পরিকাঠামোর ঘাটতি, আগাম সতর্কতার অভাব সব মিলিয়ে রাজ্য কতটা অ-প্রস্তুত, প্রতি মুহূর্তে তা দেখিয়ে দিচ্ছে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস। ওই মারণ রোগজনিত পরিস্থিতিকে বাগে আনা যাচ্ছে না কিছুতেই। পরিত্রাণের আশায় অগত্যা আকাশের দিকেই তাকিয়ে আছে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর।
আকাশের দিকে তাকানো মানে আকাশভাঙা বৃষ্টির আশায় থাকা। উত্তরবঙ্গে কয়েক দিনের লাগাতার অতিবৃষ্টিই এখন এনসেফ্যালাইটিস পরিস্থিতির মোড় ঘোরাতে পারে বলে মনে করছেন জীবাণুবিজ্ঞানীরা। বৃষ্টি কী ভাবে মোকাবিলা করবে রোগের?
জীবাণুবিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা, জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের জীবাণুবাহী কিউলেক্স বিশনোই মশা জন্মায় মূলত ধানখেতে। অতিবৃষ্টিতে বন্যা-পরিস্থিতি তৈরি হলে জলে ডুবে যাবে ধানখেত। বিশনোই মশার প্রজনন-স্থলও যাবে ভেসে। ডিম পাড়ার জায়গাই পাবে না মশারা। ধানগাছের পাতায় যে-ডিম থাকবে, ভেসে যাবে তা-ও। এ ভাবেই আঁতুড়ে বিনষ্ট হবে রোগের বাহক।
এমনিতে অগস্ট মাসটা মশাদের প্রজননের ভরা মরসুম। তাই মশাবাহিত রোগও এই সময়েই বেশি ছড়ায়। কারণ, এই সময়ে পরিষ্কার জল জমে থাকে বিভিন্ন জায়গায়। মশারা সেখানে ডিম পাড়ে। তবে একটানা তোড়ে বৃষ্টি চললে কিউলেক্স বিশনোই মশার ডিমের মতো ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী মশা অ্যানোফিলিস স্টিফেনসাই-এর ডিমও ভেসে যায়। ডেঙ্গির জীবাণুবাহী মশা এডিস ইজিপ্টাই অবশ্য ডিম পাড়ে ঘরের ভিতরে জমে থাকা পরিষ্কার জলে। তাই অতিবৃষ্টিতে ম্যালেরিয়া এবং এনসেফ্যালাইটিসের সংক্রমণ অনেকটা ব্যাহত হলেও ডেঙ্গির ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা তেমন নেই। তবে এখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস। তাই তার বাহক কিউলেক্স বিশনোই মশার বংশ লোপের জন্য প্রবল বৃষ্টি দরকার।
“বৃষ্টি খুব বেশি হলে চার পাশ ধুয়ে গিয়ে মশাদের বংশবৃদ্ধির আশঙ্কা কমবে,” বলছেন কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা, পতঙ্গবিদ অমিয় হাটি। কিন্তু যদি আশানুরূপ বৃষ্টি না-হয়, তা হলে অগস্টেই বিস্তর ফাঁড়া আছে বলে আশঙ্কা করছেন অমিয়বাবু। তিনি বলেন, “শুধু তো এনসেফ্যালাইটিস নয়। বর্ষার পরে পরে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গির মরসুমও এসে যাচ্ছে!”
রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী জানান, বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছেন তাঁরাও। তাঁর কথায়, “এ বার বর্ষার শুরুতে তেমন বৃষ্টি হয়নি। বিক্ষিপ্ত বৃষ্টির ফলে মশার বংশবৃদ্ধির হার বেড়ে গিয়েছে। এখন যদি ভারী বৃষ্টি হয়, পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবেই।” আশার কথা, আবহাওয়া দফতর উত্তরবঙ্গে আগামী কয়েক দিনে ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস দিয়েছে।
বরুণদেবের কৃপা প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের প্রতিষেধক টিকার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন বলেছিলেন, টিকা কর্মসূচিতে কিছু পরিবর্তনের কথা ভাবা হচ্ছে। শুধু শিশু নয়, বয়স্কদেরও প্রতিষেধক টিকা দেওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি। বাংলার বিশেষজ্ঞেরাও এই বিষয়ে রাজ্য প্রশাসনকে উদ্যোগী হতে অনুরোধ করেছেন। অমিয়বাবুর মতে, কোনও মতে এই সময়টা কাটিয়ে দিয়ে রাজ্য সরকারকে এনসেফ্যালাইটিসের প্রতিষেধক দেওয়ার কাজ শুরু করে দিতে হবে পুজোর পরেই। কারণ, প্রতিষেধক টিকা নেওয়ার পরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠতেই অন্তত একটি মাস সময় লাগে। তাই বর্তমান পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বার আগেভাগেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। “এই প্রতিষেধকের দু’টি ডোজ রয়েছে। একটি নেওয়ার এক মাস পরে দ্বিতীয় প্রতিষেধকটি নিতে হয়,” বলেছেন ওই পতঙ্গবিদ।
আগাম সতর্কতা হিসেবেই টিকা চাই। অতিবর্ষণের উপরে যে রোগ নিরাময়ের স্থায়ী দায়িত্ব চাপানো যায় না, স্বাস্থ্যকর্তারাও তা জানেন। বিশেষ করে যে-ধরনের এনসেফ্যালাইটিসে এ বার বেশি প্রাণহানি ঘটেছে, সেই ‘অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রোম (এইএস) অতিবৃষ্টিতে বাগে আসবে কি না, সেই বিষয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের কোনও ধারণাই নেই। এক স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, সম্ভবত জল থেকেই সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বলে পুণে ও দিল্লির জীবাণুবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। অতিবৃষ্টি হলে ওই সংক্রমণের কী হাল হবে, সেই ব্যাপারে স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের কাছে কোনও ধারণাই নেই। তাই শুধু বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে না-থেকে স্বাস্থ্যকর্তারা ওই রোগ সম্পর্কে সচেতন হওয়ার জন্য সাধারণ মানুষকে অনুরোধ জানাচ্ছেন।
শুধু আমজনতা সতর্ক হলেই হবে না। এ বারের পরিস্থিতি থেকে তাঁদেরও শিক্ষা নিতে হবে বলে মনে করছেন রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা। এই ব্যাপারে ইতিমধ্যেই আট সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি তৈরি করেছে রাজ্য সরকার। সংক্রমণস্থল ঘুরে দেখে রিপোর্ট তৈরি করবে ওই কমিটি। কোথায় কোথায় এ বার কী ধরনের পরিকাঠামোর ঘাটতি ছিল, প্রচারের অভাবই বা কতটা দায়ী, নির্দিষ্ট সময়ে তথ্য না-মেলায় রোগ নিয়ন্ত্রণে তৎপর হতে কত দেরি হয়েছে সবই থাকবে ওই রিপোর্টে। এর মধ্যেই উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এইএস-এ আক্রান্ত হয়ে ববিতা শর্মা (২২) নামে এক তরুণীর মৃত্যু হয়েছে বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর। তাঁর বাড়ি নাগরাকাটায়। শনিবার সকালে তাঁকে ভর্তি করানো হয়েছিল। মৃত্যু হয় ওই রাতেই। জলপাইগুড়িতে নতুন করে এক জন এইএস-আক্রান্তের হদিস মিলেছে রবিবার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy