অর্থনীতিই তাঁর বিদেশনীতির মূল সুর।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরে এক সপ্তাহও কাটেনি। কিন্তু তারই মধ্যে এই বার্তা স্পষ্ট করে দিলেন নরেন্দ্র মোদী। প্রথমে পাকিস্তানের সঙ্গে বৈঠকে কথা বললেন বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রসার নিয়ে। এ বারে আসছে চিন। এই দুই পড়শি দেশের সঙ্গেই বিভিন্ন বিষয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে ভারতের। রয়েছে সীমান্ত নিয়ে সমস্যাও। সে সব নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি মোদী বুঝিয়ে দিতে চাইছেন, তাঁর অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে বাণিজ্য বা অর্থনীতি।
নওয়াজ শরিফের আগমন কূটনৈতিক ক্যালেন্ডারে পূর্ব নির্ধারিত ছিল না। তাঁর সফরের রেশ কাটতে না কাটতেই দিল্লি পরের হাই প্রোফাইল অতিথি হিসেবে রাজধানী পেতে চলেছে চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই-কে। ৮ জুন দ্বিপাক্ষিক ভারত সফরে চিনের বিশেষ দূত হয়ে আসছেন তিনি।
ওয়াং ই-এর এই সফর গত কালই চূড়ান্ত হয়েছে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গিয়েছে। এর পর আজ সকালে মোদীকে ফোন করেন চিনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্যছিয়াং। নতুন প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, ভারতের নতুন সরকারের সঙ্গে ‘সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করাই’ তাঁর লক্ষ্য। মোদী খ্যছিয়াংকে জানান, ‘বকেয়া কৌশলগত বিষয়গুলির সমাধানের’ পাশাপাশি দু’দেশের মধ্যে ‘অর্থনৈতিক যোগাযোগ সম্প্রসারিত’ করতে আগ্রহী তিনি।
দু’দিন আগে হায়দরাবাদ হাউসে নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বৈঠকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে থমকে যাওয়া বাণিজ্যের রাস্তা খোলার চেষ্টা শুরু হয়েছে। দু’দেশের মধ্যে বিদেশসচিব পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়িয়ে শক্তিক্ষেত্র থেকে শুরু করে সীমান্ত বাণিজ্য, বিশেষ আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্ত অঞ্চলের মর্যাদা দেওয়ার মতো সম্ভাবনাগুলি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই পথ ধরেই এ বার এশিয়া তথা বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ চিনের সঙ্গে বাণিজ্য-সখ্য বাড়াতে তৎপর হচ্ছেন মোদী। তবে ইসলামাবাদের সঙ্গে যেমন বাণিজ্য সম্পর্কের গতি কার্যত রুদ্ধ হয়ে রয়েছে, বেজিং-এর ক্ষেত্রে বিষয়টা তা নয়। মনমোহন সরকারের সময় থেকেই চিনের সঙ্গে সীমান্ত-সহ বিভিন্ন তিক্ততার বিষয়গুলিকে পৃথক কূটনৈতিক পথে সমাধানের চেষ্টার পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবে চিনের সঙ্গে অর্থনৈতিক যোগাযোগ বাড়ানোর কৌশল নেওয়া হয়েছিল। ঠিক এক বছর আগে চিনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর খ্যছিয়াং তাঁর প্রথম বিদেশ সফরের জন্য বেছে নিয়েছিলেন ভারতকেই। চেষ্টা হয়েছিল দ্বিপাক্ষিক তিক্ততা কাটিয়ে নতুন রাস্তা খোঁজার।
মোদী ক্ষমতায় আসার পর বুঝে নিতে চাইছেন এত বছরের কূটনৈতিক দৌত্যে লাভের লাভটা কী হল? আর এই প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করেই তিনি সাজাতে চাইছেন চিনের বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে আসন্ন বৈঠকের আলোচ্যসূচি। বিদেশ মন্ত্রকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অফিসারদের কাছে গত দশ বছরের ভারত-চিন বাণিজ্যিক সম্পর্কের সমস্ত তথ্য ও নথি দেখতে চেয়েছেন মোদী। তাতে দেখা যাচ্ছে যে, খ্যছিয়াংয়ের আগের চিনা প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও-এর সময় থেকেই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের প্রশ্নে মারাত্মক ভাবে পিছিয়ে পড়েছে ভারত। ভারতীয় বাজারে যে পরিমাণ পণ্য রফতানি করেছে বেজিং, চিনের বাজারে পাঠানো ভারতীয় পণ্য তার ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি। শেষ আর্থিক বছরে ভারতে চিনের রফতানি ৫ হাজার ৪৩০ কোটি মার্কিন ডলার। উল্টো দিকে চিনে ভারতের রফতানি মাত্র ১ হাজার ৩৫২ কোটি ডলার। এই বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টি শুধু মুখে বলাই নয়, ভারত-চিন যৌথ বিবৃতিতেও বারবার বিশদে রাখা হয়েছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার তেমন কোনও প্রতিফলন দেখা যায়নি। বিদেশ মন্ত্রকের বরাবরের অভিযোগ, মুখে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নিয়ে বললেও কাজের বেলায় বহু পণ্যই ভারত থেকে কিনতে চায়নি বেজিং। সেই তালিকায় যেমন রয়েছে খেলনা, বস্ত্র বা কৃষিপণ্য, তেমনই আছে ওষুধ বা তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প। আর উল্টো দিকে, নিজেরা সস্তায় পণ্য ঢুকিয়ে দিয়েছে ভারতের সর্বত্র। তা সে খেলনাই হোক বা বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি, জামাকাপড়ই হোক অন্য কিছু। বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্তাও এ কথাই জানালেন। বললেন, “এর ফলে মাথায় হাত পড়ছে আমাদের দেশের উৎপাদন শিল্পের। বিনিময়ে চিন যা কিনছে, তা হল লোহা, ইস্পাত, বিভিন্ন আকরিক-সহ কাঁচা মাল।”
অথচ খাতায়কলমে এই চিনই ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য শরিক। এই অদ্ভুত অসাম্য দূর করে চিনে ভারতের পণ্য রফতানি ও বিনিয়োগ বাড়াতে শুরু থেকেই কাজ শুরু করে দিতে চাইছেন মোদী। ক্ষমতায় আসার পর এত দ্রুত চিনের সঙ্গে বৈঠকের উদ্যোগ সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। কূটনীতিকদের মতে, এশিয়ার কূটনীতিতে ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং ব্যক্তিত্বের বড় ভূমিকা থেকেই যায়। নরেন্দ্র মোদী এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই বেজিং-এর বিশেষ সখ্যের ইতিহাস রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বড় অঙ্কের চিনা বিনিয়োগ এনেছেন গুজরাতে। নিজেও চিনে গিয়েছেন একাধিকবার। দু’দিন আগে চিনের স্টেট কাউন্সিলার ইয়াং জিয়াচি সে দেশে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছেন, “চিন ভারতের নতুন সরকারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে উৎসাহী। শীর্ষস্তরের যোগাযোগ আরও ঘনঘন যাতে করা হয়, সে জন্য সক্রিয় হতে হবে।” চলতি বছরের কূটনৈতিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী চিনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মোদীর দেখা হওয়ার কথা রয়েছে জুলাইয়ে ব্রিকস সম্মেলনে। তা ছাড়া জুনের শেষে পঞ্চশীল সম্মেলনে বেজিং-এ যাওয়ার কথা রয়েছে ভারতীয় নেতৃত্বের।
বাণিজ্য বাড়ানোর প্রয়াসের পাশাপাশি চিনের সঙ্গে সমস্যার ক্ষেত্রগুলিও যাতে কমিয়ে আনা যায়, সে জন্য চাপ বজায় রাখার কথাও ভাবছে মোদী সরকার। অরুণাচল, চিনা অনুপ্রবেশ, দক্ষিণ চিনা সাগরে বেজিং-এর সক্রিয়তা এই বিষয়গুলি নিয়েও চিনা নেতৃত্বের সঙ্গে আসন্ন বৈঠকে সরব হবেন ভারতীয় নেতৃত্বে। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য যেটা জরুরি মোদীর পক্ষে। ঠিক যে ভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য-আলোচনার পরেও সন্ত্রাস প্রশ্নে সরব হয়েছে নয়াদিল্লি। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, পাকিস্তান ভূখণ্ডকে যেন ভারত-বিরোধী কাজে ব্যবহার না করা হয়। বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে সুষমা স্বরাজ জানিয়েছেন, বোমার আওয়াজে আলোচনার স্বর ডুবে যায়। ইসলামাবাদকে অবিলম্বে সেগুলি বন্ধ করার জন্য সুর চড়িয়েছেন তিনি।
নরম এবং গরমের এই কূটনৈতিক ভারসাম্য, পরিস্থিত এবং রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা মেনে আগের সরকারে মতোই চালিয়ে যেতে হবে মোদীকেও। তফাত শুধু একটাই। এর মূল লক্ষ্য এ বার হবে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ানো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy