Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
PK-Chuni-Balaram

পিকে-চুনী-বলরাম! ময়দানের কিংবদন্তি ত্রয়ীর তিন জনেই চলে গেলেন ইতিহাসের পৃষ্ঠায়

পিকে, চুনী আগেই প্রয়াত হয়েছেন। এ বার প্রয়াত তুলসীদাস বলরাম। ভারতীয় ফুটবলে একটি যুগের অবসান হল। আরও খানিকটা দরিদ্র হয়ে গেল ময়দানের ফুটবল।

Picture of Chuni Goswami PK Banerjee and Tulsidas Balaram

এক ফ্রেমে চুনী, পিকে, বলরাম। তিন বছরের ব্যবধানে প্রয়াত হলেন তিনি কিংবদন্তি ফুটবলার। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ

দেবার্ক ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৬:৪৩
Share: Save:

চলে গেলেন তুলসীদাস বলরাম। ভারতীয় ফুটবলে একটি যুগের অবসান। প্রথমে পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়, তার পরে চুনী গোস্বামী, শেষে বলরাম। একে একে চলে গেলেন ত্রয়ী। পুরাণে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর কিংবা বলিউডের অমর-আকবর-অ্যান্টনি— যখনই কোনও ত্রয়ীর কথা উঠেছে, ফুটবল পাগল বাঙালি এই ত্রয়ীর কথাও বলেছেন বার বার। পিকে-চুনী-বলরাম। সেই ষাটের দশক থেকে আজও বাংলার তথা ভারতীয় ফুটবলের হৃদয়ে থেকে গিয়েছেন। থেকে যাবেনও চিরকাল। মৃত্যুও ম্লান করতে পারবে না তাঁদের অনুপস্থিতি।

হায়দরাবাদ থেকে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন বলরাম। এই শহর তাঁকে দিয়েছে ভালবাসা, সম্মান। তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলা তথা ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম বড় ‘সুপারস্টার’। আর সেই যাত্রায় তিনি পাশে পেয়েছিলেন আরও দু’জনকে। এক জন পিকে। অন্য জন চুনী। আর এই পিকে-চুনীর সঙ্গে ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা ত্রয়ী হয়ে উঠেছিলেন দক্ষিণ ভারত থেকে আসা তরুণ বলরাম।

খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে উত্তরপাড়ায় থাকতেন বলরাম। গঙ্গার ধারে একটি আবাসনে একাই থাকতেন। মনের মধ্যে হয়তো ছিল কিছুটা অভিমান। ভারতীয় ফুটবল তাঁকে প্রাপ্য সম্মান দেয়নি। তাঁর সমসাময়িক ফুটবলারেরা যে খ্যাতি ও সম্মান পেয়েছেন তার ধারেকাছেও ছিলেন না বলরাম। ১৯৬২ সালে অর্জুন পুরস্কার ছাড়া আর কোনও ‘সম্মান’ পাননি তিনি। শেষ জীবনে তাঁর খোঁজখবর নেওয়ার মানুষজনও অনেক কমে গিয়েছিল। কিন্তু বলরাম পেয়েছিলেন দর্শকদের ভালবাসা। সেটাকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে ছিলেন তিনি। সেটা আঁকড়ে ধরেই চলে গেলেন।

পিকে-চুনী-বলরাম কিন্তু ক্লাব ফুটবলে একসঙ্গে খেলেননি। বলরাম বাংলায় পা রাখার পর হয়ে উঠেছিলেন ইস্টবেঙ্গলের নয়নের মণি। পরে সাউথ ইস্টার্ন রেলের হয়ে খেলেছেন। চুনী আবার চিরকাল প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব মোহনবাগানের ঘরের ছেলে হয়েই রয়ে গিয়েছেন। আর পিকে কোনও দিন বড় দুই প্রধানে খেলেননি। খেলেছেন ইস্টার্ন রেলের হয়ে। এক ক্লাবে না খেললেও তাঁদের মধ্যে ছিল বন্ধুত্ব। আর সেটা ছিল দেশের জন্য। বিশ্ব ফুটবলের মানচিত্রে ভারতকে তুলে ধরার জন্য। সেটা করেও ছিলেন।

১৯৫৬ থেকে ১৯৬৩ সাল— এই ৭ বছর ছিল ভারতীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগ। আর তা হয়ে উঠেছিল এই ত্রয়ীর জন্যই। এমন ফরোয়ার্ড লাইন, যা যে কোনও দলকে চিন্তায় ফেলে দিত। চুনী ছিলেন বাঁ দিক থেকে ইনসাইডের ফুটবলার। পিকে আবার বাঁ দিক থেকে আউটসাইডে খেলতেন। আর বলরাম ছিলেন ডান দিক থেকে আউটসাইডের ফুটবলার। স্ট্রাইকার পজিশনে খেললেও তিন জনের খেলার পদ্ধতি ছিল আলাদা। তাই এ রকম বৈচিত্র ছিলে তাঁদের খেলায়। চোখ বন্ধ করে একে অন্যকে পাস বাড়াতেন তাঁরা।

পিকে-চুনী-বলরামের দাপটে সেই সময় উড়াল নিয়েছিল ভারতীয় ফুটবল। ১৯৬২ সালের জাকার্তা এশিয়াডের ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে সোনা জিতেছিল ভারত। ’৫৬ সালে মেলবোর্ন ও ’৬০ সালে রোম অলিম্পিক, মারডেকা কাপ সব জায়গায় নজর কেড়েছিল ভারত। আর তা হয়েছিল এই ত্রয়ীর দাপটেই।

মাত্র ২৭ বছর বয়সে ফুটবল থেকে সরে যেতে হয়েছিল বলরামকে। ফুসফুসের সমস্যা থাকায় আর খেলতে পারেননি। বিয়ে করেননি আজীবন। কিন্তু বাংলা ছেড়ে যাননি। ২০২০ সালের ২০ মার্চ প্রয়াত হয়েছিলেন পিকে। সেই বছরই ৩০ এপ্রিল প্রয়াত হয়েছিলেন চুনী। পিকের মৃত্যুর কয়েক মাস আগে শেষ দেখা হয়েছিল তাঁদের। ভারতীয় দলের প্রাক্তন কোচ সৈয়দ আব্দুল রহিম (রহিম সাহেব)-কে নিয়ে বলিউডে একটি সিনেমা তৈরি হচ্ছে। তার রিসার্চ টিমের ডাকেই সল্টলেকের একটি বিলাসবহুল হোটেলে গিয়েছিলেন পিকে-চুনী-বলরাম। নিজেদের ‘গুরু’র ব্যাপারে কথা বলতে। সেখানে পিকে-চুনীকে দেখে ‘চিনতে পারেননি’ বলরাম। পরে জানিয়েছিলেন, যাঁদের সঙ্গে ময়দানের সবুজ ঘাসে দাপট দেখিয়েছেন, তাঁদের হুইল চেয়ারে আসতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। সেই তিন জনের শেষ দেখা।

চুনী মোহনবাগানে ও বলরাম ইস্টবেঙ্গলে থাকলেও দু’জনের লড়াই ছিল মাঠে। তবে তাঁরা শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন অভিন্নহৃদয় বন্ধু। তুলসীদাসকে ‘বলা’ বলে ডাকতেন চুনী। সেই সময় ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান খেলা শেষে খেলোয়াড়েরা একে অন্যের তাঁবুতে যেতেন। সেটাই রেওয়াজ ছিল। ইস্টবেঙ্গল জিতলে মোহনবাগান তাঁবুতে গিয়ে চুনীকে জড়িয়ে ধরতেন বলরাম। চুনী তাঁকে ঠান্ডা পানীয় খাওয়াতেন। আবার চুনীকেও তাঁদের তাঁবুতে নিয়ে এসে ঠান্ডা পানীয় খাওয়াতেন বলরাম। পিকে-চুনী-বলরামকে নিয়ে বাংলা আধুনিক গানও তৈরি হয়েছে। তাঁদের বন্ধুত্ব এতটাই পরিচিত ছিল। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে চলে গেলেন তিন বন্ধু। আরও খানিকটা দরিদ্র হল বাংলা তথা ভারতের ফুটবল।

অন্য বিষয়গুলি:

PK Chuni Goswami tulsidas balaram Indian Football
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy