ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।
না থুলায় চিন-ভারত সীমান্তের তুষারমরুতে ঘোড়ার ব্যবহার নেই বটে, কিন্তু ঘোড়সওয়ার আছেন এক জন। কূটনৈতিক কোনও চুক্তির পরোয়া না করে একমাত্র তিনিই অনায়াসে দু’দেশেরই সেনাছাউনিতে টহল দিতে পারেন। ডিউটির সময় ইউনিফর্ম পরার ফৌজি কানুনও তাঁর ক্ষেত্রে খাটে না। অন্ধকার নামলে সাদা জোব্বায় সেজে সাদা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে চলে তাঁর সীমানা পরিক্রমা। বছরে মাস দুয়েকের জন্য যখন ছুটিতে ঘরে ফেরেন, একটা বাড়তি উত্কণ্ঠার আঁচ পাওয়া যায় চিন সীমান্তে মোতায়েন ভারতীয় ফৌজের মধ্যে। ডিউটির মধ্যে ঝিমুনি এলে, অথবা চিনে ফৌজিরা সীমানার সীমা ছাড়ালে এই দুটো মাস সতর্ক করে দেওয়ার মতো আর কেউ থাকে না। পঞ্চাশ বছরের ডিউটিতে এই একটি মাত্র ফৌজির চোখে এক বারও পলক পড়েনি। খাতায়-কলমে অবসর নেওয়ার পরেও পালটায়নি তাঁর রুটিন।
এ হেন বাবা হরভজনের প্রোমোশন হলে যে তা কারও গাত্রদাহের কারণ হবে, কে জানত! এই কিংবদন্তি জওয়ানের প্রোমোশন এবং পেনশন নোটিসের বিরুদ্ধেই কিনা তাঁর জ্ঞাতিভাই এবং প্রাক্তন সহযোদ্ধা সুবেদার পিয়ারি সিংহ ২০০৬ সালে মামলা দায়ের করে বসলেন! যাঁকে নিয়ে চিনে ফৌজ তটস্থ হয়ে থাকে, তিনি নাকি প্রোমোশন তো দূরের কথা, পেনশনটুকু পাওয়ারই অধিকারী নন। কেননা, তিনি আদতে মৃত!
ফৌজি খাতায় তাঁর নাম থাকাটা সংবিধান মোতাবেক কুসংস্কারের প্রশ্রয় ছাড়া কিছু নয়। তাঁর জন্য ব্যয় বরাদ্দ, করের টাকার অর্থহীন অপচয়। জলন্ধরে জাস্টিস ধিলোঁ-র এজলাসে মামলা উঠল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর উচ্চ পদাধিকারীরা পিয়ারি সিংহের অভিযোগ যে অংশত যথার্থ তা একবাক্যে মেনে নিলেন। এ কথা ঠিক যে, বছর পঞ্চাশ আগেই দেহান্ত হয়ছে হরভজনের। কিন্তু এক দিনের জন্যও ডিউটিতে এক ফোঁটা ঘাটতি হয়েছে বললে ওই চিনে দুশমনরাও চমকে উঠবে! দেহান্ত হয়েছে মাত্র, মৃত্যু হয়েছে বলার দুঃসাহস হয় কী করে! নড়ে বসলেন বিচারক।
১৯৬২-র যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী জয় হাসিল করতে পারেনি। পরাজয়ের মাস দুয়েক পর রামলীলা ময়দানে ‘মেরে ওয়তন কি লোগো’ গাইলেন কিন্নরী লতা মঙ্গেশকর। প্রকাশ্যে অশ্রুপাত করেছিলেন জওহরলাল। এ গানে যে পাষাণের হৃদয় গলে না, সে আবার কীসের হিন্দুস্তানি, বলেছিলেন পণ্ডিতজি! ভুল হয়নি তাঁর। ওই গানে সত্যিই পরাজয়ের বেদনা ইতিহাস হয়ে গেল। লাদাখ থেকে নেফা পর্যন্ত সেনাছাউনি বসানো হল অবিলম্বে, স্বাধীন ভারতের আর এক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এই সুরক্ষাবলয়ে ২৩ নং পঞ্জাব রেজিমেন্টে বহাল হওয়ার সময় পঞ্জাব-তনয় হরভজন ভাবতেও পারেননি তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে অমরত্ব! হাতে বন্দুকও ধরতে হয়নি নিরীহ ওই কিশোরকে। গাধার পিঠে রসদ বোঝাই করে ভাঁড়ার পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া, ব্যস! এই অতি সামান্য কাজটুকু অত্যন্ত নিষ্ঠাভরে করতে করতে বেশ খোশমেজাজেই দিন কাটাচ্ছিলেন হরভজন। ধর্মে মতিগতি থাকার জন্য ফৌজ যোগ দেওয়ার আগে থেকেই হরভজনকে গাঁয়ের লোকে ‘বাবা’ বলতে শুরু করেছিল। নিয়তি হয়তো হেসেছিল মুখ টিপে।
১৯৬৮-র অক্টোবরের ৪ তারিখে প্রবল বর্ষণের পর শিবিরে ফিরে আসেননি হরভজন। ২৩ নং পঞ্জাব রেজিমেন্টের কোনও ফৌজকে আগে কখনও কোনও দুর্ঘটনায় পড়তে হয়নি। এই কারণেই হয়তো এই সামান্য পিওন স্তরের এক তরুণের অন্তর্ধানে উচ্চপদস্থ অফিসারেরাও যথেষ্ট তত্পর হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু প্রায় দু’দিন চিরুনি-তল্লাশিতেও তাঁর খোঁজ মিলল না। কানুন মোতাবেক তাঁকে নিরুদ্দেশ না মৃত বলে ঘোষণা করা হবে, সে নিয়ে চিন্তাভাবনাও শুরু হয়ে গেল। কিন্তু দু’দিন কাটার পর তৃতীয় দিন রাতে একসঙ্গে একাধিক জওয়ান দাবি করলেন যে, হরভজন তাঁদের স্বপ্নে দেখা দিয়েছেন। এই দাবিকে প্রাথমিক ভাবে আষাঢ়ে বলেই মনে হয়েছিল কর্তাব্যক্তিদের। কিন্তু এই ধরনের স্বপ্নাদেশ ঘন ঘন ঘটতে থাকায় ব্যাপারটাকে আর নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না। দুর্গম শিখরে সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা ফৌজিদের ঘাড়ে মৃত্যু অষ্টপ্রহর নিঃশ্বাস ফেলে। প্রায় সমস্ত পদমর্যাদার সদস্যই ঐশ্বরিক অনুগ্রহে বিশ্বাস করতে বাধ্য হন। স্বপ্নে হরভজন নাকি বার বার আকারে ইঙ্গিতে তাঁর দেহ খুঁজে পাওয়ার একটা রোডম্যাপ দিতে চাইছিলেন। অফিসারদের অনেকেই ভাবলেন, এক বার দেখাই যাক না কী হয়, ক্ষতি কী! প্রেতের ইশারা ধরে সার্চপার্টি বেরিয়ে পড়ল। ইশারা ছিল নির্ভুল। পাওয়া গেল হরভজনের দেহ। ৭২ ঘণ্টা বরফচাপা থাকলে দেহ থেকে প্রাণের লাবণ্য উবে যায় না। বড় জীবন্ত, পরিতৃপ্ত দেখাচ্ছিল হরভজনকে। সার্চপার্টির হতবাক ফৌজিরা নতজানু হলেন। সতীর্থকে কারওরই মৃত মনে হচ্ছিল না। তাঁদের সমবেত বিশ্বাসের আবেশে তাঁর দেহে তখন লেগে গেছে মৃত্যুঞ্জয়ের অনির্বচনীয় ঘামতেল। শহিদের মর্যাদায় সমাহিত করার পর হরভজনের সমাধিতে উড়ল ভারতীয় ফৌজের বিশেষ নিশান আর তেরঙ্গা। শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের পর শুরু হল মরণোত্তর কাগজপত্রের ফর্মালিটি। তবে সেটাও রয়ে গেল কাগজেকলমেই, বিস্ময়নাট্যে তখন সবে প্রথম অঙ্কের পরিসমাপ্তি ঘটেছে, যবনিকাপাত দূর অস্ত!
নিজের পরিবারের বা ভারতীয় ফৌজের কেউ নয়, চর্মচক্ষে অশ্বারোহী হরভজনকে প্রথম দেখতে পেয়েছিল শত্রুশিবির, অর্থাত্ চিনে ফৌজের টহলদারের দল। কে এই সাদা পোশাকের অশ্বারোহী? ইনি কি তোমাদের কোনও নতুন রিক্রুট? ফৌজের অনেক অধিকর্তা একেবারে অফিশিয়াল চিঠি পাঠিয়ে জানতে চেয়েছিল ভারতীয় ফৌজের কর্তাব্যক্তিদের কাছে। ব্যাপারটা আঁচ করে শিহরিত হলেও তত্ক্ষণাত্ চিনকে কোনও জবাব দেওয়া হয়নি। অনতিবিলম্বেই হরভজন এক কর্তার স্বপ্নে অবতীর্ণ হয়ে প্রত্যাদেশ দিলেন, চিনে ফৌজের আতঙ্কিত হবার কোনও কারণ নেই। ওরা বেগড়বাঁই না করলে ওদের কোনও ক্ষতি হবে না। তবে তাঁকে পাকড়াও করতে গেলে বা অন্যায্য ভাবে হামলার চেষ্টা করলে অবশ্য পরিত্রাণ নেই, পস্তাতে হবে তাদের। এই সব কথা বলতে ভালবাসেন হরভজনের ভাই রতন সিংহ। তাঁর কাছে চলমান অশরীরীর এ রকম বহু রোমাঞ্চকর গল্প মজুত আছে। শোনবার জন্য আগ্রহী লোকেরও অভাব নেই।
সারা রাত সীমানায় অতন্দ্র থাকেন বলে সকালে বাবার ঘুম ভাঙে দেরিতে, প্রায় পৌনে বারোটায়। সেই সাত বছর বয়সে বাবার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন সুনীল ছেত্রী। সংসার ছেড়ে শিখ ধর্ম গ্রহণ করে বাবার সেবায় ষোলো আনা আত্মনিয়োগ করেছিলেন দশ বছর বয়স হতে না হতেই। নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মনে করেন সুনীল, খাস সেবক হিসাবে বাবা স্বয়ং তাকে বেছে নিয়েছেন! বেলা সাড়ে এগারোটায় বাবার নাস্তা রেডি করতে হয় তাঁকে, গরম চা, ফুলকা অর্থাত্ হাতরুটি আর সামান্য আচার। প্রতি দিন একই মেনু। ঘরের বাইরে থেকে শিখবচনে কিছু মাঙ্গলিক স্তোত্র পাঠ করে বাবার ঘুম ভাঙানোও তাঁর প্রতি দিনের কাজ। শৌচাগারে জল গরম করাই থাকে। বাবা শয্যা ত্যাগ করে শৌচে গেলে তবে ঘরে ঢোকেন সুনীল। টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে রাখেন, বিছানার চাদর বদলান। ধূপ জ্বালেন। বাবার সাধের মিলিটারি বুটটি পালিশ করেন। দরজা সন্তর্পণে ভেজিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। বাবা কখন টহল দিতে বেরিয়ে যান আর রাতে কখন ফেরেন তা কেউ জানতে পারেন না। কিন্তু পরের দিন চাদরের ভাঁজ দেখে বোঝা যায় বাবা এই বিছানাতেই ঘুমিয়েছেন। সারা বছরের এই রুটিন বদলে যায়, বাবা যে দিন ছুটিতে যান। সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে ফার্স্ট ক্লাস কামরায় বাবার রিজার্ভেশন করা থাকে। একটি বাড়তি সিটও রাখা হয়, সেনাবাহিনীর কোনও পিয়নের জন্য। যাত্রাপথে বাবার ফাইফরমাশ খাটা এবং তাঁর সিটটাকে ফাঁকা ভেবে যাতে কেউ না বসে পড়ে, সে দিকে নজর রাখাই তার কাজ। যাত্রার দিন সকালেই গুরদীপ সিংহ ওরফে দীপু তাঁর ০৯১২ নম্বরের গাড়ি নিয়ে তৈরি থাকেন। নাস্তা হয়ে যাওয়ার পর বাবা জিপে সওয়ার হন। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে, পাহাড়ি পথের ঝাঁকুনি এড়িয়ে বাবাকে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার কাজ তিনি গত ১২ বছর ধরে করে আসছেন।
বাবার গ্রামের নাম কুকা তালওয়ান্দি, জেলা কপূরথালা, পঞ্জাব। ছেলের ‘মৃত্যু’র, থুড়ি, অমরত্বের বছর চারেক পর দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন হরভজনের মা। পিয়ারি সিংহের মামলার আগে পর্যন্ত ছেলের মাইনের টাকা মাসপয়লায় পৌঁছে যেত তাঁর কাছে। মামলার পর থেকে পৌঁছয় শুধু পেনশন। ছেলে ছুটিতে এলে মায়ের সঙ্গে তিনি হয়ে যেতেন সেই ছোট্ট বালকটি, হাসি-খুনসুটি-গল্প আর নতুন রান্নার আবদার। দৃষ্টিশক্তির ঘাটতি কোনও বাধা হত না। যাদের চোখের নজর ঠিক আছে, তারাই কি বরফচাপা পড়ার পরের দিন থেকে ইচ্ছে করলেই তাঁকে দেখতে পায়! বাবা দেখা না দিলে তাঁকে দেখার সাধ্য আছে কারও!
অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট রাজিন্দর সিংহ এক আশ্চর্য গল্প শোনান। ভারতীয় ফৌজের অসতর্কতার সুযোগে চিন সেনা ‘নাকি’ এক বার গোপনে হামলা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বাবা হরভজন তো আর অসতর্ক ছিলেন না! সীমান্তে পঁচিশ-তিরিশখানা এল.এম.জি (লাইট মেশিনগান) পুঁতে সেগুলোর ট্রিগারের মধ্যে দিয়ে একখানা দড়ি গুঁজে ফায়ার করতে লাগলেন তিনি। চিনে ফৌজ ঘাবড়ে গেল। তা হলে আর একখানা গোপন ব্যাটেলিয়ন আস্তিনে লুকিয়ে রেখেছিল ইন্ডিয়ান আর্মি! ইতিমধ্যে বাবা ভারতীয় সেনাছাউনিতে গিয়ে অফিসারদের যারপরনাই তিরস্কার করে মোবিলাইজ করে দিয়েছেন। চিনেরা অশরীরীর বুলেটবৃষ্টি সামলে থিতু হবার আগেই শরীরী ফৌজ হাজির হয়ে তাদের এক্কেবারে সীমানা পার করে দিয়ে এল। অবশ্য এর পরে দু’পক্ষই বাবার ক্রোধ প্রশমনের জন্য তাঁর সমাধিতে পুজো দিয়ে প্রায়শ্চিত্তও করে নিয়েছিল।
তাঁর সমাধিতে শুধু ভারতীয় ফৌজিরা নয়, ফুলের মালা, দীপের আলো, ধূপের ধোঁয়ার উপচার দিয়ে পুজো দেন অনেক পর্যটক। শোনা যায়, কখনও কখনও চিনা সেনাও নাকি গোপনে এসে মানত করে যায় বাবার থানে।
বাবা হরভজন জীবিত কি মৃত, ‘মরিয়া তিনি কী প্রমাণ করিয়াছেন’ এ সবের কূটতর্কে বিশ্বাসীরা যেতে চান না। তাঁরা জানেন বাবা আছেন। আর অবিশ্বাসীরা যে যা-ই বলুন, তাঁরা মানেন গল্পটা দুর্দান্ত রকমের জলজ্যান্ত। এ সবে বাবা অবিচল। তাঁর কাঁধে নাথুলার স্পর্শকাতর চিন-ভারত সীমান্তের গুরুদায়িত্ব। ’৬২-তে শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল। তখন তো বাবা একে কিশোর, তায় কেবলমাত্র ‘জীবিত’। কিন্তু দ্বিতীয় বার যদি চিনের সঙ্গে যুদ্ধ বাধে, তা হলে অন্তত নাথুলা সীমান্তে ভারতীয় ফৌজের পরাজয় ঘটবে না। চিন সেনা যদি হামলার মতলব আঁটে, গত ৫০ বছর ধরে বাবার প্রসাদে অন্তত ৭২ ঘণ্টা আগে খবর পেয়ে যায় এখানকার ফৌজ, বাবার সতর্কীকরণের তথ্য মিলিটারি রেকর্ডে উল্লেখ করারও রেওয়াজ ছিল ওই মামলার আগে পর্যন্ত।
barun.chattopadhyay@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy