না ফেরার দেশে চলে গেলেন ফুটবল কিংবদন্তি। — ফাইল চিত্র।
কয়েক বছর আগের কথা। একটু রাতের দিকে পেলে গাড়িতে বাড়ি ফিরছিলেন। নির্জন পথে কয়েক জন ছিনতাইকারী তাঁর গাড়ি আটকায়। পেলেকে তারা দেখতেও পাচ্ছিল, চিনতেও না পারার কথা নয়। পেলে নিজেই বিস্মিত হয়ে চেঁচিয়ে বলেছিলেন, ‘‘তোমরা এ সব কী করছ! আমি পেলে!’’ কিন্তু ছিনতাইবাজেরা তাতে ক্ষান্ত হয়নি, তবে বোধহয় পেলের সম্মানে অল্পের উপরে ছেড়ে দেয়। পেলে নিজেই খবরটি সংবাদমাধ্যমে দিয়েছিলেন। তাঁর বিস্ময়, তিনি পেলে, কিংবদন্তি পেলে, এটা জেনেও ছিনতাইবাজেরা তাঁকে পুরোপুরি রেহাই দেয়নি! কিছু টাকাপয়সা কেড়ে নিয়ে গিয়েছিল। তাতে পেলের আর্থিক ক্ষতি বিশেষ হয়নি, ক্ষতি হয়েছিল দেশবাসীর প্রতি আস্থায়। সারা পৃথিবী যাঁকে মাথায় করে রাখে, সেই মানুষের উপরে হামলা করতে পাষণ্ডেরাই পারে। আরও বিস্ময়ের কথা, ছিনতাইবাজেরা ব্রাজিলেরই লোক।
কিছু কাল আগে কলকাতায় এসেছিলেন পেলে। তাঁর সঙ্গে দেখা করার একটা আমন্ত্রণ আমিও পেয়েছিলাম, নেতাজি ইন্ডোরে। একটি সংস্থার পক্ষ থেকে উনি কয়েক জনকে সংবর্ধনা দেবেন। সেই তালিকায় আমারও নাম ছিল। গিয়ে দেখলাম, কোমর আর পায়ের ব্যথার জন্য উনি স্বাভাবিক ভাবে চেয়ারে বসতে পারছেন না। দুটো চেয়ার জুড়ে নিয়ে সেই দুটোর হাতলের উপরে বসেছেন। মাঠে যাঁর হরিণ-দৌড় দেখে আমাদের চোখের পলক পড়ত না, তাঁর ওই ক্লেশকর উপবেশন দেখে বড্ড কষ্ট হচ্ছিল। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর
সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন। ভারী আন্তরিকতার সঙ্গে জবাব দিচ্ছিলেন পেলে।
অবশেষে ডাক পেয়ে স্টেজে উঠলাম। যখন করমর্দন করছিলাম পেলের সঙ্গে, তখন মনে হয়েছিল, এটা বোধহয় সত্যি ঘটছে না। সেই কবে থেকে এই লোকটার দু’টো জাদুকরী পা আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে! বাস্তব বলেই তো মনে হত না। মনে হত, দু’টো পা যেন সবুজ মাঠে স্বরলিপি রচনা করে চলেছে।
একা পেলে কখনও পেলে হতে পারেন না। তার জন্য আরও কয়েক জন পেলেকে দরকার হয়। তাঁরা হয়তো ছোট ছোট পেলে, কিন্তু তাঁরাও একই সুরে-তালে বাঁধা। এক জন পেলেকে পেলে হওয়ার জন্য তাঁরাই তো প্ররোচিত করেন, বল এগিয়ে দেন, সাজিয়ে দেন। বোঝাপড়া করে, আঁক কষে, ছক বেঁধে এমন সেই খেলা, যেন ফুটবল নয়, মাঠে কয়েক জন পা দিয়ে কবিতা লিখছে। ব্রাজিল সেই যে মায়াঞ্জন পরিয়ে দিয়েছিল চোখে, আজও সেই সম্মোহন থেকেবেরোতে পারিনি।
বিশ্বকাপ ফাইনাল। ইটালি বনাম ব্রাজিল। খেলাটা আজও যেন চোখে ভাসে। পেলেকে আটকানোর জন্য ইটালি ছল ও বল, দুটোই প্রয়োগ করবে, এ তো জানা কথা! যেমন, মারাদোনাকে বিপক্ষের খেলুড়েরা বরাবর মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছেন। বড় খেলোয়াড়দের কপাল এ রকমই, মারধর খেয়েই তাঁদের খেলে যেতে হয়। পেলেকেও সেই অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছিল। বল ধরলেই ঘেরাও হয়ে যাচ্ছিলেন। বিপক্ষের একাধিক খেলোয়াড় ট্যাকল করছিলেন তাঁকে, তবু তার মধ্যেই বল ধরে সামান্য পরিসরেও অসামান্য নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। ব্রাজ়িল বেশির ভাগ সময়েই ছোট পাসে খেলে। বল যেখানে, সেখানেই ব্রাজিলের খেলোয়াড়। যেখানেই ব্রাজিলের খেলোয়াড়, সেখানেই বল। অন্তহীন, নির্ভুল পাস খেলতে খেলতে আচমকা একটা পাগলাটে গতিতে বল নিয়ে কেউ এক জন ছুটতে থাকেন, ফাইনাল পাস বাড়ান এবং কোনও দুরূহ কোনা থেকে যে গোল হয়ে যায়, তা বোধগম্য হয় না। সেই দিনও তা-ই হয়েছিল। পেলে একটা গোল নিজে করেছিলেন, আর একটা করিয়েছিলেন। চার গোলে জিতেছিল ব্রাজিল। সাংবাদিকেরা পেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, জয় সম্পর্কে আপনি কখন নিশ্চিত হন? উত্তরে পেলে একটু হেসে বলেছিলেন, চার গোল হওয়ার পরে। অর্থাৎ, তিন-তিনটে গোল হওয়ার পরেও ম্যাচ জেতা তাঁর কাছে নিশ্চিত ছিল না।
আজকাল গুগল সার্চের কল্যাণে সবাই সব কিছু জেনে যায়, নতুন কিছু জানানোর থাকে না। তবু লেভ ইয়াসিনের বিরুদ্ধে ক্ষুরধার বুদ্ধির যে গোলটি করেছিলেন, তা এই গ্রহের অধিবাসীরা ভুলবেন কী করে!সে-ও ব্যাকভলি এবং বাইসাইকেল কিকের সমাহার, কিন্তু এত ছন্দোময় যে, বার বার রিপ্লে দেখতে ইচ্ছে হবে। একটা ম্যাচের কথা মনে পড়ে। পেলে চোট পেয়ে মাঠের বাইরে গেছেন, কিন্তু ব্রাজিল তাঁর পরিবর্ত নানামিয়ে দশ জনে খেলতে লাগল। একটু পরে বিপক্ষের হাফলাইনের একটু ভিতরে যখন ব্রাজিল ফ্রি-কিক পেল, তখন সামান্য খুঁড়িয়ে পেলে নামলেন সেই কিক নিতে। বানানা কিকে গোল হয়ে গেল। এ সব ঘটনা কি ভোলা যাবে কখনও?
আস্তে আস্তে বিশ্ব ফুটবলের খোলনলচে বদলে যাচ্ছে। পেলের সিংহাসন ধরে ঝাঁকিয়ে দিচ্ছেন মারাদোনা, মেসি, রোনাল্ডো।অতীতে ছিলেন জর্জ বেস্ট। কেউ কারও চেয়ে কম যান না। এই যে নবোদিত তারকা এমবাপে, এ-ও কি কম নাকি?
তবু পেলে পেলেই। পেলের মতো আর এক জন হয় না। তিনি জর্জ বেস্ট বা মারাদোনা বা মেসি বা রোনাল্ডো বা এমবাপের মতো খেলতেন না। কেউ কারও মতো খেলেন না। যে যাঁর নিজের মতোই খেলেন। আমি নিজে এঁদের সকলেরই প্রবল ভক্ত। তবু পেলেকে আমি এক নম্বর হলেওবেশি দেব। ওটা, ধরে নেওয়া যাক, আমার পক্ষপাত।
তাঁর নিষ্ক্রমণে পৃথিবী অনেক নিষ্প্রভ হয়ে গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy