Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
কেউ অন্ধকার থেকে উঠে আসে অন্দরমহলের দিকে। তার সারা গায়ে গয়না। কিং‌বা এক ডাক্তারির ছাত্র। তার ঘরে টাঙানো কঙ্কাল। মৃত্যুতে শেষ হয়নি সে। কোথাও মৃতা প্রথম পক্ষ রাতচরা পাখির ডাকে প্রশ্ন করেছে, ‘ও কে? ও কে গো?’ টলে গেছে জমিদারের সাহস। রবীন্দ্রনাথের অশরীরী নায়িকারা বারবার ফিরে এসেছে অভিমান আর বিদ্রোহ নিয়ে।
Bengali Story

কবির নিশীথিনীরা

নিষ্ফলা প্রেমশূন্য জীবন আর অতর্কিত মৃত্যুও মণিমালিকার দুই চোখের অদ্ভুত সজীবতা কেড়ে নিতে পারেনি কখনও।

ছবি: কুনাল বর্মণ

ছবি: কুনাল বর্মণ

প্রমিতি চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২২ ০৫:৪৭
Share: Save:

ঘনঘোর বর্ষা। সকাল থেকেই অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে সন্ধের অন্ধকার আলাদা করে বোঝার জো নেই। চার দিকে কেবলই বৃষ্টির শব্দ, আর তারই মধ্যে ক্ষীণ স্বরে ভেসে আসছে গ্রাম্য যাত্রার গানের সুর। অঝোর বৃষ্টিতে মুছে গেছে পৃথিবী আর আকাশের মধ্যেকার ক্রন্দসী-সীমানা, হারিয়ে গেছে পরিচিত গ্রাম্য সন্ধের গতে-বাঁধা রোজনামচা, মিলিয়ে গেছে স্মৃতি আর বিস্মৃতির মাঝের অতিনিবিড় ব্যবধানটুকুও। চার দিকে শুধুই ঘনিয়ে আসা নৈঃশব্দ্য— অদ্ভুত অপ্রাকৃত আর গম্ভীর। তবে সেই নৈঃশব্দ্য যেন সবটুকু নীরব নয়। বাদলা হাওয়া, বৃষ্টির ছাঁট আর ঘন অন্ধকারের মধ্যে থেকে উঠে আসছে ভারী অন্য রকম একটা শব্দ। ঠিক যেন মেয়েলি গয়নার ঝমঝম শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শক্ত কাঠের ঠকঠক শব্দ। কে যেন এগিয়ে আসছে অলীক অন্ধকার পেরিয়ে, এগিয়ে আসছে এই বাড়ির দিকেই। ঘোর কালো কৃষ্ণপক্ষের রাত, চোখে ভাল ঠাহর হয় না বটে— কিন্তু তাতেও অনাহূত অতিথির দিশা চিনতে ভুল হয় না। এ বাড়ি যেন তার বহু দিনের চেনা। তাই দেউড়ি পেরিয়ে, অন্দরমহলের গোলসিঁড়ি বেয়ে ক্রমশ সে শব্দ এগিয়ে আসছে শোবার ঘরের বন্ধ দরজার দিকে। চার দিকে আর কোনও শব্দ নেই— রাতচরা পাখিরাও আজ বড় বেশি শান্ত, মধ্যরাতের বাদলা হাওয়াও হঠাৎ থমকে গেছে গা-ছমছমে আতঙ্কে। কেবল লম্বা ঢালাও বারান্দা পেরিয়ে এগিয়ে আসছে সেই শব্দ— ঠকঠক, ঝমঝম! না, আর দেরি নেই মোটেই। এই তো সে এসে দাঁড়িয়েছে বন্ধ দরজার ঠিক ও পারটিতে। এ বার কেবল চৌকাঠটি পেরোলেই হয়!

নিষ্ফলা প্রেমশূন্য জীবন আর অতর্কিত মৃত্যুও মণিমালিকার দুই চোখের অদ্ভুত সজীবতা কেড়ে নিতে পারেনি কখনও। সে দিনও শেষরাত্রির সদ্যোজাত চাঁদের অস্পষ্ট সাদা আলোয় ফণিভূষণ তাই খুঁজে পেয়েছিল আঠারো বছর আগেকার সেই ঘন কালো সুন্দর চোখের মণি দুটোই। তবে লম্বা, লম্বা পাতায় ঘেরা সেই চোখদুটোয় সে দিন আর নববধূর সলজ্জ, অপ্রতিভ চাহনি ছিল না, ছিল মৃত্যুর কাঠিন্য আর নিষ্ঠুর কৌতুক। মণিমালিকা ফিরে এসেছিল আরও এক বার, তার সাজানো ঘরটিতে। কেরোসিনের ল্যাম্পের আবছা আলোয় প্রতি পদে ঝলসে উঠছিল তার গা-ভরা গয়না। ফণিভূষণ সে দিনও তাকে দেখে বাকরুদ্ধ হয়েছিল বটে— তবে ভালবাসায় নয়, ভয়ে।

রবীন্দ্রনাথ ‘মণিহারা’ লিখেছিলেন উনিশ শতকের এক্কেবারে শেষের দিকে (১৮৯৮)। তার তিন বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল ‘নিশীথে’ (১৮৯৫), আর তারও তিন বছর আগে লেখা হয়েছিল ‘কঙ্কাল’ (১৮৯২)। বাঙালির সাহিত্যে কি সমাজে, এ ধরনের গল্প বলতে গেলে তখন একেবারেই নতুন। বেশ বিলিতি গল্পের টাকনা দেওয়া হাড়-হিম করা গল্প— দিশি ভূতপ্রেতের বালখিল্যপনার দফতরে একান্ত ভাবেই মার্জিত, পরিণত এবং রীতিমতো প্রাপ্তমনস্ক। উনিশ শতকের নব্বইয়ের দশকের কলকাতায় বাঙালির পরলোকচর্চার বিস্তৃতি বেশ চোখে পড়ার মতো হলেও খাতায়-কলমে ছাপানো ভূতের গল্পের সংখ্যা কিন্তু নেহাতই হাতে গোনা। ইতিহাসের কাটাছেঁড়ায় বলে, রাজনীতির বাহিরমহলেই হোক বা সমাজের অন্দরমহলে— সে সময়ে বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজে ওঠাপড়ার ছাপ প্রচুর। ভূতের গল্পের মতো ছেলেভোলানো, আকাশকুসুম গল্প শোনানোর সময় তখন কোথায়? একে তো হিন্দুরা দেশ বাঁচানোর কঠিন ব্রত নিয়েছে, কিন্তু বিলিতি আইনের বাড়তি কড়াকড়ি বাদ পড়ছে না কোনও মতেই। ধর্মের পুনরুজ্জীবনের নামে হিন্দুঘরের পুরুষেরা দু’টি বেলা মহারানির আইনের ছিছিক্কার না করে সন্ধ্যাহ্নিক করছেন না— ইংরেজের রাজত্বে দেশটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে, সাহেবগুলোর এতখানি সাহস যে,তারা এখন ভদ্রঘরের অন্দরমহলেও ঢুকতে চায়! বলি, ঘরের মেয়েদের বছর বারো অবধি আইবুড়ো বসিয়ে রাখলে তাদের ‘কুসন্তান’রা বাপ-পিতেমোর মুখে জল দেবে কী করে শুনি? লালমুখো সায়েবগুলো হিন্দুশাস্ত্র এক পাতাও পড়েনি, কৌলীন্যপ্রথার পবিত্রতা জানে না, অথচ সব কিছুতে বাদসাধতে চায়।

এই কঠিন সময়ে আশার কথা এটুকুই যে, হিন্দুরাও ছেড়ে কথা বলেনি একেবারে। রমেশ মিত্তির বাবু লড়ছেন, তাঁর পক্ষে সওয়াল করে কালীঘাট আর ভবানীপুরের বাবুরাও বড়লাটকে উদ্দেশ্য করে পত্র দিয়েছেন। সকলে মিলে আপ্রাণ জাতধর্ম বাঁচানোর শেষ চেষ্টাটুকু করছেন! সত্যি কথা বলতে, ইহজন্ম তো ম্লেচ্ছগুলোর ছোঁয়াছুঁয়িতে কবেই সকড়ি হয়ে গেছে, এখন জাতধর্মটুকু উদ্ধার হলে অন্তত পরলোকে সম্মানটুকু বাঁচে। কে একটা মেয়ে, ফুলমণি না কী যেন নাম, সে মরেছে বলেই কি জাতধর্ম বিসর্জন দিতে হবে? পিতৃপিতামহের কথা ভেবে তবেই না সংসার করা! জল না পেলে তাদের শাপশাপান্ত সইবে কে? কোথায় টুকটুকে লাল চেলি পরা কনেবৌ সংসার করতে আসবে, বছর সাত-আট বয়েস হবে, ননির পুতুলের মতো ডাগর ডাগর হাত-পা নেড়ে নতুন বেনারসি সামলাবে, আলো জ্বলবে, বাজনা বাজবে— দেখে যেন চোখ জুড়োয়! তা না, বারো বছরের ধাড়ি মেয়েকে কোন ভদ্রলোক ঘরে তুলতে রাজি হবে? হ্যাঁ, নতুন গয়না-শাড়ির খোঁচায় ছোট মেয়েগুলো একটু-আধটু কাঁদে বটে, কিন্তু ও রকম তো মেয়েরা কেঁদেই থাকে! বাবা-মাকে ছেড়ে বৌমানুষ শ্বশুরঘর করতে আসবে, স্বামী-পুত্রের মঙ্গলচিন্তায় প্রাণাতিপাত করবে, তার পর পাকা মাথায় সিঁদুর পরে সগ্গে যাবে— তবেই না তার জন্ম সার্থক! সে সব কি আর যে সে কথা! সারা জীবন ধরে কত কান্নাই তো তারা কাঁদে। কিন্তু বাজনাবাদ্যি, শঙ্খধ্বনি আর উৎসবের উল্লাসে সে কান্না তো চাপাও পড়ে নিমেষেই!

আর ম্লেচ্ছগুলো আইন বানিয়ে ঘরের মেয়েদের কান্নাকাটির ভার নিতে যাবেই বা কোন আক্কেলে? একেই তো সত্তরের আইন এসে বিয়ের মতো পবিত্র হর-পার্বতীর মিলনকেও কাটা-ছেঁড়া করে ছেড়েছে। এর পরে কি এটাও দেখতে হবে যে, বাড়ির মেয়েরা রাস্তায় দৌড়ে দৌড়ে উকিল ধরছে বিয়ে ভাঙতে? রাতবিরেতে অসুখবিসুখ করলে নিজেরাই গ্যাটম্যাট করে ডাক্তার-কবরেজের কাছে তদবির করতে ছুটছে? না না, তাদের এত বাড়তে দেওয়া চলবে না, বাড়ির সোমত্থ পুরুষমানুষগুলো রয়েছে কী করতে? শক্ত হাতে রাশ টানবে, শুধরে দেবে শুরুতেই, তার জন্যে বিলিতি আইনকানুনের দরকার পড়বে না। হ্যাঁ, শোনা যাচ্ছে, আজকালকার মেয়েরা নাকি কাব্য-উপন্যাস পড়ছে, কারা নাকি ছাপা কাগজ বেচে আবার দু’-চার পয়সা রোজগারও করছে! বিবিয়ানায় ঘাটতি নেই, একটু বকাবকি করতে গেলেই তাদের ফিটের ব্যামোয় ধরছে। সাহেবরা আবার একখানা গালভরা নামও রেখেছে এ সব বিবিয়ানি অসুখের— হিস্টিরিয়া। কিন্তু তাই বলে ক’জন আর আইন কপচে বিয়ে ভাঙছে? হিসেব নিলে দেখবে, গত তিন-চার বছরে মাত্র তিন কি চার। তাই বলি, ও সব রুকমাবাই-টাই বাংলায় চলবে না। ছোট জাতের মেয়ে, ওদের কথা যত কম বলা যায়, তত ভাল।

সহ্য করতে হবে। সেই কে কবে মুখে মুখে ছড়া বেঁধেছিল, ‘পুড়বে মেয়ে, উড়বে ছাই, তবে মেয়ের গুণ গাই’। গনগনে আগুনে পুড়ছে ননির হাত-পা, ঝলসে যাচ্ছে পটলচেরা চোখ, মটমট করে ভাঙছে হাড়-পাঁজরা— প্রাণান্তকর কষ্ট হচ্ছে, তাও সহ্য করো। সহ্য করো তত ক্ষণ, যত ক্ষণ না তোমার ভিতরকার স্বামী-সংসার নিয়ে পুতুলখেলার সাতরঙা স্বপ্ন পুড়ে আংরা হয়ে শ্মশানের হাওয়ায় মিলিয়ে যায়! তুমি তো ছোট্ট থেকে শিখেছ, তুমি দেবীর অংশ। সেই দেবীর দাহ হয়তো আজ অতীত, কিন্তু দহন তো তার সারাটা জীবন ধরেই! দেবীর মিলিয়ে যাওয়ার স্মৃতিটুকু নিয়েই তো সামনে এগিয়ে যাবে আমাদের গর্বিত সমাজ, স্যাঁতসেঁতে দুঃখী হাওয়ায় সংস্কৃতির ধ্বজা ওড়াবে। দেবীদের শেষ-না-হওয়া সুখ-অসুখ-যন্ত্রণার হিসেব আর কে কবে রেখেছে? সে হিসেব মেলানো কি নিছক মানুষের কাজ?

কিন্তু তাই বলে সেটাই তো শেষ নয়। সেই যে বঙ্কিমবাবু বলে গেছেন, “এখন জানিয়াছি যে, কুসুমে কীট আছে, কোমল পল্লবে কণ্টক আছে, ফলে বিষ আছে, উদ্যানে সর্প আছে...” ইত্যাদি, ইত্যাদি। তেমনি মানুষী জীবনে দেবীর ভাস্বর মহিমা ছাড়াও কিছু ধূসর প্রশ্ন রয়ে গেছে বইকি! সংসার-সঙ্গীতটি কি সব সময়েই এতখানি ‘উজ্জ্বল ও স্নিগ্ধ’? সেখানে জীবন-মৃত্যুর হিসেবগুলো কি সব সময়েই এত সুনিয়ন্ত্রিত? যদিও সদাসতর্ক সমাজ মৃত্যুতেও নিয়ন্ত্রণ বসাতে চেয়েছে প্রতি পদে! আর সে নিয়ম জীবিত মেয়েমানুষের মতো মৃতদের জন্যেও বেশ কড়া। মেয়েমানুষের দোষ থাকুক আর ছাই না থাকুক, বেঁচে থাকতে তার যেমন বাইরে বেরনোর উপায় নেই, মরার পর তেমনই আবার ঘরে ফেরার জো নেই। অর্থাৎ কিনা ভিতর-বাহিরের যে সমীকরণ সে জীবনভর বয়ে বেড়িয়েছে, মৃত্যুর পরেও তা থেকে তার মুক্তি নেই। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের বড় গল্প ‘মুক্তামালা’-র সেই দুঃখী বৌটিকে মনে পড়ে? কাদের বাড়ির ভালমানুষ বৌ, স্বামী তাকে খুন করে দ্বিতীয় পক্ষের সতিন ঘরে আনলে। বৌটি স্বামীর আচরণে এতটাই আঘাত পেলে যে, মরার পরেও তার অভিমান গেল না। সন্ধের পরে ও পথে কেউ গেলে সে নিদারুণ কান্নাকাটি করে অভিযোগ জানাত বলে শোনা যায়। প্রশ্নও করত, ‘কেন এত নিদয় হইলে?’ বুঝত না, তার মেয়েলি মান-অভিমানের পালা তার স্মৃতির মতো কবেই বেমালুম মুছে গেছে! তার পর ত্রৈলোক্যবাবুর ওই বড় গল্পেরই যশোদা পেতনি? ঠান্ডা কনকনে শুকনো জলায় যশোদা ঘুরে ঘুরে ছড়া কাটত, আর লোকজন দেখলে হা হা করে খানিক হেসে বাতাসে মিলিয়ে যেত। লোকে ভয় পেত বটে, কিন্তু বুঝত না, কতখানি কষ্টে বছরের পর বছর একই ক্ষোভ আউড়ে চলেছে যশোদা। বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে এত বছর পরেও তার অভিমানে মরচে পড়েনি এতটুকু। যশোদা কবে মরে পেতনি হয়ে গেছে, কিন্তু সমাজ তাকে অভিযোগ জানানোর আর দ্বিতীয় কোনও পথ শিখিয়ে দেয়নি। কিন্তু এমন ভয়ানক সতর্কতাতেও কি সবটুকু সামলে নেওয়া গেছে? বোধহয় না।

একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, উনিশ শতকের বাংলা গল্পে ভূতপ্রেত একান্ত ভাবেই ঘরছাড়া। তাদের আবাস হল বনবাদাড়-কাঁটাঝোপ-বেল-অশ্বত্থগাছ। আবার যারা মেয়েভূত, তাদের বেশির ভাগেরই মৃত্যু অপঘাতে— স্বামীর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, বিরহ, বিধবার পদস্খলন, আত্মহত্যা— এই জাতীয় রগরগে কেচ্ছাকেন্দ্রিক। বেচারারা মনে রাগ পুষে শেওড়া গাছেই দিন কাটাত, মাঝে মধ্যে সাদা শাড়ি পরে একটু-আধটু ভয় দেখিয়ে বা লোকের ঘাড়ে ঠান্ডা নিঃশ্বাস ফেলে মনের জ্বালা জুড়োত। ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে এসে সত্যিকারের দোষীকে শাস্তি দেওয়ার স্পর্ধা তাদের লেখক দেননি। তাই নিশুতি রাত বৃথাই যেত, বিরহিণীর অভিমান আর ফুরোত না। এ-হেন কঠিন সমাজের নজর এড়িয়ে মণিমালিকা তা হলে চৌকাঠটি পেরোল কী করে? শুধু সে-ই তো নয়, নিয়ম ভেঙেছিল তো ‘কঙ্কাল’ গল্পের সেই রূপসী বিধবা মেয়েটিও। একরত্তি বয়সে বিয়ে, স্বামী লোকটাকে ভয় ছাড়া আর কিছু করতে সে শেখেনি কোনদিনও। তার পর দু’মাসের মাথায় লোকটা মরতে হাঁপ ছেড়ে বাপের বাড়িতে সে যেই না নিজের পরিচিত জীবনে ফিরতে চাইল, অমনি লোকজন এককাট্টা হয়ে তাকে সাদা থানে মুড়ে, একগাদা কঠিন নিয়মের আওতায় পিষে ফেলে বোঝাতে চাইল যে তার জীবনটা এ জন্মের মতো ফুরিয়ে গেছে।

মেয়েটা মানেনি। কেন মানবে? তার তখন ভরা যৌবন, দাদার ডাক্তারবন্ধুকে বড় ভাল লাগে। যেতে আসতে সে চুপিচুপি তার গলার স্বর শোনে। কেন যে ভাল লাগায় সারা শরীর শিরশির করে, সে নিজেই বোঝে না। কিন্তু তার যে রাগও হয় ভীষণ! তীব্র অভিমান হয় যখন সে জানতে পারে, তার ভাল লাগার মানুষটিও কোন এক মেয়েকে বিয়ে করে সংসার পাততে চলেছে। যে সম্পর্ক একান্তই অনুভূতিনির্ভর, সেখানে বিচ্যুতির বেদনা বড় তীব্র। বিচ্ছেদের যন্ত্রণার চেয়েও ক্ষমাহীন অপমানের ক্ষত! কিন্তু সমাজ সে তীব্রতা বোঝে না, বুঝতে চায়ও না, কারণ তাতে যে তার এত দিনের শেখানো-পড়ানোর রাশ খসে পড়তে পারে! তাই রূপসী মেয়েটির বিদ্রোহও কেচ্ছা হয়েই থেকে যায়। অমুকের বাড়ির বিধবা আত্মঘাতী হয়েছে— এ খবর তো আর নতুন কিছু নয়, আকছার বেরোচ্ছে খবরের কাগজে। লোকে দু’দিন রসিয়ে-রসিয়ে তার ছিষ্টিছাড়া রূপযৌবনের বর্ণনা দিচ্ছে, তার পর ভুলে যাচ্ছে! কিন্তু এই মেয়ে তো দাদার বন্ধুটাকে অব্দি মেরে ফেললে। এমন পাপের শাস্তি না দিলে চলে? সমাজের প্রবীণ দিগ্‌গজেরা ভুরু কোঁচকায়, আর তার পর মেয়েটিকে শাস্তি দিতে না পারার অক্ষম রাগে শাস্তি দেয় তার নির্বাক মৃতদেহটাকে। হিন্দুঘরের বিধবা মেয়ের কপালে সিঁদুর, গায়ে বেনারসি শাড়ি, মরার আগে এক এক করে সিন্দুকের সব গয়না পরে কোন অলীক সুখের রূপকথা বুনেছিল সে? এত সাহস সে পেল কোত্থেকে? বিদ্রোহী দেহটাকে পরিত্যাগ করে আপনজনেরা। হাসপাতালের বেওয়ারিশ মর্গের ঠান্ডায় বছরের পর বছর ধরে নিভতে থাকে তার বিদ্রোহের আগুন। তার রূপ খসে পড়ে, গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট, লজ্জারুণ দুই চোখ ঠেলে বেরোয় সাদা কঠিন একখানা কঙ্কাল। কিন্তু সেই কঙ্কাল আজও গল্প শোনায়। দিনের আলো নিভতে না নিভতেই অন্ধকার ঘরের দেওয়াল হাতড়ে সে আজও খুঁজে বেড়ায় তার বুকের হাড়খানা, যেখানে তার ছাব্বিশ বছরের যৌবন, তার গোপন ভালবাসার মুহূর্তগুলো দানা বেঁধেছিল বছর পঁয়ত্রিশ আগে। অচেনা শ্রোতাকে শোনায় তার সাহসী মেয়েবেলার গল্প। যে বিদ্রোহে ভরপুর মেয়েবেলায় হয়তো ‘অন্যায়’ আছে, কিন্তু কুণ্ঠা বা আপস নেই! আর তাই চৌকাঠ পেরোনোর ভয়ও নেই। মৃত্যুর সময়েও তার সুন্দর ঠোঁটে রঙিন নেশার মতো এক টুকরো হাসি লেগেছিল। সেই হাসিতে কষ্ট ছিল, বিদ্রূপ ছিল, আর হয়তো এতটুকু আশাও কোথাও ছিল যে এই নিয়মসর্বস্ব সমাজও এক দিন তার অনুভূতি ফিরে পাবে!

যে জীবন অভিমান প্রকাশ আর তার প্রতিকারের দাবিটুকুও অসম্মান করেছে বার বার, তার উষ্মা কি শুধু কান্নায় জুড়োয়? বরং এক চিলতে হাসি, অনেকখানি ব্যঙ্গ আর ছোট্ট একটা প্রশ্ন জমিদার দক্ষিণাচরণের জীবনটা তছনছ করে দেয় প্রতি ‘নিশীথে’। ডাক্তার-বদ্যি, ঘুমের ওষুধ, পর পর মদের গেলাস— কিছুতেই বাগ মানে না। ওইটুকু ছোট্ট প্রশ্ন, কিন্তু কী অসম্ভব তীক্ষ্ণ তার ধার! কী জবাব দেবে দক্ষিণাচরণ? কেমন করে স্বীকার করবে তার রুগ্ণা প্রথমা স্ত্রীর উজাড় করা সখ্যের বিপরীতে নিজের ক্রমশ নিভে আসা অনুভূতি? ডাক্তারের মেয়ের সঙ্গে দু’বেলা গল্প করতে গিয়ে স্ত্রীকে ওষুধ দিতে ভুলে যাওয়া, ভুল ওষুধে স্ত্রীর হঠাৎ মৃত্যু, সত্বর দ্বিতীয় বিবাহ— এ সবই তো সমাজের দীর্ঘ দিনের চেনাশোনা ছবি। স্ত্রী হয়তো সবই বুঝতেন, নিশ্চুপে হাসতেন। লেখক তো বলেইছেন, দীর্ঘ রোগভোগে কিছু করার ক্ষমতা না থাকলেও ‘তাঁহার হাসিবার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল।’ আর সেই হাসিটুকুই বরাহনগরের বাড়ির বাগানের সবুজে, গঙ্গার জলের ওঠাপড়ায়, বালিহাঁসের ডানা-ঝাপটানোর শব্দে ধাক্কা খেয়ে আজও দক্ষিণাচরণের কানে ফিরে আসে, মেয়েলি গলায় অবিশ্বাসের সুরে বার বার কে যেন জানতে চায়, ‘ও কে? ও কে গো?’ দক্ষিণাচরণ নতুন বৌকে কাছে টানতে গিয়েও শিউরে ওঠেন, এই প্রশ্ন আগেও কোথায় শুনেছেন না? স্ত্রী এই প্রশ্নটিই কি তাঁকে করেছিলেন, যে দিন ডাক্তারের মেয়ে প্রথম এ বাড়িতে এসেছিল?

এতটুকু নির্দোষ একটা প্রশ্ন, দক্ষিণাচরণ ছাড়া আর কেউ শুনতেও পায় না, আর জানতেও পারে না কী ভয়ঙ্কর তীব্র তার ব্যঞ্জনা! তিষ্ঠোতে দেয় না একটা মুহূর্ত; আর সবচেয়ে ভয়ানক হল, সে প্রশ্ন উত্তরের অপেক্ষা করে না, শুধু বার বার মনে করিয়ে দিয়ে যায় প্রাণপণে ভুলতে চাওয়া একটা ছবি, সন্ধেবেলা রোগশয্যায় একলা অপেক্ষা করতে করতে ঝিমিয়ে পড়া, নিভে আসা একটা চাহনি; যেন সে বলতে চায় কতখানি ক্ষত জমে উঠেছিল তার সেই নিষ্প্রাণ চাহনিতে! স্বামী-অন্তপ্রাণ বড়বৌ কি নিজেই কোনও দিন জানতে পেরেছিল তার মধ্যে কতখানি বিদ্রোহ জমে আছে?

বিদ্রোহ কথাটার মধ্যে বেশ একটা গম্ভীর পুরুষালি নির্যাস আছে বটে। এ যেন শুধু পুরুষের একচেটিয়া গল্প। ভেতরবাড়ির রোজকার দিনযাপনের ওঠা-বসায়, অপ্রয়োজনীয় মান-অভিমানের চাপানউতোরে আর শুকনো চোখের জলেও কি এতখানি বিদ্রোহ মিশে থাকা সম্ভব? যে বিদ্রোহ জীবনভর নির্বাক যন্ত্রণার টুকরো টুকরো কোলাজ জুড়ে একটা স্পষ্ট রূপ পায় জীবনের পরেও? যে জীবন বেঁচে থাকতেই এতখানি অন্ধকার, যে জীবনের প্রত্যেকটি চাওয়া-পাওয়ার হিসেব সমাজ-উদ্ধারের নিক্তিতে মাপা, সেই জীবনের বিদ্রোহ কি মৃত্যুতেই শুরু হয় না? আর তাই সেই বিদ্রোহের গল্প, তা সে যত আষাঢ়েই হোক না কেন, সে গল্প অন্ধকারকে ভয় পায় না, মেয়েজীবনের নিয়মনীতিকে গ্রাহ্য না করে আরও এক বার চৌকাঠে এসে দাঁড়ায়। চৌকাঠের ও পারে যে তারই নিজে-হাতে সাজানো-গোছানো লক্ষ্মীমন্ত অন্দর— যে অন্দর তাকে ভাল রাখার মন্ত্র পড়েছিল, প্রেমে-অপ্রেমে আগলে রাখার আশ্বাস দিয়েছিল এক কালে! দেনাপাওনার হিসেবটুকু তা হলে বরং শুরু হোক সেখান থেকেই। তাই “শব্দ চৌকাঠ পার হইয়া অন্ধকার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। আলনায় যেখানে শাড়ি কোঁচানো আছে, কুলুঙ্গিতে যেখানে কেরোসিনের দীপ… প্রত্যেক জায়গায় এক-একবার করিয়া দাঁড়াইয়া অবশেষে শব্দটা ফণিভূষণের অত্যন্ত কাছে আসিয়া থামিল।”

এই তো সেই শোবার ঘর, যার নীচে দক্ষিণের বাগান— বড়বৌ নিজের হাতে মেহেদির বেড়া দিয়ে ঘিরে বকুলগাছের চারা পুঁতেছিল। ঘরের দেওয়ালে লক্ষ্মী-সরস্বতীর এক জোড়া লিথোগ্রাফ, কাচের আলমারিতে ছেলেবেলার চিনে পুতুল, এসেন্সের শিশি, সমুদ্রের কড়ি, শূন্য সাবানের বাক্স— মণিমালিকা এ সবই ভালবাসত। একলা দুপুরে গোপনে বাসন্তী রঙের শাড়ি আর বেলফুলের মালায় সেজে আর এক হদ্দবোকা রূপসী মেয়ে ভুলে যেত, সে বিধবা। সন্ধের আবছা, লালচে আলোয় যখন তার স্বপ্নগুলো রং মেলত, তখন “ডাক্তার হইয়া আপনাকে দেখিতাম, মুগ্ধ হইতাম এবং ভালবাসিতাম এবং আদর করিতাম।” তার পর যেই না দিনের আলো ফুরোত, এক এক করে দেউড়ির আলো জ্বলত, সেই অকারণ স্বপ্নগুলোও মিলিয়ে যেত আর বাঁশির শব্দে মনে পড়ে যেত, আজই রাতের লগ্নে ডাক্তারের বিবাহ! কিন্তু না, মৃত্যুতে সে ফুরিয়ে যাবে না কিছুতেই! তার এত রূপ, এতখানি ভালবাসা, তার পরম যত্নে সাজিয়ে তলা সাধের মেহেদি-বাগান, তার সংসার— তাকে ছেড়ে সে থাকবে কী করে? কেন থাকবে? সেই চিন্তাটুকু করার অপরাধে যদি মৃত্যুই পাওনা হয়, তা হলে সেই মৃত্যুই হোক না তার প্রশ্ন করার স্বাধীনতাও। যে সংসার মেয়েমানুষের স্নিগ্ধতা, শৃঙ্খলা আর পবিত্রতার নামে এত কাল ধরে তার ক্ষতগুলো আড়াল করার ভান করেছে, সেখানেও বিচ্যুতি ঘটুক আজ। প্রশ্ন জাগুক রাতের অন্ধকারে, দুর্বিনীত হোক বাদলা হাওয়া, চেনা জীবন উল্টেপাল্টে যাক বৃষ্টির শব্দে। চার-দেওয়ালের সুরক্ষা আর নিশ্চিন্দির আরাম ঘুচিয়ে জেগে উঠুক শ্মশানের স্তব্ধতা। আরও এক বার ফিরে আসুক নিশীথিনীরা। আত্মনিষ্ঠ সমাজ আর তার ধ্বজাধারীরা ভয় পাক। ভয়ে বিবর্ণ, বিস্ফারিত হতে হতে এক বার তলিয়ে ভাবুক, সমাজ-শোধনের গর্বিত উচ্ছ্বাসে কোনও ফাঁক থেকে গেল না তো?

যে অন্দরমহল হিন্দু সমাজ আর সংস্কৃতির গর্ব করত তার আনুগত্যের নিয়মে, নিষ্ঠায়, আচারে, বিচারে, সেখানে বার বার এমন প্রশ্নের তীক্ষ্ণতা, এতখানি প্রতিবাদ কি আগে শুনেছে বাঙালি সমাজ? তাও আবার মরা মেয়েদের মুখে, যারা রাতের অন্ধকার ফুরোলেই বেবাক মিথ্যে? তাও তারা প্রশ্ন করার স্পর্ধা রাখে? কোন রহস্যে এতখানি যন্ত্রণার পরেও তারা হাসিমুখে এগিয়ে আসে, আর তাদের স্পর্শে জাগে অপরিচিত শিরশিরে ভয়? মৃত্যুই কি তাদের প্রতিবাদের ভাষা জোগায়? কেমন সে প্রতিবাদ যা একই সঙ্গে এতখানি মর্মস্পর্শী আর এতটা তীব্র? কিসের জন্য সেই প্রতিবাদ, যা বাঁচা-মরার উপরে উঠেও নিজেকে খুঁজতে চায় আর খুঁজতে গিয়ে ভেতরবাড়ির ক্ষমতার অঙ্কগুলোও আমূল বদলে ফেলে? সেই মৃত্যুর কি তা হলে সবটুকুই শেষ নয়? ফুরিয়ে দেওয়ার বদলে সেই মৃত্যুই কি নিশীথিনীদের রূপান্তরের সূত্র জোগায়? শরীর থেকে অশরীরে, পরিচয় থেকে অপরিচয়ে, আনুগত্য থেকে বিদ্রোহে!

তখন সবে মাত্র ১৮৯০। বিদ্রোহ শুধুই ব্যঞ্জনায়। নিশীথিনীরা মিলিয়ে যায় একটুখানি অবিশ্বাসেই। রাতের অন্ধকার ফিকে হতে না হতেই দক্ষিণাচরণ তার টলমলে পৌরুষ ফিরে পায়, ব্যস্ত অ্যানাটমির ছাত্র বেমালুম ভুলে যায় রূপসী বিধবার গল্প, মণিমালিকার নামটাই মনে করতে পারে না ফণিভূষণ! একে একে ফিরে আসে চেনা ছক— অন্ধকার আর অপরিচিতির ভীতি কাটিয়ে। কিন্তু তাও শঙ্কা কাটে না, নিশীথিনীরা স্মৃতি হয়ে লুকিয়ে থাকে বিস্মৃতিতেই। হয়তো সেই স্মৃতিই আবার কখনও শরীর পায় অন্য কোনও ‘স্ত্রীর পত্র’-এ। তাই শেষমেশ নটেগাছটি না মুড়োনোই রয়ে যায়, নিশীথিনীর মায়া মিলিয়ে গিয়েও ফিসফিসিয়ে বলে যায়, ‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Story Rabindranath Tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy