অন্তরঙ্গ। বুধবার সাউথ ক্লাবে নরেশ কুমার-লিয়েন্ডার পেজ। -শঙ্কর নাগ দাস
গুরুর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে উঠে শিষ্য শুরুতেই হেরে বসলেন আবেগের কাছে! যে শিষ্যের সিগনেচার শট-ই কিনা শেষ পয়েন্ট পর্যন্ত মরণপণ লড়াই। ফোরহ্যান্ড ডাউন দ্য লাইন নয়, ড্রপ ভলি নয়। ব্যাকহ্যান্ড ক্রসকোর্ট নয়। তার বদলে চিরলড়াকু মানসিকতা। সে ষোলো বছরে ডেভিস কাপ অভিষেকেও তাই। আর বিয়াল্লিশে গ্র্যান্ড স্ল্যামের ইতিহাসে সবচেয়ে বয়স্ক প্লেয়ার হিসেবে খেতাব জেতাতেও তাই।
কিন্তু এখানে লিয়েন্ডার পেজকে যে নরেশকুমার নিয়ে বলতে হচ্ছে। তাও সাউথ ক্লাবের কোর্টে দাঁড়িয়ে। তাঁর ‘নরেশ স্যার’, ‘নরেশ আঙ্কল’, ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’, ‘ফরএভার গাইড’-কে নিয়ে বলছেন। সেটাও আবার নিজের টেনিস আঁতুরঘরে বসে! ‘‘আমার কিন্তু আজ বলতে গিয়ে এতটাই আবেগী হয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে যে পকেটে রুমালের সঙ্গে একটা তোয়ালেও নিয়ে এসেছি,’’ বুধ-সন্ধ্যায় ফ্লাডলাইটের আলোয় ভেসে যাওয়া সাউথ ক্লাবের তিন নম্বর কোর্টের ডানদিকের বেসলাইনে পাতা মঞ্চে লিয়েন্ডারের বক্তৃতা শুরুই হল নরেশকুমার নামক মহাআবেগকে ওয়াকওভার দিয়ে।
অথচ তার পরেই বলতে উঠে সাতাশির অশীতিপর স্বয়ং নরেশ পোডিয়ামের দিকে ধীর পায়ে এগোনোর সময় রুমালের খুটে চোখের কোনটা একবার মুছে নিলেও বক্তৃতার প্রায় আগাগোড়া ‘সেন্স অব হিউমারে’ ভাসিয়ে দিয়ে গেলেন প্রিয়তম শিষ্যের একটু আগে তৈরি আবেগের ভারী আবহকে। যে অসাধারণ রসবোধ উচ্চবিত্ত, প্রচণ্ড মর্যাদাসম্পন্ন নরেশের বরাবরের। ভারতের অসাধারণ সব ডেভিস কাপ জয়ে নন প্লেয়িং ক্যাপ্টেন হিসেবে তাঁর চমকপ্রদ গেমপ্ল্যানের মতোই।
দর্শকাসনে প্রথম সারিতে বসা আখতার আলির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘লিয়েন্ডারকে আমার ডেভিস কাপ দলে প্রথমবার দেখে এই আখতার আমাকে কী বলেছিল জানেন? ‘ওহ! লড়কা কা হাঁটনে কা কেয়া স্টাইল হ্যায়!’ কী আখতার, মনে আছে তোমার?’’
ভারতীয় টেনিসের সর্বকালের সেরা তিন জন কেন, প্রথম পাঁচ জন প্লেয়ারের তালিকা করতে বসলেও তীব্র টেনিস রোম্যান্টিকও হয়তো নরেশকুমার নামটা লিখবেন না। কিন্তু ভারতীয় টেনিসের দ্রোণাচার্য কে বলতে বললে গতকালই সাউথ ক্লাবে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীও সঠিক উত্তর দিয়ে দেবে— নরেশকুমার। লিয়েন্ডারের প্রথম ডেভিস কাপ ক্যাপ্টেন। এবং সেই গুরুর কী অসাধারণ প্রভাব শিষ্যের উপর যে, মাত্র ষোলো বছরে চণ্ডীগড়ে নিজের প্রথম ডেভিস কাপ খেলতে পৌঁছে নরেশকে প্রথম কী পোশাকে দেখেছিলেন, ছাব্বিশ বছর পরেও হুবহু মনে আছে লিয়েন্ডারের। ‘‘সাদা প্যান্ট, সাদা শার্ট, নীল স্ট্রাইপ করা সাদা জ্যাকেট পরেছিলেন সে দিন নরেশ স্যার। পায়ে সাদা টেনিস শ্যু।’’
আজও স্পষ্ট মনে আছে, প্রথম সাক্ষাতে কী করেছিলেন গুরু তাঁর ভবিষ্যতের ভেরি ভেরি স্পেশ্যাল শিষ্যকে নিয়ে। ‘‘নরেশ আঙ্কল আমাকে নিয়ে লম্বা একটা হাঁটা লাগিয়েছিলেন স্টেডিয়ামের চারধারে। আমাদের দু’জনের সেই ‘ওয়াক’ গতকাল শুধু এই অনুষ্ঠানটার জন্য কলকাতায় পৌঁছে নরেশ আঙ্কলের সঙ্গে ডিনারের পরেও হল। আর তাতেও সেই ছাব্বিশ বছর আগের সেই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সামনের টেনিস রোডম্যাপ দিয়ে দিলেন আমাকে। বিশেষ করে অলিম্পিক্সের জন্য রোডম্যাপ।’’
এ দিনের আগে কত জনই বা জানতেন যে, নব্বইয়ে মাত্র ষোলো বছরের লিয়েন্ডারকে দেশের হয়ে খেলাতে নরেশকুমার নন প্লেয়িং ক্যাপ্টেনশিপ ছেড়ে দেওয়ারও হুমকি দিয়েছিলেন এআইটিএকে? ‘‘আর আমি জিশানের সঙ্গে পার্টনারশিপে আমার প্রথম ডেভিস কাপ ম্যাচের ফিফথ্ সেট ১৮-১৬-এ জেতার পর নরেশ স্যার আমাকে যে আইসক্রিম খাইয়েছিলেন সেটা আমার বরাবরের সবচেয়ে প্রিয় ডেজার্ট। ফরাসি। কিন্তু উনি কী ভাবে সেটা জেনেছিলেন আমি আজও জানি না। তার বছর তিনেক পরে ফ্রেজুতে ফ্রান্সকে সেই ঐতিহাসিক ডেভিস কাপ টাইয়ে আমরা হারানোর পরেও উনি আমাকে সেই ডেজার্ট খাওয়ান।’’
এ দিন দর্শকাসনে বসা বাবা-মা ভেস পেজ-জেনিফারের সামনেই নরেশকুমারকে তাঁর জীবনের সর্বত্তম অনুপ্রেরণা বলে দিলেন লিয়েন্ডার। অনুষ্ঠানের পরে আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্তে কথা বলার সময়ও বললেন, ‘‘রিওর মোটিভেশনের জন্য এখনই আমার হোয়াটস্অ্যাপে ছিয়ানব্বই আটলান্টা অলিম্পিক্সে আমার ব্রোঞ্জ জেতার ম্যাচ ডাউনলোড করেছি। এখনই দেখতে ইচ্ছে করলে পকেট থেকে মোবাইল বার করে দেখতে পারি। কিন্তু সেটাও নরেশকুমারের থেকে বেশি অনুপ্রেরণা হবে না।’’
দ্রোণাচার্য আবার তাঁর অর্জুন-এর সেরা সম্পদ কী জানাতে গিয়ে বলে দিলেন (কাকতালীয়ই হয়তো, নরেশের ছেলের নামও অর্জুন), ‘‘ওর বিরাট স্বপ্নকে সফল ভাবে তাড়া করার বিরল ক্ষমতা। নব্বইয়ে জুনিয়র অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে খারাপ খেলে ফেরার পর আমার বাড়ি এলে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, এ বার উইম্বলডনে কী করবে? অবলীলায় লিয়েন্ডার বলেছিল, চ্যাম্পিয়ন হব। আমি আর সুনীতা (স্ত্রী) তাজ্জব হয়ে চোখাচোখি করছি। কিন্তু সে বার ও-ই জুনিয়র উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।’’
আর তিনি নরেশকুমার নিজের খেলোয়াড়জীবনে? ‘‘আমারটায় ট্রফির চেয়ে মজা বেশি। অমৃতসরে একবার ডাবলসে দু’জন যমজ পঞ্জাবি ভাইয়ের বিরুদ্ধে খেলছিলাম। ম্যাচের প্রায় শেষের দিকে বুঝলাম, আমাদের টিমকে ওদের একজনই সার্ভ করছে। জানতে চাওয়ায় সে অবলীলায় বলল, আমার যমজ ভাইয়ের হাতে ব্যথা তো। তাই ওর সার্ভটাও আমি করছি। জানতাম, চিনতে পারবে না।’’ আর একবার ইলাহাবাদে মিক্সড ডাবলসে বিপক্ষের মেয়ে প্লেয়ারকে সার্ভ করার সময় আগাগোড়া টেনিস বলটা ড্রপ দিয়ে শেষ সেকেন্ডে হাতে লোকানো পেয়ারা আলতো করে সার্ভ করেন নরেশ। আর সেই বিদেশিনীর রিটার্ন? নরেশের কথায়, ‘‘একেবারে ধোনির হেলিকপ্টার শটের মতো হয়েছিল। পুরো কোর্ট পেয়ারার টুকরোয় ভর্তি।’’
অসাধারণ টেনিস-সন্ধ্যায় মঞ্চে অনেক নক্ষত্র থাকলেও চুনী গোস্বামীকে না বসানোটা যা একটু বেমানান। কিন্তু নরেশের শেষ কথায় ‘গেম, সেট অ্যান্ড ম্যাচ টু সাউথ ক্লাব।’ ‘‘এতক্ষণ আমার পিছনে যে দাঁড়িয়ে আমার কথা শুনছে সে সতেরোটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছে। কিন্তু আজ আমি যে গ্র্যান্ড স্ল্যামটা জিতলাম সেটা পায়নি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy