Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

বাদাম পাটালি

পাটালির পথ চেয়ে বসে আছি আমরা। পাঁচঘড়ার বাদাম পাটালি। যে না খেয়েছে তার নাকি মানবজন্ম বৃথা। তাই মানবজন্ম সার্থক করতে আমরা ক’জন তীর্থের কাকের মতো বসে আছি। কিরুর দাদু নাকি আজকাল চুরিচামারি করছে খুব। সুযোগ পেলেই ফ্রিজ খুলে মিষ্টি, মিটসেফ খুলে এক পিস গলদাচিংড়ি বা ইলিশের পেটি নিয়ে সুট করে চলে যাচ্ছে।

উল্লাস মল্লিক
শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৫ ০১:৫৪
Share: Save:

পাটালির পথ চেয়ে বসে আছি আমরা। পাঁচঘড়ার বাদাম পাটালি। যে না খেয়েছে তার নাকি মানবজন্ম বৃথা। তাই মানবজন্ম সার্থক করতে আমরা ক’জন তীর্থের কাকের মতো বসে আছি।

কিরুর দাদু নাকি আজকাল চুরিচামারি করছে খুব। সুযোগ পেলেই ফ্রিজ খুলে মিষ্টি, মিটসেফ খুলে এক পিস গলদাচিংড়ি বা ইলিশের পেটি নিয়ে সুট করে চলে যাচ্ছে। ছাদে অথবা সিঁড়ির নীচে ঘাপটি মেরে খেয়ে নিচ্ছে। জিজ্ঞেস করলেই বলছে, না না, আমি কেন, আমি তো এই সকাল থেকে ঘরে বসে কাগজটা পড়ছি। নিশ্চয়ই দেখ, কিরু হবে।

দাদুর হাইপ্রেসার। ডায়াবেটিস। পেটেরও যেন কী সব গোলমাল। ডাক্তার কত কিছু খাওয়া বারণ। কিন্তু বুঝিয়ে পারা যাচ্ছে না কিছুতেই।

আর এ দিকে কিরুর ভারী মুশকিল। নিজের হাতসাফাইয়ের দায় তো আছেই; তার ওপর দাদুরগুলোও ঘাড়ে চাপছে। এই তো সে দিন চিকেন রেজালা হয়েছিল, একটা বড় লেগপিস গুনতিতে কম; ঝোলমাখা বাটি পাওয়া গেল কিরুর পড়ার টেবিলের নীচে। সবাই বলল, এ তা হলে নিশ্চয়ই কিরু। আরে, কী কাণ্ড, চিকেন হচ্ছে সে দিন, এই সংবাদটা পর্যন্ত ছিল না কিরুর কাছে।

কিরুর সঙ্গে আমাদেরও মস্ত লস। মানে, আমি ভোল্টে আর গাবলু। কারও বাড়িতে ভালমন্দ কিছু এলে, সে জিনিস আমাদের আড্ডাতেও চলে আসে। এই যেমন, ভোল্টের পিসেমশাই কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়া এনেছিল। ভোল্টে কয়েকটা ম্যানেজ করে নিয়ে এল। সবাই খেলাম। গাবলু আনল শক্তিগড়ের ল্যাংচা। সে বার যে ছোটমামা বর্ধমানের সীতাভোগ নিয়ে এল আমাদের বাড়ি, আমি তা থেকে বেশ খানিক সরিয়ে সবাইকে খাওয়ালাম। শুধু কিরুর দিক থেকে সাপ্লাই বন্ধ। দেওঘরের প্যাঁড়া থেকে মুম্বইয়ের আলফানসো আম এমন অনেক কিছুর আশা জাগিয়েও শেষ পর্যন্ত খালি হাতে এসেছে কিরু। এসে চালিয়েছে দাদুর নামে, দাদুর জ্বালায় নাকি কিচ্ছুটি থাকছে না। ভোল্টে তাই সে দিন রেগেমেগে বলেই দিল, দূর, খালি বাজে কথা। খাওয়াবার ইচ্ছে নেই, তাই দাদুর নামে দোষ দিচ্ছিস।

কিরুর বুঝি আঁতে লাগল বেশ একটু। চোখ ছুঁয়ে প্রায় দশ-বারোটা ঠাকুরের নামে দিব্যি কেটে বলল, কাল তোদের পাঁচঘড়ার বাদাম পাটালি খাওয়াব; যদি না খাওয়াই, তবে আমার নামে... ইত্যাদি।

সেই পাটালির পথ চেয়ে জোড়াকালীতলার পিছনে বসে আছি সবাই। এই পাটালি যেমন মিষ্টি, তেমন মুড়মুড়ে। বিদেশে পর্যন্ত যায়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ইংল্যান্ডের রানি,
কে না খেয়েছে এই জিনিস! সবাই খেয়েছে আর তারিফ করে সার্টিফিকেট দিয়েছে। শুধু আমরা ক’জনই যা বাকি।

দেখলাম কিরু আসছে। ছুটতে ছুটতে আসছে। আসতেই সবাই বললাম, পাটালি কোথায়, পাটালি? সরাতে পারিসনি বুঝি এ বারও?

কিরু ভীষণ উত্তেজিত। হাঁপাচ্ছে। বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, পেরেছি।

তা হলে কোথায়? হাত তোর ফাঁকা কেন! সঙ্গে ব্যাগট্যাগও তো দেখছি না কিছু!

কিরু বলল, বলছি, বলছি।

কিরু বলতে লাগল বুঝলি, সকাল থেকেই তো তক্কে তক্কে আছি, কখন চান্স পাব; মা যেই না ঠাকুরঘরে ঢুকেছে, অমনি আমি সোজা রান্নাঘরে একটানে মিটসেফ খুলে ফেললাম; স্টিলের একটা টিফিন কৌটোয় ভর্তি পাটালি। চাপাটা খুলে বড় একটা টুকরো নিলাম বুঝলি। তোরা তো তিন জন আছিস, কোনও দিন খাসনি, তাই বেশ বড় দেখে নিলাম, যাতে তোরা বেশি করে...

ভোল্টে তাড়া দেয়, আরে তার পর কী হল বল।

বলছি তো! কিরু বলে, তার পর যেই না পিছন ফিরেছি, অমনি দেখি মা। মা বলল, তোর হাতে কী? আমি বললাম, কিছু না। বলল, তা হলে হাতটা লুকোচ্ছিস কেন, দেখি হাতটা। বলে, মা এগিয়ে এল আমার দিকে; আমিও অমনি সুট করে পাশ দিয়ে চোঁ-চা দৌড়।

আমি এতক্ষণ দম বন্ধ করে শুনছিলাম। কিরু ধরা পড়েনি দেখে শ্বাস ছাড়লাম। বললাম, কিন্তু পাটালি কোথায়?

কিরু বলে, বলছি বলছি; শুনবি তো একটু ধৈর্য ধরে; তার পর বুঝলি যেই বাড়ি থেকে বেরতে যাব, অমনি দেখি সামনে বাবা, একদম সামনেই।

তোর বাবা? আঁতকে ওঠে গাবলু।

তবে নয়তো কী তোর? কিরু বলে, তখন কী করলাম বল তো? সিঁড়ি দিয়ে সোজা উঠে গেলাম দোতলায়। কিন্তু দোতলায় দেখি অন্য বিপদ জেঠু। বড় বাটিতে করে কাঁচালঙ্কা দিয়ে মুড়ি খাচ্ছিল, আমাকে দেখে বলল, কিরু দৌড়াদৌড়ি কেন; হাতে ওটা কী তোর? জেঠু মিষ্টি খাওয়া একদম পছন্দ করে না; দেখলেই কেড়ে নেবে; আমার তখন অবস্থা বুঝলি ওই যে রে, কী বলে, জলে বাঘ, না কী যেন?

অধৈর্য ভোল্টে তাড়া দেয়, আরে বাঘ-ভাল্লুক ছাড় এখন, পাটালিটা কী করলি?

কিরু বলে, বলছি বলছি, ব্যস্ত হচ্ছিস কেন! কিন্তু কথাটা আমার মনে পড়ছে না কেন বল তো? কী যেন বলে গাছে বাঘ না, জলে বাঘ।

ভোল্টে খেঁকিয়ে উঠে বলে, জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। হল তো? নে এ বার বল, পাটালি কোথায়?

কিরু বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। আমার অবস্থা তার চেয়েও খারাপ জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ আর গাছে সাপ।

আচ্ছা, ঠিক আছে, নে তাই হল; বাঘ কুমির সাপ সব রইল। কিন্তু পাটালি কোথায়?

কিরু বলে, আমি তখন পাটালিটা শক্ত করে ধরে দ্রুত নেমে এলাম নীচে। বাবা-মা দু’জনেই তখন বারান্দায়। আমি ওদের মাঝখান দিয়ে গলে, বাঁ দিকে বেঁকে, সোজা ঢুকে গেলাম দাদুর ঘরে।

গাবলু বলল, ও আর দাদু তোর থেকে নিয়ে খেয়ে নিল এই তো গল্প তোর! বুঝেছি, বুঝেছি।

আহা, রেগে যাচ্ছিস কেন? কিরু বলল, দাদু তো তখন বাথরুমে; খাবে কী করে।

তা হলে পাটালি কোথায় তোর? আমি বলি।

কিরু বলে, সেটাই তো বলছি, তোরা বলতে দিচ্ছিস কই! আমার অবস্থাটা তখন বুঝে দেখ, বাইরে বাবা-মা; জেঠুও নেমে এসেছে ওপর থেকে; ঘর থেকে বেেরালেই সবাই আমাকে ধরবে। তাই, ‘কী করি, কী করি’ ভাবতে ভাবতে হঠাত্‌ একটা বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। দাদুর বুক সেল্ফে প্রচুর বই, আমি করলাম কী, মোটা অক্সফোর্ড ডিকশনারির পিছনে লুকিয়ে রাখলাম পাটালিটা। তার পর বুক ফুলিয়ে বাইরে এসে বললাম, দেখ, আমার কাছে কিছু নেই। ব্যস, তোরা বিকেলে আয়, আমি চুপি চুপি বের করে আনব তখন।

গাবলু দাঁত খিঁচিয়ে বলে, আহা কী বুদ্ধি, আর তোর দাদু যদি ডিকশনারি সরাতে যায় এর মধ্যে!

তাতে কী! কিরু বলে, সরালে সরাবে।

তোর কি মাথা গেছে। আমি চিত্‌কার করে বলি, এ তো বেড়ালকে মাছ পাহারায় রাখা।

কিরু খিকখিক করে হাসে। হাসি দেখে গা জ্বলে যায় সবার। আমরা উঠে পড়ে বলি, যা যা, তোকে কোনও দিন কিছু খাওয়াতে হবে না, চল।

হনহন করে হাঁটছিলাম আমরা। পিছন থেকে কিরু ডাকে, এই রাগ করছিস কেন? এটা দেখ।

আমরা থমকে দাঁড়ায়। তাকাই কিরুর দিকে। কিরু হাসি মুখেই এগিয়ে আসে, ডান হাতটা পকেটে। ধীরে ধীরে হাতটা বের করে আনে। মুঠো খোলে। দেখি, দু’পাটি বাঁধানো দাঁত।

কিরু বলে, দাদুর। পাটালি পেলেও দাদুর কী অবস্থা হবে বল তো ওই যে রে, বল না, মনে আসছে না কথাটা; বল না কী বলে।

আমরা এ-ওর মুখের দিকে তাকাই।

কিরু বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে বেল পাকলে কাকের কী!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy