হ্যালো
অনিরুদ্ধ চাকলাদার
নব্বইয়ের দশকের ফ্যাশন বলতেই যে রকম পোশাকআশাক বা সাজগোজ আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সেটা কিন্তু শুরু হয়েছিল আশির শেষে। এ বার, আমাদের দেশে ফ্যাশনটা অনেকটাই ঠিক করে দেয় বলিউড। বিদেশে এই চলটা নেই। হলিউডে ছবির চিত্রনাট্য যেমনটা দাবি করে, ছবির চরিত্ররা ঠিক তেমন পোশাক পরেন। ফলে ‘পপুলার কালচার’-এ সেই ফ্যাশনের প্রভাব পড়ে কম। ভারতে ঘটনাটা আলাদা। এখানে নায়ক-নায়িকারা পরদায় যা পরছে, সেটাই রাস্তাঘাটে অনুকরণ করে মানুষ।
তা, নব্বইয়ের বলিউডের ফ্যাশন ছিল প্রচণ্ড চড়া দাগের। ভীষণ ভীষণ উগ্র। অমার্জিত। পোশাক বা মেক-আপ— সব কিছু অদ্ভুত রকম ঝলমল করত। তখনকার নায়িকারা ঠোঁটে অরেঞ্জ, পিংক, মেরুন রঙের গ্লসি লিপস্টিক লাগাতেন। আইলাইনার, আইশ্যাডোতেও রঙের প্যালেটটাই উপুড় করে দেওয়া হত। মুখটা কী চকচক করত সব সময়! উদাহরণে শুধু করিশ্মা কপূরের কথাই বা বলব কেন, মাধুরী দীক্ষিত, জুহি চাওলাও তো একই রকম রংচঙে মেক-আপ করতেন। ‘অঠরা বরষ কি কঁয়ারি কলি থি’ বা ‘লাল লাল হোঁঠোঁ পে গোরি কিসকা নাম হ্যায়’ গানগুলো জাস্ট ভেবে দেখুন। তুলনায় বরং রবিনা ট্যান্ডনই যা একটু ছিমছাম সাজতেন। ‘তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত’-এর মতো ধুঁয়াধার গানেও ওঁকে কিন্তু খুব ভারী কিছু মেক-আপে দেখা যায়নি।
নব্বইয়ের চুলের স্টাইলও বেশ ইন্টারেস্টিং। এখন সে সময়ের সিনেমা, ম্যাগাজিন কভার দেখলে তারকাদের চুল দেখে মনে হতে পারে পাখির বাসা। কিন্তু তখন গোটা ভারত অমন ঝোপঝাড়ের মতো এলোমেলো চুলই পছন্দ করত। কেয়ারফুলি কেয়ারলেস মেস্ড-আপ লুক। ঘেঁটে দেওয়া চুল, এক দিকের শার্ট গোঁজা, এক দিক বেরিয়ে। শাহরুখকে এ ভাবেই দেখা যেত বিলবোর্ডে। সঞ্জয়-সলমনকে দেখে ছেলেরা রাখত ঘাড়-ছাপানো লম্বা চুল। আমির-শাহরুখকে দেখে মাঝখানে সিঁথি। আর নায়করা ওয়াক্স করতেন না মোটে। অনিল-অক্ষয়ের রোমশ ‘কর্কশ পুরুষ’-এর লুক হইহই করে চলত। এখন ভুরু কুঁচকে লাভ নেই। যে সময়ের যা।
৫ অগস্ট ১৯৯৪। মুক্তি পেয়েছিল ‘হম আপকে হ্যায় কৌন’। তার পরেই,
কমবয়সি মেয়েরা বিয়েবাড়ির পোশাক বলতে বুঝত মাধুরীর সবুজ লহেঙ্গা
আশির দশকের শেষে ডিম্পল কাপাডিয়ার দেখাদেখি চুলের ‘লেয়ারিং’ খুব জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু সবার তো আর ডিম্পলের নায়াগ্রা জলপ্রপাতের মতো চুলের ভাগ্য থাকে না। ফলে ওই থাকথাক লেয়ার কাটে অনেককেই মানাত না। তার পর নব্বইয়ে এল পার্মিং। ’৯৪ নাগাদ আবার সুস্মিতা সেন ভীষণ জনপ্রিয় করলেন হাই পনিটেলের স্টাইল। চুলে তখন খুব রং করতেন হিরো-হিরোইনরা। ‘সূর্যবংশী’র সলমনকে মনে আছে? সোনালি রং ছিল চুলে! তাতে আবার হেয়ার ব্যান্ড! চুলটা অবশ্য আসলে ‘উইগ’, কিন্তু সে আর কে বুঝছে?
কাঁধের কাছে অল্প প্যাড দেওয়া ব্যাগি জামা পরতেন হিরোরা সে সময়। জামাকাপড়ে থাকত চকরাবকরা প্রিন্ট। ‘লড়কি হ্যায় কেয়া রে বাবা’র অনিল কপূর, ‘আন্দাজ অপনা অপনা’-র আমির সলমনকে দেখবেন। হাই-ওয়েস্ট ডেনিম বা প্লিটেড ট্রাউজার্স ওঁরা সকলেই পরতেন। ফোলা-হাতা প্রিন্টেড ব্যাগি সোয়েটার শুধু ঋষি কপূরই নয়, সইফও পরেছেন অনেক বার। নায়িকাদের জন্য ছিল ধোতি সালোয়ার আর ছোট ঝুলের কুর্তা। দিব্যা ভারতী পরেছেন, পরেছেন মাধুরী। ‘দেখা হ্যায় পহেলি বার’ গানটা আর তার নাচের স্টেপটা সুপারহিট করল, আর তার সঙ্গে সাইডে ওড়না দেওয়া মাধুরীর ফ্যাশনও বাম্পারহিট। ‘তম্মা তম্মা লোগে’ গানটা থেকে উঠল শাইনি লেদার প্যান্টস। ‘হম আপকে হ্যায় কৌন’-এ মাধুরী জনপ্রিয় করেছিলেন সবুজ লহেঙ্গা, লেসের ফ্রক। কাজল তখন প্রতি সিনেমায় এক বার করে শার্ট গুঁজে ডেনিমের সঙ্গে হাই-অ্যাংক্ল বুট পরবেনই। ‘বাজিগর’-এর ক্লাইম্যাক্স, ‘গুপ্ত’-এর চাক্কু মারার সিন, ‘হলচল’— সব জায়গায়।
দু-একটা ব্যাপার অতি চমকদার নব্বইকেও বেজায় চমকে দিয়েছিল। সলমন আর সোনালি বেন্দ্রের ডেনিম মাইক্রো-শর্টস আর গোবিন্দার ডাংরি। অ্যাকসেসরিতেও প্রচুর দেখনদারি এসেছিল। রিস্টলেট-এ চেনের মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট টুংটাং, চওড়া বেল্ট, গোল ফ্রেমের সানগ্লাস, শ্রীদেবীর প্লাস্টিক দুল, শাহরুখের ‘বাজিগর’ চশমার কালো ফ্রেম, ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড, COOL চেন। ‘খিলাড়িয়োঁ কা খিলাড়ি’র সময়ের রেখার নকল, নকশা-কাটা, তিন ইঞ্চি লম্বা নখ।
চাকাটা ঘুরল ’৯৭-’৯৮ নাগাদ। প্রথম নিজেকে বদলে ফেললেন করিশ্মা। ‘রাজা হিন্দুস্তানি’তে। ভুরু প্লাক করা, চুল স্ট্রেট। তার পর ‘দিল তো পাগল হ্যায়’, ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’ থেকে পুরো ফ্যাশনটাই বদলে গেল। আগে সিনেমায় থাকতেন শুধু কস্টিউম ডিজাইনার। এ বার আস্তে আস্তে নতুন নতুন ফ্যাশন ডিজাইনার, তার পর আনাইতা শ্রফ আদজানিয়া-র মতো স্টাইলিস্টরা এলেন বলিউডে। এমনকী ‘গ্যাপ’, ‘ডিকেএনওয়াই’, ‘পোলো’র মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডও হইহই করে ঢুকে পড়ল টিনসেল টাউনে। তাই ২০০০ সাল থেকেই গল্পটা অন্য রকম।
কিন্তু নব্বইয়ের ফ্যাশনকে ‘ডিজাস্টার’ বলে এত চোটপাট কেন? সেই সময়ে তো এই ফ্যাশন আমাদের এতটা উৎকট লাগত না! এখন ফিরে দেখলে, একটু ‘শক’ লাগে সত্যি। কিন্তু, চাহিদা ছিল বলেই, মানুষ ভালবেসেছে বলেই তো এ সব ফ্যাশন দিনের পর দিন চলেছে। মনে আছে, আমারও ছিল ও-রকম লুজ স্যুট, পরলেই নিজেকে খুব সুন্দর বলে মনে করতাম। মা কত কষ্ট করে প্যাটার্ন শিখে আমার জন্য একটা ব্যাগি সোয়েটার বুনে দিয়েছিলেন। এত যত্ন যার সঙ্গে জড়িয়ে, তাকে এত সহজে বাতিল করে দেওয়া যায়?
আসলে, সব কিছুর মূলেই সময়ের স্রোত আর পরিবর্তন। ‘ওয়ক্ত অপনা অপনা।’ আজ যাকে নিয়ে হইহল্লা, কালের নিয়মেই কাল সে দৃষ্টিকটু, গ্রাম্য। ফ্যাশন তো পরীক্ষানিরীক্ষার ওপর ভর করেই এগোয়, পালটায়, পুরনো স্টাইলই নতুন ট্রেন্ড হয়ে ফিরে ফিরে আসে। আমি ছোটবেলায় বেলবটম্স পরেছি, টিন-এজে টাইট জিন্স, নব্বইয়ে আবার ঘেরওয়ালা ডেনিম, তার পর স্কিন-ফিট... আপনাদের পছন্দও তো নিশ্চয়ই এ ভাবেই ঘুরেফিরে পালটে পালটে গেছে। তেমনি, আগামী দিনে নব্বইয়ের ফ্যাশনঘরানাও যে নতুন চেহারায় ফিরে এসে আবার বাজার মাত করবে না, কে গ্যারান্টি দিতে পারে?
anichakladar@gmail.com
নব্বইয়ের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 90s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in
আন্তর্জাতিক ভাষা সমীক্ষার রিপোর্টে বাংলাকে ‘মৃত ভাষা’ ঘোষণা করা হল। আবেগপ্রবণ বাঙালি অবশ্য আবেগতাড়িত না হয়ে এই খবরটাকে আর পাঁচটা সাধারণ খবরের মতোই নিয়েছে, কারণ বাঙালি অনেক আগেই তাদের ভাষার মুখাগ্নি করে দিয়েছিল। কয়েক দশক আগেই ভারত সরকারের ‘বি ইন্টারন্যাশনাল’ প্রকল্পের ছুতো দেখিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোতে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল। পরে বিক্ষোভের মুখে পড়ে সরকার ঘোষণা করে, সম্পূর্ণ অবৈতনিক ভাবে ওই স্কুলগুলোতেই আবার ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা চালু করা হবে। মধ্যবিত্ত উচ্চাভিলাষী বাবা-মা’রা এতে যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন। পয়সার অভাবে যে স্বপ্ন অধরা ছিল তা এত দিনে নাগালে এল। তাঁরা তখন সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এর পর যে প্রজন্ম সৃষ্টি হয় তাঁরা দোআঁশলা বাঙালি নামে পরিচিত। মা-বাবা বাঙালি হওয়ায় এঁরা সম্পূর্ণ ইংরেজ হতে পারেননি। কিন্তু এর ঠিক পরের প্রজন্মই পাক্কা ইংরেজে পরিণত হয়। এই সময়েই পশ্চিমবঙ্গে বিখ্যাত ভাষা বিদ্রোহের সূচনা হয়। স্কুল, কলেজ, স্টেশন, দোকান-বাজার, সিনেমা-সাহিত্যে বাংলা ভাষার ব্যবহার বন্ধের দাবিতে লাখ লাখ তরুণ-তরুণী পথে নামে ও দাবি করে, ‘যে ভাষা বুঝি না, জানি না, পাবলিক ফোরামে সেই ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে।’ (স্লোগান ছিল ইংরেজিতে)। ডাউনমার্কেট হওয়ার কারণে বাংলার গান, সিনেমা, সাহিত্যেও আর কেউ পয়সা ঢালতে রাজি হচ্ছিলেন না। আস্তে আস্তে বাংলা সংস্কৃতিটাই উঠে যায়। এর কিছু দিনের মধ্যে এই রিপোর্ট প্রকাশিত হল। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘যে কোনও মৃত্যুই দুঃখের।’ তাঁর নির্দেশে আগামী ১ এপ্রিল টেগোরোটোরিয়াম-এ (আগের নাম রবীন্দ্রসদন) বাংলা ভাষার স্মরণসভা আয়োজন করা হয়েছে। প্রাক্তন সাহিত্যিক, গায়ক, সিনেমা-পরিচালকরা সে দিন বাংলা ভাষাকে ফুলমালা দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানাবেন।
সৌত্রিক মুখোপাধ্যায়, শ্যামনগর
লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা: টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy