস, ফরমান জারি হল, বসলে চলবে না, দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে হবে দীপ্তকে।সে তাই-ই করল, ভারত জিতল।একবার ভারত প্রায় জেতার মুখে, আর কয়েকটা রান বাকি, হাতে ওভার-উইকেট, দুই-ই মজুত। খানিক নিশ্চিন্ত হয়ে রণদীপ সস্ত্রীক বাড়ির দিকে রওনা হল, বড্ড ঘুমকাতুরে সে। রাত জেগে খেলা দেখে তার একটু সাধ হল, বাড়ি গিয়ে বিছানা নেবে।ওমা, সে যাওয়ার পরে ভারত তুলল ১০ বলে ৩ রান। রণদীপ তখন সবে তার বাড়ির তালা খুলছে। তাকে ফোন করে ডেকে পাঠানো হল। সে ফিরে এসে যেই খেলাঘরে ঢুকল, সঙ্গে সঙ্গে উইনিংস্ট্রোক মারল ভারত!
নবমিতা আবার সখের জ্যোতিষচর্চা করে। তার সঙ্গেজোটবেঁধেরূপঙ্কর খেলা চলাকালীন কিছু তুকতাক করে। যেমন, ঘরে ভারতের জাতীয় পতাকার মতো তেরঙ্গা আলো জ্বালানো, ফুলদানিতে ভারতের জার্সির মতো আকাশি রঙের ফুল! বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, দর্শকদের কেউ কেউ জামাকাপড়ের আড়ালে মাদুলি-তাবিজ ধারণ করে খেলা দেখতে বসে।গুজব আছে, সোহমখেলার দিন নির্জলা উপবাস করে ‘মানত’ করে।এ-ও রটেছে যে, কিঞ্জল রুদ্রাক্ষের মালা পরে, গলা মাফলারে ঢেকে খেলা দেখতে বসে। মুক্তিদি তো কোলে শঙ্খ ঘণ্টা নিয়ে, ধূপকাঠি জ্বালিয়ে, সানগ্লাস পরে খেলা দেখে।
দীপায়ন সম্প্রতি একটা ‘এন্ট্রান্স পোল’ চালু করেছে। খেলা শুরুর আগে দর্শকদের মতামত একটা সফটওয়ারে ফেলে, তা থেকে ডিজিটাল গ্রাফিক্স বানিয়ে, সে এক কাণ্ড বটে! তবে ওই ‘পোল’ তো, কখনও তা মিলে যায়, কখনও ‘আবহাওয়ার পূর্বাভাস’-এর মতো, পুরো ফ্লপ।
আর, এ সবের বাইরে আমাদের বিশ্বকাপ ক্রিকেট দেখার সময় এমন কিছু ঘটনা ঘটে যে, তা থেকে প্রথম শ্রেণির আঁতেল চিরন্তন ‘ক্রিকেট ও সমাজচেতনা’ বিষয়টি নিয়ে একটি ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেছে, শিরোনাম ‘বিশ্বরূপ দর্শন’! একটা উদাহরণ দিই। বাংলাদেশিরা তো আমাদের সঙ্গে খেলা দেখে। যেমন, বিজিতদা, মুখে এক খিলি জর্দা পান পুরে সে কাঠবাঙাল উচ্চারণে ঘোষণা করে, ‘আমাগো একই দ্যাশ, একই সমাজ। অ্যারে ভাগ করে কেডা! আমি দ্যাশভাগ মানি না। আমি ইন্ডিয়ার সাপোর্টার’!
ভারত-বাংলাদেশ খেলার দিন অবশ্য সিন চেঞ্জড! সেদিন বিজিতদা জনমত গড়বে এই বলে যে, ‘বাঙ্গালি পোলারা মাঠ কাঁপায়ে খ্যালতাছে, সাহেবগুলানরে প্যাঁদাইতাছে, আরেমশয়, তাগো সাপোর্ট দ্যান!’এই না শুনে ‘মৌলবাদী’ বাঙালি প্রবীরদা মনে মনে ‘ও আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গাইতে গাইতে, বুক চিতিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে নিদান দেয়, ‘আমি আজ বাংলাদেশের ফেবারে’! সেদিন থেকে অবশ্য আড়ালে আবডালে আমরা প্রবীরদাকে ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ বলে ডাকি!
সেদিন ভারত জিতেছে।খেলা দেখে আমরা হইহই করে বেরচ্ছি।ঠিক তখনই সেই মার্কিন পড়শির সঙ্গেফের দেখা। খানিক ব্যাঙ্গের সুরে সে বলল, ‘স্টিল ক্রিকেট গোয়িং অন! ইজ ইট এ স্পোর্ট অর টিভি সিরিয়াল’! নিরুত্তর ঘাড় ঝাঁকালাম আমরা। আর মনে মনে বললাম, থাকতো তোমাদের শহরে একটা ইডেন উদ্যান, তাহলে বুঝতে ক্রিকেট কী জিনিস! আহা, সেই শীতের উজ্জ্বল দুপুর, কমলালেবুর সুবাস, অজয় বসুর ধারাভাষ্য, হাইকোর্ট প্রান্তে গঙ্গার বাতাস, ময়দান প্রান্তে দিনের শেষ রোদ্দুর, গাওস্কর-বিশ্বনাথ, সচিন-সৌরভ, বেদি-প্রসন্ন-চন্দ্রশেখর, কপিল-কুম্বলে! মার্কিন মুলুকে বাঙালির ক্রিকেটের বিশ্বকাপ দর্শন তো আসলে স্মৃতি রোমন্থন! আমাদের প্রিয় কলকাতা তো ক্রিকেট খেলার মতোই মজাদার!
কার্টুন: দেবাশীষ দেব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy