Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

মানসিকতা বদলে দেওয়ার নাম হাতুরুসিংহে

শেন জার্গেনসেন বেতন পেতেন ১১ হাজার মার্কিন ডলার। তাতেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। ক্রিকেটারদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা খুব একটা ছিল না। আবার দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের কারও উপর প্রয়োজনে কঠোর হতে পারতেন না। ভদ্র অমায়িক এই অস্ট্রেলিয়ানের সমস্যা ছিল এই একটাই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
ঢাকা শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৬ ১৩:৪৩
Share: Save:

শেন জার্গেনসেন বেতন পেতেন ১১ হাজার মার্কিন ডলার। তাতেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। ক্রিকেটারদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা খুব একটা ছিল না। আবার দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের কারও উপর প্রয়োজনে কঠোর হতে পারতেন না। ভদ্র অমায়িক এই অস্ট্রেলিয়ানের সমস্যা ছিল এই একটাই। ২০১৪ সালের শুরুতে শ্রীলঙ্কার কাছে ওয়ানডে এবং টি-২০ সিরিজ হারের পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ( বিসিবি ) সভাপতি বসেছিলেন তাঁকে নিয়ে। কোথায় ক্রিকেটারদের সমস্যা তা জানতে চেয়েছিলেন তাঁর কাছে। ক্রিকেটাররা কথা শোনে না, একাদশ নির্বাচনে সিন্ডিকেট হয়ে গিয়েছে দলের মধ্যে, এমন ভয়ঙ্কর তথ্য বিসিবি সভাপতিকে দিয়েছিলেন জার্গেনসেন। ক্রিকেটারদের সামনে এতটা নিরুপায় যে কোচ, তাঁকে রেখে লাভ কি? তার চেয়ে বরং জার্গেনসেনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নুতন কোচের সন্ধান করাই উত্তম। এই চিন্তাভাবনা থেকে হাই প্রোফাইল কোচ খোঁজা শুরু। তবে বায়োডাটা দেখে যাঁদেরকে রাখতে হল পছন্দের তালিকায়, তাঁদের কাউকে নয়, শ্রীলঙ্কার প্রাক্তন টেস্ট ক্রিকেটার হাতুরুসিংহের দিকেই শেষ পর্যন্ত হাত বাড়াতে হল।
প্লেয়িং কেরিয়ারটা তাঁর অতো বড় নয়, ২৬ টেস্টের পাশে ৩৫ ওয়ানডে। কোচিং কেরিয়ারের শুরুটা তাঁর আমিরশাহি থেকে। ২০১১ বিশ্বকাপে কানাডার কোচের দায়িত্ব নিয়েও নিশ্চয়ই খুব একটা খুশি হতে পারেননি। ২ বছর শ্রীলঙ্কা দলের সহকারী কোচ হিসেবে ছিলেন। কিন্তু সঙ্গাকারার আবেদনেও বরফ গলেনি শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের। সেই হাতুরুসিংহে শ্রীলঙ্কা থেকে ঘাঁটি গাড়লেন অস্ট্রেলিয়ায়। নিউ সাউথ ওয়েলস এবং বিগ ব্যাশের দল সিডনি থান্ডার্সের সহকারী কোচের দায়িত্ব নিয়েই এলেন আলোচনায়। এমন প্রোফাইলে সন্তুষ্ট বিসিবি-র অফার তাঁর কোচিং কেরিয়ারটাই বদলে দিল। বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে দামি কোচ তিনিই।
মাসে বেতন কতো জানেন? সাড়ে বাইশ হাজার মার্কিন ডলার ( বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১৮ লাখ টাকা)! বিসিবি-র কেন্দ্রীয় চুক্তিতে যেখানে ১৪ জন ক্রিকেটারের মাসিক বেতনের সমষ্টি ১৮ লাখ ৮০ হাজার, সেখানে হাতুরুসিংহের একার বেতন ১৮ লাখ টাকা। ২ বছরের জন্য চুক্তি হয়েছে তাঁর সঙ্গে। অবশ্য চুক্তির এক মাস আগে যোগ দিয়েছেন দলে।
তাঁর প্রস্তাবে রুয়ান কালপাগে সহকারী কোচ, মারিও ভিল্লাভারান হন ফিটনেস এন্ড কন্ডিশনিং কোচ। এঁরা দু’জনেই শ্রীলঙ্কার। চুক্তিপত্র তৈরির সময় বিসিবি-র কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছেন ক্ষমতা এবং স্বাধীনতা। সাকিবের মতো ক্রিকেটারকে সাজা দিয়ে, দলের বাইরে রেখেও খেলা যায়।বিসিবি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাতুরুসিংহের সঙ্গে কথা বলেই। ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ ( সিপিএল) এ পেয়েছেন সাকিব দল। ওই আসরে খেলতে ঢাকা থেকে লন্ডন হয়ে বারবাডোজের পথে উড়েও দিয়েছিলেন। কিন্তু যাত্রাপথে লন্ডন থেকে ফিরে আসতে হয় তাঁকে ! বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরকে সামনে রেখে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট লিগে খেলা এক অর্থে সাকিব এবং দলের জন্য ভালই। নো অবজেকশন চিঠি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি সাকিব। তবে মৌখিকভাবে সম্মতি নিয়ে বারবাডোজের পথে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেই আপত্তি হাতুরুসিংহের। তাঁর কথা একটাই, আগে দলের সঙ্গে অনুশীলন। লন্ডনে যাত্রা বিরতিতে হাতুরুসিংহের সঙ্গে সাকিবের টেলিফোনে কথা কাটাকাটি হয়। সঙ্গে সঙ্গে ওই টেলিফোনের সারমর্ম ই-মেল বার্তায় বিসিবিকে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন এই কোচ! ওই ই-মেল বার্তায় ফিরে আসতে বাধ্য হলেন সাকিব। সিপিএল থেকে মোটা টাকা আয়ের পথটাও বন্ধ হল । এবং দেশে ফিরে বিসিবি-র কাছে মুচলেকা দিয়ে, নিজের ভুল স্বীকার করে মিডিয়ার সামনে জবানবন্দি দিতে হয় সাকিবকে। তার পরও বহিষ্কারাদেশ থেকে মুক্ত হতে সময় লেগেছে। দলের সঙ্গে যেতে পারেননি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। সাকিবকে শিক্ষা দিয়ে বিসিবি-র প্রশংসা পেয়েছেন জার্গেনসেন। ওই ঘটনা থেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পুরো কর্তৃত্বটা পেয়ে গেছেন হাতুরুসিংহে। হাত উঁচু করে কে বলতে পারে,আমি পারব? বুকের পাটা এমন যাদের, তাঁদেরকে নিয়েছেন বেছে। ২০১৪ সালের শেষ দিকে এসে জিম্বাবোয়ের বিপক্ষে ২৫ রানের ইনিংস দেখে ইয়েস কার্ড দিয়েছেন সৌম্য সরকারকে। ওই সিরিজেই সাব্বির রহমান, তাইজুল, যুবায়েরকে দিয়েছেন গ্রিন সিগন্যাল। দল এবং একাদশ নির্বাচনে সিনিয়রদের সিন্ডিকেট ভেঙে দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়িয়ে দিয়েছেন হাতুরুসিংহে।
ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটি নামে বিসিবি-র একটি কমিটির দায়িত্ব ক্রিকেটারদের দেখভাল,দ্বিপাক্ষিক সফর আয়োজন, ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক সূচি আয়োজন করা। অথচ এই কমিটি হাতুরুসিংহের সিদ্ধান্তের বাইরে কিছুই করতে পারছে না। এশিয়া কাপ এবং টি-২০ বিশ্বকাপের জন্য এক সঙ্গে ২৫ ক্রিকেটারকে অনুশীলন করাতে চেয়েছিলেন তিনি। হাতুরুসিংহের সেই চাওয়াটা পূরণ করতে ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের আসর বাংলাদেশ ক্রিকেট লীগ ( বিসিএল) মাঝপথে বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে টুর্নামেন্ট কমিটি। জিম্বাবোয়ের বিপক্ষে গত জানুয়ারীতে হোম সিরিজে ছিল ২টি টেস্ট, তা বাদ দিয়ে ৪ ম্যাচের টি-২০ সিরিজ আয়োজন করেছে বিসিবি হাতুরুসিংহের প্রস্তাবেই। তার যুক্তি একটাই, সামনে যখন টি-২০ ফরম্যাটে এশিয়া কাপ এবং টোয়েন্টি-২০ বিশ্বকাপ অপেক্ষা করছে, তখন তার আদর্শ প্রস্তুতির জন্য আন্তর্জাতিক টি-২০ ম্যাচ খেলতে চাই। জিম্বাবোয়ের বিপক্ষে সর্বশেষ টি-২০ সিরিজে ২-০ তে এগিয়ে থেকে নুতনদের পরখ করে দেখতে দলে বড় ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হল। তার মাশুলও দিতে হল বাংলাদেশকে। সিরিজটি ২-২ এ নিষ্পত্তি হল। তার পরও কোচের উপর বিসিবি-র কোন অভিযোগ নেই।
হাতুরুসিংহের কথা না শুনে উপায় যে নেই বিসিবি-র। সর্বশেষ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশকে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত তোলার নেপথ্যে এই কোচ। পেস এবং বাউন্সি উইকেটে খেলার অভ্যাস নেই বলে ২০১৫-র বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের ভবিষ্যত্ নিয়ে শঙ্কাটাই ছিল তীব্র। আফগানিস্তান, স্কটল্যান্ডকে নিয়েও ভয় পাচ্ছিল বিসিবি। সেখানে এই দু’টি দল তো দূরের কথা, ইংল্যান্ডের মতো দলকেও হারিয়েছে বাংলাদেশ। তা সম্ভব হয়েছে বিসিবি-র টাকায় বিশ্বকাপের আগে ব্রিসবেনে ১ মাসের ক্যাম্প। ব্রিসবেনে সেই ক্যাম্প আয়োজনের প্রস্তাব বিসিবিকে দিয়েছিলেন হাতুরুসিংহেই। হোমে এক সময় সীমিত ওভারের ম্যাচে বাংলাদেশ দলের কমন রেসিপিতে প্রাধান্য পেত স্পিনাররা। যেখানে ২ পেস বোলারের বেশি একাদশে রাখার যুক্তি খুঁজে পেতেন না নির্বাচকরাও। এখন সেখানে সীমিত ওভারের ম্যাচে একাদশে ৪ পেস বোলার আর বিস্ময় নয়। আর স্পিন সহায়ক পিচের পরিবর্তে মীরপুর শের-ই-বাংলার পিচকে পার্থ বানিয়ে ফেলাও বিচিত্র কিছুই নয়। ব্রিসবেন থেকে যে যাত্রা শুরু করেছে, তাকে ব্যাকফুটে খেলার সাহসটা ব্যাটসম্যানদের যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে তাতে পেস সহায়ক উইকেটকেই এখন আদর্শ মনে করছেন হাতুরুসিংহে। ওয়ানডে সিরিজে পাকিস্তান, ভারত, দ.আফ্রিকাকে হারিয়ে এশিয়া কাপে যেভাবে খেলছে বাংলাদেশ দল, তাতে ঘরের বাঘকে ঘরের বাইরেও ব্যাঘ্ররূপে দেখতে চান হাতুরুসিংহে।নিউ সাউথ ওয়েলস এবং সিডনি থান্ডার্সে ৪ বছর কাটিয়ে নিজের শরীর থেকে যেন শ্রীলঙ্কার নাম গন্ধ মুছে ফেলে হাতুরুসিংহে হয়ে গিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান! অস্ট্রেলিয়ানদের মতোই পেশাদার মানসিকতায় গড়ে তুলছেন দলকে। ইতিবাচক মানসিকতা ধারণ করে একটার পর একটা বিস্ময় ছড়াচ্ছে ক্রিকেটাররা। এশিয়া কাপের এই আসরটি টি-২০ ফরম্যাটের বলে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড তো দূরের কথা মাশরাফিও আহামরি স্বপ্ন দেখাতে চাননি। অথচ, টি-২০’র র‌্যাঙ্কিংয়ের ১০ নম্বরে থাকা দলটিই কিনা এশিয়া কাপের ফাইনালিস্ট! আসরকে সামনে রেখে মাশরাফিদের কাছে এটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও এমন সম্ভাবনাই দেখেছেন হাতুরুসিংহে।
অংশগ্রহণ নয়, চোখটা তার ট্রফিতে, জানিয়ে দিয়েছিলেন তা মিডিয়াকে। পাকিস্তানের বিপক্ষে অলিখিত সেমিফাইনালের আগে তো বলেই ফেলেছেন, “ আমরা এখন যা অর্জন করেছি,আগে তা পারিনি। শ্রীলঙ্কাকেও তো আগে কখনও টি-২০তে হারাতে পারিনি। আমরা এখন নুতন অনেক কিছু অর্জন করতে চাই।” ইতিবাচক মানসিকতায় বদলে দেওয়া বাংলাদেশ দলের এই কোচ তাই মাশরাফিদের সঙ্গে হাত রাখতে চান ট্রফিতে।

অন্য বিষয়গুলি:

bangladesh cricket haturi singha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy