প্রতীকী ছবি।
কায়িক, মানসিক পরিশ্রমের পরে শরীরে বিশ্রামের চাহিদা উৎপন্ন হয়। উপেক্ষা করলে সমস্যা এবং বিপদও বাড়ে। তা হলে উপায়?
ধরুন, দারুণ একটা সোফা কিনেছেন। তার উপরেই ২৪ ঘণ্টা খাচ্ছেন, ঘুমোচ্ছেন, দুমদাম করে বসছেন। আপনার সম্পদটি অচিরেই নষ্ট হবে।
আবার ধরুন, শীতকালে জল গরম করার গিজ়ার। তার সুইচ নিশ্চয়ই খেয়াল করে অফ করেন? সব সময়ে এই যন্ত্র চালিয়ে রাখলে সেটি খারাপ তো হবেই, দুর্ঘটনার আশঙ্কাও থেকে যায়।
আমাদের শরীরও তো সম্পদ, সেটাও যন্ত্র-ই। তাকে সাধ্যের অতিরিক্ত খাটালে, অবিরাম তার থেকে পরিশ্রম দাবি করে গেলেও একই সমস্যা। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নষ্ট হবে। শরীরের কলকব্জা বিগড়ে যাবে। বিপদ ঘটার সম্ভাবনা বাড়বে। স্বাভাবিক বুদ্ধি বলে, অফুরন্ত কাজের মধ্যে থাকলে সেই কাজের চাপ শরীর, মনকে আচ্ছন্ন করে। জোর করে শরীর-মনকে নিংড়ে নিলে যা বেরোয় তাকে আর ‘অমৃত’ বলা চলে না। তা হল বিষ। চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় টক্সিন। বৈজ্ঞানিকেরা বলেছেন, বিশ্রাম শরীর ও মনকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। বিশেষত, এই অতিমারি-কালে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে ‘বিশ্রাম’-এর বহু উপযোগিতার কথা শোনা যাচ্ছে। শরীর-মনে বিশ্রামের প্রয়োজনীয়তা ও বিরাম নেওয়ার উপায় নিয়ে পরামর্শ দিলেন সিনিয়র কনসালট্যান্ট ইন মেডিসিন বিশ্বজিৎ ঘোষ দস্তিদার।
বিশ্রামের উপকারিতা
‘‘শরীর আর মন দুটো আলাদা নয়, একই সঙ্গে মিশে থাকে। একে অপরের উপরে নির্ভরশীল। জীবন-জীবিকার প্রয়োজন তো রইলই, শরীর কিন্তু স্বাভাবিক প্রবণতা থেকেই কাজ করতে চায়। কিন্তু সেই কাজের পরে শরীরে বিশ্রামের চাহিদাও উৎপন্ন হয়। শরীর-মন কখন সেই বিশ্রাম চাইছে, মানুষমাত্রেই কিন্তু বুঝতে পারেন,’’ বললেন ডা. ঘোষ দস্তিদার।
কোনও কাজ করতে ইচ্ছে করছে না— এই অনুভূতি কিন্তু শরীরের বিশ্রাম চাওয়ার অন্যতম লক্ষণ। কিন্তু মুশকিল হল, জীবজগতের প্রতিটি প্রাণী বিশ্রাম নিতে জানে। সারা দিনের পরিশ্রমের পরে পাখি বাসায় ফিরে আসে। সিংহ শিকারের পর তিন দিন ঘুমোয়। কিন্তু মানুষের দুর্বলতা হল, এই প্রজাতিটি বিশ্রাম নিতে জানে না। এ বিষয়ে তারা পটু নয়। তার কারণ আমাদের সভ্যতা, কর্মসংস্কৃতি, অফুরন্ত চাহিদা। প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে, নিরানন্দে কেবলই কাজ করে চলে মানুষ। যখন বিশ্রাম নেওয়ার কথা, তখন বিশ্রাম না নিয়ে কাজ করলে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয়ে যায়। ‘স্ট্রেস’ সৃষ্টি হয়।
ডা. ঘোষ দস্তিদার জানালেন, স্ট্রেস থেকে শরীরে কিছু হরমোন ও রাসায়নিক তৈরি হয়। সেটা ধীরে ধীরে হৃদ্যন্ত্র, ধমনী, রক্তচলাচলের নালিগুলির উপরে ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি করে। স্ট্রেসও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে রক্তনালি সরু হয়ে যাওয়ার একটা কারণ। এর থেকে অপরিণত বয়সে হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। বিশ্রামের অভাব এ ভাবেই মৃত্যুকে ডেকে আনতে পারে। আমাদের দেশে এমন উদাহরণ অনেক।
বিশ্রাম নেওয়ার পরে তাজা শরীর মনের উৎপাদনের গুণমান ও পরিমাণ দুই-ই বেশি। দেখা গিয়েছে, বিশ্রাম নিলে শরীরে ইন্টারফেরন নামক রাসায়নিক তৈরি হয়। অ্যান্টিবডি গঠিত হয়। এগুলি ভাইরাস আক্রমণ থেকে শরীরকে বাঁচাতে সাহায্য করে। যুগ যুগ ধরে মানুষ পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখেছে সপ্তাহে এক দিন ছুটি দরকারি। তাই রবিবারের ছুটি বা ডে অফের ধারণাটা এত গুরুত্বপূর্ণ। এই সপ্তাহান্তের অবসরটুকু না থাকলে মানবজাতিই হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যেত। এখন মানুষ বাকি ছ’দিন এতটাই পরিশ্রম করে যে, দেখা যাচ্ছে এক দিন ছুটিও যথেষ্ট নয়। এতেও স্ট্রেস হরমোনের ক্ষরণ থামছে না। শারীরিক রোগ ছাড়াও, অবসাদ, ক্লান্তি, মানসিক অসুখ বাড়ছে। এই শারীরিক ধকল, মানসিক শ্রান্তিতে পারিবারিক শান্তি বিঘ্নিত হয়। ব্যক্তিগত, পারিবারিক স্তরের শান্তি ও সুস্থিতি রাখতেও তাই বিশ্রাম প্রয়োজন।
বিশ্রাম মানে আলস্য নয়
‘‘বেশ কিছু দেশ শরীর ও মস্তিষ্ককে সম্পদ বলে স্বীকৃতি দেয়। বিরামহীন শ্রমকে সম্পদ নষ্ট করা বলে মনে করে। কিছু দেশে ক্ষমতার বাইরে মানুষকে কাজ করালে, তার জন্য জবাবদিহি করতে হয়। এ দেশে সেই বন্দোবস্ত নেই। এখানে মেধা ও দক্ষ শ্রমিক থাকলেও উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব। ফলে প্রায় সব ক্ষেত্রেই কাজের ভার বেশি,’’ আক্ষেপ করলেন ডা. ঘোষ দস্তিদার। তাঁর মতে, নিজের শরীর মনকে পর্যাপ্ত বিরতির ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে। কত বয়সে কতটা ঘুম প্রয়োজন, তার একটা পরিমাপ অনেক ক্ষেত্রেই দেওয়া হয়। তবে ব্যক্তিবিশেষে, কাজের প্রকৃতি অনুযায়ী এই ঘুম বা বিশ্রামের মাপ অনেকটাই হেরফের হয়। কতটা বিশ্রাম নিলে এবং কী ভাবে বিশ্রাম নিলে আপনি তরতাজা হচ্ছেন, নিজেকেই বুঝে নিতে হবে। তবে বিশ্রাম মানে আলস্য নয়। ঘুম, বিনোদন, বেড়ানো, বাচ্চার সঙ্গে খেলা, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো যা করতে ভাল লাগে, তাই করুন। তবে সেই সময়টা সোশ্যাল মিডিয়াকে দেওয়া স্বাস্থ্যকর অভ্যেস নয়।
করোনা থেকে সেরে ওঠার সময়ে পর্যাপ্ত বিশ্রাম (বেড রেস্ট নয়) দরকার। রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা এবং অন্য ক্ষয়ক্ষতিগুলি মেরামত হবে। প্রতিষেধক নেওয়ার পরেও বিশ্রাম জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy